পাভেল আখতার, আপনজন: এক. এ এক সর্বনাশা সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে ! ফিল্মি স্টুডিওর বাইরে অজস্র পুরুষ ও নারীর নাছোড় ‘চেষ্টার গল্প’ আগে খুব শোনা যেত। উদ্দেশ্য : রুপোলি পর্দায় অভিনয়। গ্ল্যামারের আলোয় ভেসে যাওয়ার উৎকট লালসা। এজন্য মুম্বাই পাড়ি দিয়েছে কত তরুণ ও তরুণী। আজকাল একটি অত্যন্ত ‘সহজ পথ’ হয়তো সেই তীব্র বাসনাকে অনেকটাই প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। সেটা হ’ল, ‘রিল’ বানানো। ইউ টিউবে ভিডিও দেওয়া। সে যে কত ‘রঙ্গের’ রিল বা ভিডিও তার হিসেব সম্ভবত নেই! দেদার রোজগারও হচ্ছে, তার সঙ্গে ‘মুখ’ দেখানোর আত্মরতি। কিন্তু, দুধের সাধ নিদারুণ ঘোলে মেটানোর এই ‘কর্মযজ্ঞ’ নিতান্ত ব্যক্তিগত হলেও বা আরাধ্য ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তর্গত হলেও যে প্রশ্নটা উদ্বেগের সঙ্গে উঠে আসে তা হ’ল, মূর্তিমান সমাজ এতে উপকৃত হচ্ছে, না কি এই মদিরাস্রোতে উচ্ছন্নে যাচ্ছে ? জানা যাচ্ছে, ইস্কুল ও কলেজের বহু পড়ুয়াও এই ‘মহান কর্মব্রতে’ তৎপর ! তাদের পড়াশুনাও কি লাটে উঠছে না ? কিন্তু, কিছু বলার নেই-ও। ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’। ‘অকারণ হুল্লোড়’ কেবল এই চকমকি পাথরের দোহাই-এ যে ‘ছাড়পত্র’ পাচ্ছে তার ‘অভিঘাত’ মন্দ হলেও বোবা হয়ে থাকতে হবে এমনই ক্রান্তিকাল চলছে এখন !
দুই. ‘টাইটানিক’ ছবিখ্যাত অভিনেত্রী কেট উইন্সলেট একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তাদের মুখাবয়বের ত্বকের উপরে পুরু মেকআপের আস্তরণ থাকে। ‘মোহগ্রস্ত’ হওয়ার আগে সাধারণ মানুষ যেন এটা মনে রাখে। কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ভাবার মতো। রুপোলি পর্দার অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের উদ্দেশে একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। ‘তারকা’। দূর-আকাশের প্রেক্ষাপটে ঝলমল করা ‘তারকা’ মনকে আকৃষ্ট করে, তার মায়াবী আলোয় আবিষ্ট করে। কিন্তু, যতই হোক, তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাটির পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব অনেক বেশি। আকাশের জীবন আর মাটির জীবন এক নয়। ‘তারকা’ কখনও সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে গ্রথিত হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘’যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা, আমি ভালবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।”
তিন. মেকআপ, কেশবিন্যাস, আধুনিক পোশাক ইত্যাদি সরিয়ে দিলে দেখা যাবে ‘মোহময়তা’র আর কোনও চিহ্নই নেই। এই প্রেক্ষাপটে একটি ভিন্ন কথা বলা যাক। আজকাল অগণিত অনলাইন পত্রপত্রিকার আবির্ভাব হয়েছে। সেইসব পত্রপত্রিকায় প্রতি নিয়ত যে শিরোনাম ও খবর দেখা যায় তাতে অভিনেত্রীদের সম্পর্কে থাকে অবধারিত কিছু শব্দবন্ধের ব্যবহার। কয়েকটি বলা যাক। ঝড় তুললেন, উষ্ণতা ছড়ালেন, উত্তাপ সঞ্চার করলেন ইত্যাদি। জ্বলজ্যান্ত নাগরিক সমাজ এইসব ভাষার ব্যবহারে আপত্তির কোনও কারণ খুঁজে পায় না, যা আশ্চর্যজনক। এসব কি নারীর অবমাননা নয় ?
চার. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় কুসুমকে সামনে রেখে যে প্রশ্ন রেখেছিলেন, নারীকে শরীরসর্বস্বতার প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন যে পুরুষের বিনোদনপূর্তির উপচার, সেকথা ‘উপস্থাপক নারীরা’ যেমন বোঝেন না, তেমনই বোঝেন না নারীবাদীরাও। ওইসব অতি নিন্দনীয় ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ শব্দবন্ধের বিরুদ্ধে তারা সঙ্গত ‘প্রতিবাদ’ করবেনই বা কীভাবে ? তার আগে তো অবশ্যই ‘প্রতিবাদ’ করতে হবে ‘আধুনিকতার উদযাপন’-এর নামে ওইসব নগ্ন, অর্ধনগ্ন পোশাকের বিরুদ্ধে, যার সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে ওই শব্দবন্ধগুলি ! এত বেশি অস্বচ্ছ, স্ববিরোধী, প্রবঞ্চনাপূর্ণ চিন্তাভাবনার স্রোত আজকাল প্রবহমান যে, এই ধরনের লেখার মধ্যে আবার ‘রক্ষণশীলতা’ খুঁজে পাওয়ার মতো লোকজনও বিস্তর ! প্রকৃতপক্ষে অদ্ভুত ‘আধুনিকতার ধারণা’ সমাজ পরিসরে বিস্তার লাভ করেছে ! পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা, আবার পুরুষেরই মস্তিস্কপ্রসূত ‘সুন্দরতম ফাঁদে’ পড়ে যে তোতাপাখির বুলি উচ্চারণ করছে সেই বোধবুদ্ধিও হারিয়ে ফেলা ! বস্তুত, আপন হৃদয়ে আধুনিকতার অসার শ্লাঘা অনুভব করা এইসব মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার দৈন্য অপরিসীম !
পাঁচ. বিশ্বময় এখন মানুষকে পুতুলের মতো প্রতিদিন, প্রতি-মুহূর্তে নাচায় রাক্ষুসে পুঁজিবাদ ! বুদ্ধিভ্রষ্ট মানুষের মুখে সে ভ্রমাত্মক ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আধুনিকতার বুলি আওড়ানোর ভাষা দিয়েছে ! সে জানেও না যে, দুটোই নিয়ন্ত্রণ করছে আসলে ‘পুঁজিবাদ’! ‘পুঁজিবাদ নিপাত যাক’-এই শ্লোগান আর তেমন একটা শোনা যায় না। যদিও শ্লোগানে কিছু বদল হয় না। ‘আত্মদর্শন’ সবার আগে। সেটাই দেখি না। অতীতেও এই শ্লোগান বিস্তর দিয়ে কোনও লাভ হয়নি। দেখতে হবে, ‘পুঁজি’ সম্পর্কে মানুষের চেতনার বিকাশ হয়েছিল কি না। আর, সেটা কোনও কালেই হয়নি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct