সারিউল ইসলাম, আপনজন: দিনটা ছিল ১৯৮৮ সালের ২৪শে জুন, শুক্রবার। নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় মুসলিমদের উপর হামলা চালায় একদল দুষ্কৃতি। অন্যদিকে ট্রেন থামিয়ে শেষের তিনটি বগিতে বেছে বেছে মুসলিমদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ চালায় তারা। এই ঘটনায় সরকারিভাবে মৃত ২৯ জন বলা হলেও শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছিল সেদিন। ঘটনা হয়তো আপনাদের জানা। হ্যাঁ, ১৯৮৮ সালের কাটরা মসজিদ দাঙ্গা! তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একটা সময় বলেছিলেন, ‘সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না।’ অথচ তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ভয়ংকর দাঙ্গা ঘটেছিল মুর্শিদাবাদে। ৩৬ বছর পার হয়ে গেলেও বিভিন্ন কমিটি তৈরি করার পরেও আজ পর্যন্ত সেই রিপোর্ট অপ্রকাশিত। কিন্তু কেন প্রকাশ হলো না কাটরা মসজিদ দাঙ্গার রিপোর্ট?
১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে কাটরা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। একসময় এই মসজিদে প্রায় হাজার দু’য়েক মুসল্লী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। পাশাপাশি সেখানে ছিল একটি মাদ্রাসা। ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পে মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের স্রোত আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গে। বহু মুসলিম জমি জায়গা ফেলে ওপার বাংলায় শরনার্থী হয়। যার ফলে কাটরা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হলেও নামাজে মুসল্লী কমতে থাকে। ইংরেজ আমলেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি অধিগ্রহণ করে, তবে নামাজে ছিল না কোন বাঁধা। স্থানীয় সিঙা গ্রামের জনাব ইয়াহিয়া সাহেব কাটরা মসজিদ চত্বরে একটি ইসলামিক জলসার আয়োজন করেন। জলসার পোস্টার দেখে এলাকার লাল-গেরুয়া মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে। ততদিনে বাংলার বুকে বামফ্রন্টের সহায়তায় গেরুয়া ব্রিগেড বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
হঠাৎ ১৯৮৮ সালে নামাজ সহ সব রকম ধর্মীয় কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। মুসলিম লীগ ঘোষণা করে নামাজ বন্ধের ইস্তেহার তুলে নিতে হবে, নয়তো ২৪শে জুন শুক্রবার কাটরা মসজিদ চত্বরে জুম্মার নামাজ পড়বে মুসল্লিরা। মুসলিম লীগের এই কথা স্থানীয় গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়তেই নির্ধারিত দিনের দিন ২০ আগে থেকে ময়দানে নামে বামফ্রন্ট। এক ধরনের লিফলেট হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায়। লিফলেটে লেখা ছিল ‘২৪শে জুন ১৯৮৮-এর জমায়েত ব্যর্থ করুন।’ লিফলেটে নাম ছিল বামফ্রন্টের সাংসদ মাসুদল হোসেন, জয়নাল আবেদীন সহ অন্যান্য বাম নেতাদের। লিফলেটে গেরুয়া পন্থীদের পাল্টা আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। বামেদের মধু বাগ, তরুণ দে, আব্দুল বারী, ছায়া ঘোষের নাম ছিল। তারা হিন্দু প্রধান এলাকায় গিয়ে উস্কানি মূলক বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
২৪শে জুন ১৯৮৮, শুক্রবার প্রশাসনের কথায় কাটরা মসজিদ চত্বরে নামাজ পড়ার বদলে বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক হাজার মুসল্লি সেখানে উপস্থিত হন। মুসল্লিরা বাড়ি ফেরার সময় পুলিশ প্রশাসন তাদের কাশিমবাজারের দিক দিয়ে ফিরতে বলে। লালসড়ক মোড়ে লাঠি, বল্লম, রামদা, খাড়া, হাসুয়া সহ ভয়ঙ্কর হাতিয়ার নিয়ে একদল দুষ্কৃতী বাড়ি ফেরা মুসল্লিদের উপর আক্রমণ চালায়। পোস্ট অফিস ও দোকান ঘরে আশ্রয় নেওয়া ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষদের টেনে বার করে খুন করা হয়। কাশিমবাজারের নিমতলা এলাকায় প্রায় ৭০ জনের একটি দলকে আক্রমণ করে কচুকাটা করা হয়। লাশগুলো কাটি গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়।
নিমতলা থেকে একদল মানুষ হাতিনগর পার হয়ে জীবননগর নামক মুসলিম গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথে মধ্যে তাদেরকেও আক্রমণ করে কচুকাটা করে সেই দুষ্কৃতীরা। প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ জমায়েত করে নাকুড়তলায়, তারা জানতো না কাটরা মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়টি পরিবর্তিত হয়েছে। সেখান থেকে পুলিশ বেশিরভাগ মানুষকে অন্যত্র নামাজের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলে অল্প সংখ্যক মানুষ কাটরা মসজিদ চত্বরে উপস্থিত থাকে। পুলিশের সামনে পান্না নামক সিপিআইএম এর স্থানীয় সমাজবিরোধী সহ বাম ও গেরুয়া পন্থী নেতারা গণহত্যা চালায় নাকুড়তলায়।
সর্ববৃহৎ পরিকল্পিত গণহত্যা হয় শুক্রবার সন্ধ্যায় নসিপুর স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে। জিয়াগঞ্জ, ভগবানগোলা, লালগোলা যাওয়ার প্যাসেঞ্জাররা ঠাসাঠাসি করে ৩৬৫ আপ লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠে পড়ে। সন্ধে ৬টা ১০ মিনিটে ট্রেনটি নসিপুর পৌঁছালে চেন টেনে ট্রেনটি থামানো হয় এবং প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ সশস্ত্র দুষ্কৃতী ট্রেনের শেষ তিনটি কামরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। সেখানে প্রাণভয়ে লুকিয়ে থাকা মানুষজন বলেন, রাতে ট্রাক নিয়ে এসে মৃতদেহ গুলি গায়েব করা হয়। উল্লেখ্য, নসিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের দখলে, সুতরাং এলাকায় বামফ্রন্ট ছাড়া আর কারো প্রভাব ছিল না।
আমার বাবার বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। তার মুখ থেকে শুনেছি, কাপাসডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের এলাকার গ্রামগুলিতে প্রবেশ করার কথা জানতে পেরে মানিকনগর অর্থাৎ আমার গ্রাম এবং শিবনগর গ্রামের মানুষজন বাস-লাঠি হাতে প্রতিরোধের জন্য গোবরানালার সীমান্ত এলাকাগুলিতে দাঁড়িয়েছিল।
আমার মায়ের মুখ থেকে শুনেছি, তার বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। গোপালনগর গ্রামে মা সহ স্থানীয় সকল শিশুদের পাটের জঙ্গলে দুই দিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
ঘটনার ২২ দিন পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মুর্শিদাবাদে আসেন। কিন্তু বহরমপুর সার্কিট হাউস থেকে আর কোথাও যাননি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি তিনি।
এই ঘটনার পর বিধানসভায় প্রচুর হইচই হওয়ার পরেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন বসায় যা ক্রমশ হিমঘরে চলে যায়। যেমনটা ওয়াকাফ কেলেঙ্কারি নিয়ে জ্যোতি বাবু বিচারক গীতেশরঞ্জন বাবুকে দিয়ে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়েছিলেন, যেটি কখনো দিনের আলো দেখতে পাইনি।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে সমাজকর্মী তইদুল ইসলাম বলেন, ‘বাম আমলে কত বড় দাঙ্গা হয়েছিল মুর্শিদাবাদে, তা মানুষ যাতে জানতে না পারে সেই কারণে রিপোর্ট প্রকাশ করেনি সরকার। প্রথমে দেব কমিশন তারপর চৌধুরী কমিশন তদন্ত করে এই ঘটনার। কিন্তু সেই রিপোর্ট প্রকাশ হলে সরকারের বদনাম হতো। তাই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি সরকার। আমরা চাই সেই রিপোর্ট দ্রুত প্রকাশিত হোক।’
কাটরা মসজিদ দাঙ্গার ৩৬ বছর পার হলেও শতাধিক সংখ্যালঘু মানুষের জীবনের কোন মূল্য ছিল না প্রমাণ করেছে সরকার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct