পাভেল আখতার, আপনজন: একটি ব্যবস্থা যখন মসৃণভাবে চলতে থাকে তখন সেটাই ‘অভ্রান্ত’ হিসেবে জনমানসে গেঁথে যায়। তখন স্রোতের প্রতিকূল ভাবনা অন্তর্ধান করে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের হাসির নাটক ‘গোড়ায় গলদ’-এ বলা বিনোদবিহারীর সেই কথাটার মতো। ‘বিয়ে না করে করে বিয়ে না-করাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে !’ চলমান শিক্ষাব্যবস্থায়, বলা ভাল পরীক্ষাব্যবস্থায়, এখন ছোট প্রশ্নের আধিক্য, যাকে গালভরা ভাষায় বলে--’অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন’, যার ক্ষতিকর দিকগুলি একসময় যথেষ্ট আলোচিত হলেও এখন কেবল নিটোল স্তব্ধতা। অর্থাৎ, ওই যে বলছিলাম, চলতে চলতে একসময় ‘ভুল’টাই ‘ঠিক’ হয়ে যায়। বস্তুত, ‘শিক্ষা’ বস্তুটা যে আদতে কী সেটাই আমরা বুঝলাম না ! কিংবা, বুঝেও অবুঝের মতো পড়ে থাকলাম কী এক মোহে, এখানে যে মোহটার নাম সম্ভবত--’নম্বর, পরীক্ষায় নম্বর’ ! নইলে, এটা তো দুর্বোধ্য কিছু নয় যে, শুধু ‘তথ্য’ মুখস্থ করা ও মনে রাখার নাম ‘শিক্ষা’ নয়। মূলত, চিন্তার বিকাশ ও তার স্ফুরণের কথাই ‘শিক্ষা’ শব্দটির মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু, চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়টাই অবলুপ্ত। ফলে, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীকে ‘তোতাপাখি’ বানানোর যে বিরোধিতাটা করেছিলেন তা আর বন্ধও হ’ল না ! আমাদের পরম আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা অনেক নম্বর পাচ্ছে ; কিন্তু, কিন্তু...!!
এই অঢেল নম্বরপ্রাপ্তির সুবন্দোবস্ত’র আবহেও ছাত্র ফেল করে। কিন্তু, ছাত্র কেন ফেল করে তার অনেক কারণ থাকলেও সেই অন্বেষায় না-গিয়ে ‘ছাত্র কেন ফেল করবে, তাহলে শিক্ষকরা কেন আছেন’--এমন একটা ‘প্রশ্ন’ই কেবল সমাজের ভেতরে আবর্তিত হয়। প্রশ্ন যদি ‘সংবেদনশীলতা’ থেকে সৃষ্ট হয় তাহলে প্রশ্নকর্তাও আপনমনে উত্তরটা একটু ভাবতে বসে। কেবল ‘প্রশ্ন’ ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে ‘সংবেদনশীলতা’ থাকে না। তাছাড়া, ‘প্রশ্ন’ করাটাও একটা ‘দায়বদ্ধতা’। সেটা না-থাকলে ‘প্রশ্ন’ বস্তুটাই ‘অর্থহীন’ হয়ে যায়। ধরা যাক, ‘বাজার’ সম্পর্কে বা ‘দ্রব্যমূল্য’ সম্পর্কে কোনও রকম খোঁজখবর না-রেখেই একজনকে কেউ একশোটা টাকা আর তার হাতে একটা লম্বা ফর্দ দিয়ে বললেন, ‘যাও, এগুলো নিয়ে এসো।’ এবার সে যদি ফর্দ মোতাবেক সমস্ত কিছু কিনে আনতে না পারে, তাহলে কি তিনি তাকে বলবেন যে, ‘তুমি তাহলে বাজারে কী করছিলে যে ঠিকমতো সবকিছু কিনতে পারোনি ?’ প্রশ্নটা তখন হাস্যকর হয়ে যায় না কি ?
চলিত শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ছাত্রের ‘ফেল’ করা কঠিন, ‘পাশ’ করা বরং সহজ। কথাটা ‘অদ্ভুত’ শোনালেও মূর্তিমান বাস্তব। পাঠক্রম, প্রশ্নপত্র রচনা এবং উত্তর লেখা ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের ধরনধারণ, মোটকথা সমগ্র পরীক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যারা অবহিত তারা এছাড়া আর কিছু বলতে অপারগ। বলাই বাহুল্য, এই অতি-সহজিয়া ব্যবস্থার আনুকূল্যেই কিন্তু পরীক্ষায় কমপক্ষে পাশের, এমনকি অতি-ভাল ফলাফলেরও ‘হার’ অত্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু, এই দৃশ্যমান পটচিত্রের মাঝেও যেসব ছাত্র ‘কঠিনতম কাজটি’ করে ফেলে, অর্থাৎ ‘ফেল’ করে, তার জন্য ‘দায়টা’ তার হলেও সে সেই ‘দায়টা’ বহন করতে বাধ্য হয়। এমন বহু ছাত্র আছে, যারা কেবল পরীক্ষার সময় পরীক্ষাটা দিতে স্কুলে আসে। তাহলে তারা কী করে ? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়--’ওরা কাজ করে’। আর, এই ‘কাজ’-এর মাধ্যমে ‘দারিদ্র’ নামক অভিশাপের ‘ওরা খেসারত’ দেয় পরীক্ষায় ‘ফেল’ করে। ওদিকে যারা স্কুলে আসে তাদের অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। তারাও দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে। তার সঙ্গে আছে বাড়িতে শিক্ষাচেতনা, সহায়তা ও প্রেরণার অভাব। বহু কারণ। অবশ্যই এই ছবিটি গ্রামবাংলার, যেখানে মূলত এই ‘ফেল’ ব্যাপারটা দৃশ্যমান।
শিক্ষিত, সচেতন ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের বৃহত্তর জগৎটাকে দেখলে হবে না ! কঠিন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে দু’চারজনের তুমুল উজ্জ্বল ফলাফল দেখে ‘লড়াই’-কেই যেভাবে অভিনন্দিত করার ঢেউ বইতে দেখি তাতে বলতে হয়, তাহলে যারা ‘লড়াই’ করতে পারল না এবং সেজন্য এই ঢালাও নম্বরপ্রাপ্তির বাজারেও ফেল করল, ‘দোষ’ কি কেবল তাদের মনে করা হচ্ছে বলেই এই অধ্যায়টা ভুলে থাকা ? অদ্ভুত ব্যাপার !
অপরদিকে বহিরঙ্গে চকচকে বেসরকারি ইস্কুলগুলির ভেতরটা কেমন ? তাদের গোড়াতেই যে গলদটা প্রকট তা হ’ল অবৈজ্ঞানিক সিলেবাস। সিলেবাস রচনার প্রাথমিক শর্তই হ’ল, ছাত্রের বয়সের দিকে লক্ষ রাখা। অর্থাৎ, কোন বয়সের ছাত্র কি কি পড়বে। বেসরকারি ইস্কুলগুলি এর তোয়াক্কাই করে না। অপ্রয়োজনে হলেও ‘অন্য প্রয়োজনে’ গাদাগুচ্ছের বই দেওয়া হয়। আর, সেইসব বইয়ের ভিতরে চোখ রাখলে তো পিলে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে। ধরা যাক, প্রথম শ্রেণির একটি ছাত্রকে দেওয়া হয়েছে কম্পিউটার, পরিবেশ বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানের বই। কী বলা যাবে ? বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল এসব তো আছেই। তা-ও যদি শিশুর মস্তিষ্কের উপযোগী হ’ত তাহলেও কোনও ব্যাপার ছিল না। এছাড়া হাতের লেখা, ছবি আঁকা এসবও আছে। একেবারে নির্মম বাস্তব।
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ছে। একটি সেমিনার আয়োজিত হয়েছে। একজন বক্তা। শ্রোতাও একজন। আসলে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরেও দেখা যায় যে, আমন্ত্রিত শ্রোতাদের আর কেউই আসেনি। বক্তা হতাশ হয়ে বললেন : ‘এত গুরুগম্ভীর একটা বিষয়। কিন্তু, শ্রোতা কেবল আপনি। কী আর বলব !’ শ্রোতা তখন বললেন : ‘আমি একটা আস্তাবলের মালিক। সেখানে সাতটা ঘোড়া আছে। আমি ওদের একসাথেই খেতে দিই। যদি কোনও দিন সন্ধ্যের সময় শুধু একটা ঘোড়াই ফিরে আসে, বাকিরা দেরি করে, তাহলে আমি আর অপেক্ষা করি না। ওকে খাইয়ে দিই।’ বক্তা ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে তার বক্তব্য শুরু করলেন। কিন্তু, ভীষণ সিরিয়াস সেই বক্তব্য আর শেষ হয় না। শ্রোতা ঝিমোয়। ঘুমে ঢলে পড়ে। বক্তা তার ঘুম ভাঙায়। আবার বক্তৃতা, আবার ঘুম। দীর্ঘক্ষণ পর যখন বক্তৃতা শেষ হয় তখন আস্তাবলের মালিক বলেন : ‘যে ঘোড়াটা ফিরে আসে আমি শুধু তার জন্য বরাদ্দ খাবারটাই তাকে দিই। বাকি ছ’টা ঘোড়ার খাবারও তাকে খাইয়ে দিই না।’
‘অসন্তোষের কারণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ‘’বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীই যে আমাদের ব্যর্থতার কারণ, অভ্যাসগত অন্ধ মমতার মোহে সেটা আমরা কিছুতেই মনে ভাবিতে পারি না।” এবং, শেষে উত্তরণের দিশা হিসেবে তাঁর এই কথাটিও স্মরণযোগ্য : ‘’যে শিক্ষা বাহিরের উপকরণ তাহা বোঝাই করিয়া আমরা বাঁচিব না, যে শিক্ষা অন্তরের অমৃত তাহার সাহায্যেই আমরা মৃত্যুর হাত এড়াইব।” আমরা কি ‘রাবীন্দ্রিক আলো’ গ্রহণ করে ‘মৃত্যুর হাত এড়াতে’ প্রস্তুত আছি ?
গোড়ার কথায় আবার ফিরে আসি। আজ অধিকাংশ অভিভাবকের কাছেই পরীক্ষায় সন্তানের সাফল্য যতটা ঈপ্সিত, তাকে প্রকৃত ‘মানুষ’ করে তোলার প্রতি ঠিক ততটাই উদাসীনতা ! যার ফলে পরবর্তীকালে আমরা হয়তো বহু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পাচ্ছি, কিন্তু তাদের স্বরূপ কেমন ? একেকটা আত্মসুখসর্বস্ব নিছক অর্থ-উপার্জনের যন্ত্র মাত্র !
প্রথাগত শিক্ষার সাথে সাথে ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্বও যতদিন পর্যন্ত অনুভূত না হবে, ততদিন এই অবক্ষয়িত পরিস্থিতির অবসানও অকল্পনীয় ! মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, ‘শিক্ষা’র অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের চরিত্র গঠন করা। শিক্ষার্থীকে ‘যথার্থ মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলা। তাকে পুঁথিগত বিদ্যার ভারবাহী গাধা গড়ে তোলা মোটেই ‘শিক্ষা’র উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে চরম চারিত্রিক অধঃপতন, এমনকি হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তির স্ফুরণও আজকাল দেখা যাচ্ছে, তার মূলে আছে এই মৌলিক বিষয়টিকে একেবারে নির্বাসনে পাঠানো !
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct