এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: রাজ্য তথা দেশের একাধিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা যখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সমাজকে বিভক্ত করে বিভেদের প্রাচীরকে মোটা করে,তখন ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনাও সেই বিভেদের প্রাচীর কে ভেঙে ফেলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে চলে। সোমনাথ বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে আল-আমীন থেকে কোচিং নিয়ে পিতাহীন শেখ ফারহান এখন হবু ডাক্তার। হাওড়া জেলার বাঁকড়ার বাসিন্দা শেখ ফারহান। চার দিদি দুই ভাই কেউই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোইনি। সবার ছোট ফারহান তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা শেখ রফিকের মৃত্যু হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেলেও বাবা মারা যাওয়ার পর কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয় পরিবার। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে হিসাব মতো ফারহানের পড়াশোনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবুও মা শেখ রিজওয়ান ২০১৫ সালে ছেলেকে নিয়ে স্থানীয় পঁচাশী হাইস্কুলে নিয়ে যান ভর্তি করাতে। বিস্তারিত জানান বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে, মায়ের করুন আর্জিতে বাবা হীন শেখ ফারহানের পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। কিছুটা চিন্তামুক্ত হলেও মেধাবী ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল মা। ২০১৬ সালে ফারহানের বিদ্যালয়ে নিয়োগ পান কম্পিউটার সাইন্সের শিক্ষক সোমনাথ বিশ্বাস। ফারহানের অসহায়ত্বের ঘটনা দাগ কাটে সোমনাথ বিশ্বাসের মনে। দিনে দিনে শেখ ফারহান বিদ্যালয়ের মেধাবীদের তালিকায় স্থান দখল করে, ফারহানের গৃহ শিক্ষক ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই যারা অবসর সময়ে ফারহানকে সহায়তা করত। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফারহানের অংশগ্রহণ এবং সাফল্য মুগ্ধ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। সরকারি প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় রাজ্যস্তরেও সাফল্য পেয়েছে সে। ২০২১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৬৬২ নম্বর পেয়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিল ফারহান। ২০২৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ৪৩৯ নম্বর পেয়েছিল সে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক সোমনাথ বিশ্বাস প্রতিটি পদক্ষেপেই নজর রাখত ফারহানের। উচ্চ মাধ্যমিক পরবর্তী সময়ে সোমনাথ বাবু ঠিক করে ফেলেন ফারহানকে নিজের খরচায় নিটের কোচিং দেবেন। খোঁজ পান আল আমীন মিশনের। ফারহানকে নিয়ে খলতপুর আল-আমীন মিশনের মেইন ক্যাম্পাসে চলে আসেন সোমনাথ বাবু। দেখা করেন মিশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এম নুরুল ইসলামের সঙ্গে। নুরুল সাহেব বিষয়টি জেনে মাত্র ৩৯০ টাকা মাসিক ফিজে বজ বজ শাখায় নিট কোচিংয়ের জন্য সুযোগ করে দেন। এক বছর কোচিং নিয়ে শেখ ফারহান এবছর নিট-এ ৭২০ নম্বরের মধ্যে ৬৫৩ নম্বর পেয়ে নজির গড়েছে। সর্বভারতীয় স্তরে ২৬৬৮৮ স্থানে রয়েছে সে। এই সম্পূর্ণ বিষয়টি আপনজন প্রতিনিধিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান ফারহানের শিক্ষক তথা অভিভাবক সোমনাথ বিশ্বাস। একেবারে শান্তশিষ্ট নিপাট ভদ্র ছেলে ফারহান তখন স্যারের পাশে বসে। ফারহানের শিক্ষক সোমনাথ বিশ্বাসও বেশ আধ্যাত্মিক মানুষ তা একেবারে স্পষ্ট, গলায় তুলসী মালা, নমনীয় আচরণ যা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। নিটে সফল হবু ডাক্তার শেখ ফারহানকে নিয়ে এদিন আল-আমীন মিশনের মূল শাখা খলতপুরে ছুটে আসেন সোমনাথ বাবু। মিশনের প্রধান এম নুরুল ইসলাম সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। এম নুরুল ইসলাম সাহেবও এই দৃষ্টান্তমূলক ঘটনায় সোমনাথ বিশ্বাসকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান এবং ফারহানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন। ফারহান ও তাঁর হার না মানা জীবনের সাফল্যের কাহিনী নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তার অভিভাবকসম শিক্ষক সোমনাথ বিশ্বাস এবং মিশনের প্রধান এম নুরুল ইসলামের প্রতি। সকলের প্রতি যে সে ঋণী তা অকপটে স্বীকার করেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ঋণ পরিশোধ চেষ্টা করবে বলেও আশাবাদী ফারহান। নিটে সাফল্য এবং প্রস্তুতির বিষয়ে ফারহান কথাই আল-আমীন মিশনের স্যারদের ছক বাধা নিয়মে সারাটি বছর নিয়ম মেনে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনা করেছি। পছন্দের তালিকায় গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করতে খুব ভালবাসে ফারহান। আগামীতে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হতে চাই সে। কারণ জানান, এই সুন্দর পৃথিবীটাকে কেউ যেন উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত না হয়। ফারহান যেমন চক্ষু বিশেষজ্ঞ হয়ে অসুস্থ মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ঠিক তেমনি সোমনাথ-ফারহানের এই কাহিনীই হয়তো পৃথিবীর ধর্মান্ধ, এক চক্ষু, অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোর চোখ খুলে দেবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct