ইস্কুলে ‘পিছিয়ে পড়া’ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষায় উন্নতির জন্য যেসব পরামর্শ সংবেদনশীল, বিদগ্ধ মানুষদের কাছ থেকে ভেসে আসে সেসব অনেকটাই সরল। পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হিসেবে সচরাচর যেটাকে চিহ্নিত করা হয় তা হ’ল, পাঠদানে শিক্ষকদের যথেষ্ট আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতার অভাব। পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের উন্নতির জন্য ‘অতিরিক্ত’ বা ‘বিশেষ ক্লাস’-এর ব্যবস্থা করার কথাও তারা বলে থাকেন। উত্তম প্রস্তাব। লিখেছেন পাভেল আখতার...
ইস্কুলে ‘পিছিয়ে পড়া’ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষায় উন্নতির জন্য যেসব পরামর্শ সংবেদনশীল, বিদগ্ধ মানুষদের কাছ থেকে ভেসে আসে সেসব অনেকটাই সরল। পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হিসেবে সচরাচর যেটাকে চিহ্নিত করা হয় তা হ’ল, পাঠদানে শিক্ষকদের যথেষ্ট আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতার অভাব। পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের উন্নতির জন্য ‘অতিরিক্ত’ বা ‘বিশেষ ক্লাস’-এর ব্যবস্থা করার কথাও তারা বলে থাকেন। উত্তম প্রস্তাব। প্রশ্ন হ’ল, সমাধানসূত্র প্রদান করার আগে ছাত্রছাত্রীদের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো কি সনাক্ত করা হয়েছে? বলাই বাহুল্য, পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের সিংহভাগই গ্রামের, যাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। তারা নিদারুণ দারিদ্র ও অপুষ্টির শিকার। মিড-ডে-মিল চালু হওয়ার আগে তাদের ইস্কুলে আসতে অনীহা কিংবা মাঝপথে ইস্কুল ছেড়ে দেওয়া একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য ছিল। এখন সেই ছবিটা বদলেছে। যারা ইস্কুলে আসছে, বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, মিড-ডে-মিল খাওয়ার পর তারা আর ইস্কুলে থাকতেই চাইছে না। কতক্ষণে বাড়ি যাবে সেজন্য তারা হয়ে উঠছে অস্থির। এদের মধ্যে অধিকাংশই সাড়ে দশটায় ইস্কুলে আসা অবধি সম্পূর্ণ অভুক্ত থাকে, আরও তিন ঘন্টা পর তারা খেতে পায়। চরম অনাহার আর অপুষ্টির শিকার হয়ে তাদের মেধার বিকাশ ভীষণভাবে বাধাপ্রাপ্ত। ওদিকে বাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ নেই। অনেকেই বাধ্য হয়ে কাজ করে, ইস্কুলে নাম-থাকলেও প্রায় বিনা পড়াশুনায় কেবল পরীক্ষার সময় ইস্কুলে আসে। আর যারা নিয়মিত ইস্কুলে আসে তাদের অধিকাংশই বইখাতাও ঠিকমতো আনে না। হাজার বকাঝকা করেও কোনও লাভ হয় না। আসলে তাদের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহটাই প্রায় শূন্যের কোঠায়, যার জন্য তাদের কোনও ‘দোষ’ নেই, ‘দোষ’ কেবল তাদের ‘অভিশপ্ত জীবনের’! মোদ্দা কথা হ’ল, অন্তহীন দারিদ্র, অনাহার, অপুষ্টি--এইসব প্রবল প্রতিকূল স্রোতে যারা প্রতিদিন সাঁতার কাটছে এবং এই অবস্থায় নির্ধারিত কয়েকটি ক্লাস করতেই যাদের ‘হিমশিম’ অবস্থা তাদেরকে আবার ‘অতিরিক্ত’ বা ‘বিশেষ ক্লাস’-এ নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? জোর করে কোনও কিছু হয় কী? ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না’--বিবেকানন্দের এই মূল্যবান কথাটা সবখানেই প্রযোজ্য। শুধু ধর্ম কেন, খালি পেটে কোনও কিছুই হয় না। এইসব কথার সত্যতা বোঝা যাবে যদি দেখা হয় যে, গ্রামের মুষ্টিমেয় ‘সচ্ছল’ ও ‘শিক্ষিত’ পরিবারের যেসব ছাত্র বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই ‘এগিয়ে’ থাকছে, তারা কিন্তু উপরে বর্ণিত সামগ্রিক ছবিটার বিপরীতে অবস্থান করে বলেই।শিক্ষকদের আন্তরিকতা বা দায়বদ্ধতা নিশ্চয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। ‘জাস্টিফিকেশন’ করার চেষ্টা নয়, এই আন্তরিকতা বা দায়বদ্ধতার অভাব কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলোতে আরও প্রকট, কিন্তু সমাজের কাছে সেটা খুব একটা ‘আলোচ্য’ মনে হয় না, যেহেতু সেখানে ‘কড়ি’ ফেললেই ‘তেল’ সুলভ! ইস্কুলে যেহেতু সেই ব্যাপারটা নেই সেহেতু সম্ভবত এই পন্থা অবলম্বন করা হয়। কিন্তু সমস্যার স্বরূপটাকে না-বুঝে কেবল ‘দোষারোপ’ করে গেলে আকাঙ্ক্ষিত সুফল কি পাওয়া যাবে? এমন নয় যে, শিক্ষকরা চেষ্টা করেন না, কিন্তু একসময় তারা চূড়ান্ত হতাশায় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কারণ, তাদের হাতে তো আর মূল সমস্যা সমাধানের জীয়নকাঠি নেই!তাহলে কি যতদিন পর্যন্ত দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না, ততদিন ওরা পিছিয়েই থাকবে? এটা একটা সঙ্গত প্রশ্ন। কিছুই কি করার নেই? অবশ্যই আছে। সেটা হ’ল, সমান্তরাল ও দ্বৈত প্রচেষ্টা---অত্যন্ত সৎ, আন্তরিক ও তৎপর চেষ্টার মাধ্যমে একইসঙ্গে দারিদ্র-দূরীকরণ ও শিক্ষাদান; যেখানে যার ভূমিকা বা দায়িত্ব তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। এই প্রত্যাশিত দ্বৈত ও অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে যতক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন বা খণ্ডিত করে দেখা হবে ততক্ষণ কোনও কাম্য সুফল দুর্লভ।
প্রসঙ্গত ‘অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা’র কথা বলা যাক। এর অনুকূলে অনেকের দ্বারা যে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষিত হয় সেটা বেশ চোখে পড়ার মতো। তারা মনে করেন যে, ভবিষ্যৎ শিক্ষায় অনলাইনই ভরসা। আজব সিদ্ধান্ত! অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই কাম্য হতে পারে না। এর কারণ, এটা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি নয়। এটা যদি ‘ভবিষ্যৎ শিক্ষা’ হয় তাহলে বলাই বাহুল্য, ‘শিক্ষার ভবিষ্যৎ’ ধুলোয় মিশে যেতে বাধ্য। অবশ্য তাতে কিছু বণিক গোষ্ঠীর প্রচুর অর্থাগমের সম্ভাবনা। সেটা প্রচার করাই আবার কিছু মানুষের অনলাইনভক্তির মর্মকথা নয়তো? তাছাড়া অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘ভবিষ্যৎ’ করে তোলা হলে মধ্যাহ্নকালীন ভোজনপর্বটি কি বিলুপ্ত হবে না? তাতে ইস্কুলছুট বাড়বে কি না সেই ভাবনা ভাবা হয় না। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে সামান্য যুক্তিবিন্যাসও আত্মঘাতী। অগণিত গ্রামের বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক পরিবারের শিক্ষার্থীদের প্রতি নাগরিক দৃষ্টিতে অবহেলা ও উপেক্ষার যে হাজার একটা নিদর্শন আছে এটা তারই অন্তর্গত। আরেকটা ‘দুর্ঘটনা’ তো এখন দেখাই যাচ্ছে। অত্যধিক গরমের জন্য ইস্কুল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা। ইস্কুল বন্ধ রাখা কোনও সমাধান নয়। গরম পড়লে সকালে ইস্কুল হতে পারে। গরমের মাত্রা কমলে ইস্কুল খুলেও দেওয়া যায়। কিন্তু, এসবের কোনওটাই হয় না। খুব দুঃখজনক। অনলাইন শিক্ষা অথবা প্রলম্বিত ছুটি-- দুটিই শহরের শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি করে না তা নয়, কিন্তু গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের শিক্ষার্থীদের ক্ষতির সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। একটু দরদী মন নিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে। দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় হল, শিক্ষায় বেসরকারিকরণ, যা একেবারেই কাম্য নয়। উত্তর-স্বাধীন ভারতবর্ষে যে-কয়েকটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, তাদের যাবতীয় বক্তব্যের মধ্যে একটি অভিন্ন সুর ছিল এই যে, সকলের জন্যে ‘অবৈতনিক শিক্ষা’র ব্যবস্থা করতে হবে। যদি শিক্ষায় বেসরকারিকরণ হয় তাহলে সর্বপ্রথম এই বিষয়টি ধাক্কা খাবে। কারণ, কর্পোরেট বণিকগোষ্ঠী বিনামূল্যে কখনোই যে শিক্ষার বন্দোবস্তু করবে না সেটা একেবারেই পরিষ্কার। একথা সকলেই জানেন, সকলেই বোঝেন। এখানে একটি বিষয় খেয়াল করে দেখতে হবে যে, দীর্ঘদিন যাবৎ সমাজের একটি বৃহৎ অংশ ইতিপূর্বেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে ধাবমান। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সানন্দে পড়াচ্ছেন। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূলত সেইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এখন পড়ে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সামর্থ্য নেই। সেটা থাকলে তারাও সেখানেই পড়াতেন। শিক্ষকদের ‘দায়বদ্ধতা’ নিয়ে সমাজে বিস্তর ‘সমালোচনা’ হয়। সেটা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে অভিভাবকদের ঝুঁকবার একটি অন্যতম ‘কারণ’ হিসেবেও চিহ্নিত হয়। অভিযোগ বা সমালোচনাটি একেবারেই যে ‘অসার’ তা হয়তো নয়, কিন্তু অবশ্যই একপাক্ষিক ও অসম্পূর্ণ। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীসংখ্যায় প্রচুর ‘ঘাটতি’ রয়েছে। পড়ানো ছাড়াও শিক্ষকদের দাপ্তরিক নানা কাজও করতে হয়। তার সঙ্গে শিক্ষাবহির্ভূত একাধিক কাজের ‘চাপ’ সামলাতে গিয়ে কথিত ও প্রত্যাশিত ‘দায়বদ্ধতা’ হয়তো ঠিকঠাক পালিত হয় না। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মিলিত ভাবের আদানপ্রদানে পর্বতসম সমস্যার কিছুটা ‘সমাধান’ হতেও পারত। সেই পথে কেউ অগ্রসর হয়নি। বরং দ্রুত বেছে নেওয়া হয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাত্রার উদ্যোগ। এসবই যদিও বেসরকারিকরণের পক্ষে কোনও ‘যুক্তি’ নয়, কিন্তু উদ্যোগটি যে এই আবহাওয়ায় ডানা মেলতে সহায়ক হয়েছে সে-ব্যাপারে সন্দেহ নেই। যদিও একটি কথা মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনও ‘লাভজনক সংস্থা’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। শিক্ষায় বেসরকারিকরণ, বিশেষত প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষার ভবিষ্যৎ’-কে যে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কথায় আছে, ‘সব কথায়’ সবসময় কান দিতে নেই। ঠিকই কথা। কিন্তু, সমস্যাটা কানের ছিদ্রপথ নিয়ে। সেটা বন্ধ থাকলে ক্ষতি ছিল না। খোলা আছে বলেই ‘সব কথা’ কানে ঢোকে এবং কিছু ‘অভিঘাত’ও তৈরি হয়। ‘উপেক্ষা’ শব্দটা ভাল, কিন্তু সেটাকে খুব বেশি আঁকড়ে ধরলে যে কথাগুলো ‘উপেক্ষা’ করা হয় সেগুলোর ‘ধার’ না-বাড়লেও কালক্রমে ‘ভার’ বেড়ে যায়; যেসব কালক্রমে ‘ধারালো’ মনে হওয়ার মতো ‘বিভ্রান্তির’ও জন্ম দেয়। দীর্ঘদিন ইস্কুল বন্ধ থাকলে সমাজ, পরিপার্শ্ব শিক্ষকদের প্রতি যেসব লাগাতার নিম্নরুচির ‘বাক্যবাণ’ নিক্ষিপ্ত করে থাকে সেসব কতটা অর্থহীন বা অযৌক্তিক, সেইসব ‘বাক্যবাণের’ সঙ্গে শিক্ষকদের একান্ত আত্মগত ‘অনুভূতির’ যে দূরতম সম্পর্কও নেই, সেসব কথা বোঝার বা উপলব্ধি করার মতো ‘পরিস্থিতি’ না-থাকার মূলে আসলে যে বস্তুটি দায়ী তা হ’ল, সমাজের সঙ্গে শিক্ষকদের ‘সম্পর্কটি’ দিনে দিনে ‘শিথিল’ হয়েছে। যেকোনও ‘সম্পর্ক’ই নষ্ট হয় একে অপরকে বোঝা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে কেবল ক্রমাগত ‘অভিযোগের ডালি’ উপুড় করতে থাকলে। একথা উভয়ের দিক থেকেই, পারস্পরিকতায় অত্যন্ত ‘সত্য’। এর সংস্কার ও নবনির্মাণ খুব জরুরি ।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct