আত্মদর্শন অপরের সঙ্গে সংযোগের সেতু ও রবীন্দ্রনাথ
পাভেল আখতার
রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার ব্যাপ্তি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। উপলব্ধি করারও কিছু নেই। তাঁর সম্পর্কে ‘নতুন কথা’ বলতে যা বোঝায় সেটাই হয়তো আর কিছু পড়ে নেই। কিন্তু, পুরনো হলেও যে-কথাটি বারবার বলতে হয় সেটি একটি বাক্যে বললে এরকম, তিনি আসলে মানুষকে ডাক দিলেন তার সত্তার ‘ভিতরপানে’ চাওয়ার দিকে। ‘বাইরের ঝলকানি’ মানুষকে ভুলিয়ে দেয় তার অন্তর্গত সত্তায় যে ‘আলোর স্রোত’ প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে তার খোঁজখবর রাখতে। রবীন্দ্রনাথ আর কিছু করেননি, কেবল নিজেকে ‘আবিষ্কার’ করতে বলা ছাড়া। এটার অভাবেই তো বিশ্বসংসারে যাবতীয় বিপত্তি। ‘নিজেকে রচনা’ করতে না-পারলে ‘পৃথিবীকে রচনা’ করার কথা ভাবাই যায় না, বরং তাকে ধ্বংস করার পথ প্রশস্ত হয়। এটাই যুগের ইতিহাস, কালের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ সেকথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধতা চাননি, প্রতিভার পুজো চাননি ; চেয়েছিলেন তাঁর মনন, তাঁর চিন্তার বর্ণালী আমরা ‘আপন’ করে নিই। কিন্তু, হয়েছে প্রথম দুটো।রবীন্দ্রনাথকে আমরা মূলত কবি হিসেবেই জানি। কিন্তু তাঁর নাম অবলম্বনে ‘রাবীন্দ্রিক’ হয়ে ওঠার যে বিশেষ প্রক্রিয়াটির কথা বলা হয়, তা শুধু তাঁর কবিতার ভুবন থেকে উৎসারিত হয় না। তা আসলে একটি সম্পূর্ণ জীবনচর্যার প্রচ্ছদ, যে জীবন মুক্ত ও ব্যাপ্ত, যা অনন্তের সন্ধানে ও সাধনায় মগ্ন থেকে অভিপ্রেত উত্তরণের দিশা দেখায় এবং ভোরের হাওয়া আর গোধূলির মায়ায় ‘মানবজন্ম’-কে মহিমান্বিত করে তোলে। ‘রবীন্দ্রমানস’ আসলে একটি মরমী, সংবেদী, পরিশীলিত জীবনবোধ বা জীবনদর্শনের প্রতিবিম্ব, যার আধার বিশ্বমানবতার প্রতি অন্তহীন প্রত্যয়। এসবের সমবায়িক চেতনার নাম--’রাবীন্দ্রিকতা’। তাঁর অগণন কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি কোনও অনন্ত অবকাশের সুখসঞ্চারী ‘অলস মায়া’ নয়, বরং তা একটি পরিশ্রুত হৃদয়ের গভীর তলদেশে জন্ম নেওয়া অখণ্ড, স্বচ্ছ মানবচৈতন্য থেকে উৎসারিত মানুষের অন্তরাত্মার ক্রন্দন, আনন্দ ও উত্তরণের শব্দতরঙ্গ। ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’--এই গভীর বোধের উচ্চারণ ছাড়া যে জীবন অর্থময় হতে পারে না তা-ও রবীন্দ্রনাথ আমাদের ‘শিখিয়ে’ গেছেন।বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ না-পড়লে, রবীন্দ্রনাথকে না-জানলে, রবীন্দ্রনাথের গান না-শুনলে কি কোনও ক্ষতি আছে? প্রশ্নটা এমনই যে, এর কোনও উত্তরই আসলে হয় না। ভাত-রুটি না-খেলে অথবা কোনও কিছুই না-খেলে কী হতে পারে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে এবং তার উত্তরও স্পষ্ট। কিন্তু, সবকিছু কি ‘লাভ-ক্ষতি’র বাটখারা দিয়ে পরিমাপ করা যায়? তবুও প্রশ্নটা যদি ওঠেও, তার একটা উত্তরও তো দেওয়া উচিত। একটু অন্যভাবে। তাতে বস্তুবাদী মানুষ কতটা সন্তুষ্ট হবে সেটা অবশ্য অজানা, তবুও বলতে অসুবিধা নেই। আচ্ছা, ‘আকাশ’ না-দেখলে কি কোনও ক্ষতি আছে? ক্ষতি হয়তো নেই, কিন্তু দেখলে যে লাভটা ছিল সেটা থেকে তো বঞ্চিত হতেই হয়। আর, সেটাও একধরনের ক্ষতিই। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই। ‘অবদান’ শব্দটা থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় রবীন্দ্রনাথকে ঠিক মূল্যায়ন করা যায় না। তিনি ‘সংস্কারক’ ছিলেন না। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ আর ‘চিত্তের মুক্তি’ সমার্থক। ‘মুক্ত চিত্ত’ না-হলে যে কিছুই হয় না, সব অর্থহীন কিংবা ব্যর্থতার আবর্জনা, সেই গূঢ়-গভীর চিন্তাকেন্দ্রে একক রবীন্দ্রনাথ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনন্য মহিমায়। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে...।’ এই উপলব্ধির বিভা রবীন্দ্রনাথই আমাদের চেতনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন।
প্রকৃতির রং সবুজ কেন? কারণ, তা প্রাণের সমারোহে উজ্জ্বল। মুক্তির মুক্ত দ্যোতনায় অনাবিল। মানুষকে দেখে দেখে আমরা বিষণ্ণ, ক্লান্ত হই ! ‘কাছের’ বলে কেউ আদৌ হয় কি না সেই সংশয়ও জাগে ! কিন্তু, প্রকৃতি আমাদের বাঁচায়--হৃদয়ের সব অশান্ত ঢেউ দূরে সরিয়ে দেয়, নিশ্চয় মুছে দেয় নিঃশব্দ বিলাপের করুণ, সিক্ত রেখাগুলি ! ‘’ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে, ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে !” অসামান্য একটি গানে কথাগুলি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। গানটি হ’ল--’আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ’। আধুনিক মানুষের ‘চিত্তের মুক্তি’ নিয়ে এত বিপুল চর্চা হয়, অথচ সেই মুক্তিপথের যথার্থ অভিমুখ ঠিক কোনটি, সেই চয়ন-ভাবনাটি মননভুবন থেকে বহু দূরেই রয়ে যায় ! উন্মুক্ত প্রকৃতি থেকে দূরে--বহুদূরে সরে গিয়ে ‘চিত্তের মুক্তিলাভ’ বা ‘মুক্তচিত্ত’ হওয়া কোনওটাই যে সম্ভব নয় সেকথা রবীন্দ্রনাথ বুঝলেও আমরা বুঝিনি। প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যকে ভালবাসা ও তাতে মুগ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে চিত্তের প্রসারতা বা মুক্তি সম্ভব নয়। সেজন্য প্রকৃতির মধ্যে আত্ম-অন্বেষণ জরুরি। ‘জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান’। সেই ‘অজানা’টা কী? একজন মনীষীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, দীর্ঘ সময়ের একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ট্রেনযাত্রায় তিনি কোন ধরনের বই পড়তে ‘পছন্দ’ করেন। এই অভ্যাসটি অনেকেরই আছে। কৌতূহলটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু, তাঁর উত্তরটি ছিল ‘অপ্রত্যাশিত’। তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলেন যে, সেসময় তিনি কোনও বই নয়, বরং প্রকৃতিকে ‘পড়তে’ ভালবাসেন !‘’এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে, সুন্দর !” রবীন্দ্রনাথেরই কথা। প্রকৃতির মতো ‘সুন্দরের সঙ্গ’ তো আমরা যথেষ্টই লাভ করি। কিন্তু, তার মতো আমরা ‘সুন্দর’ হতে পারি না কেন? তার কারণটি বোধহয় উপরে আভাসিত হয়েছে। আমরা প্রকৃতিকে ‘পড়ি না’ !পৃথিবীর যে-কোনও দেশেই ‘সংখ্যালঘু বা দুর্বলের ব্যথা’ সংখ্যাগুরু ও বলিষ্ঠ সমাজ অনুভব করতে অক্ষম। কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘু ও দুর্বল। মূলত মানবিক সংবেদনার অভাবেই উপরিউক্ত বাকবিন্যাস--আসলেই যা ‘নিদারুণ ঔদাসীন্য’, আবার ‘হিরণ্ময় নীরবতা’, দুটোই বাস্তব। রবীন্দ্রনাথের অপরূপ আরেকটি গানের কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে আমার ইচ্ছে হয়। ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে’। রবীন্দ্রনাথের এই গানটির এক জায়গায় এই কথাগুলি আছে--’সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা, সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা/ দুখিনি নারীর নয়নের নীর, সুখীজনে যেন দেখিতে না পায় !’ এই নিবিড় অভিমানের কারণ হিসেবে তার পরই বলা হচ্ছে--’তারা দেখেও দেখে না, তারা বুঝেও বুঝে না, তারা ফিরেও না চায় !’এই অনবদ্য গানটিকে যদি ব্যক্তিসীমা ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, তাহলেও তার যথার্থতা স্বীকার করতেই হবে। কীভাবে? ‘সুখী’ শব্দটিকে অনায়াসেই নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বেগ জীবনের প্রতীক হিসেবে ধরা যায়। এর বিপরীতে ঠিক তেমনই ‘দুঃখী’ শব্দটিকেও দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে দীর্ণ ও বিপন্ন জীবনের প্রতীক বলা যায়। এখন প্রশ্ন হ’ল, ‘সমাজ’ শব্দটি যদি বৃহত্তর সমষ্টিকে দ্যোতিত করে, তাহলে সুখী মানুষ কি তার নিজস্ব সুখটুকু নিয়েই কেবল বিভোর বা সন্তুষ্ট থাকতে পারে? দুঃখী মানুষের দুঃখে বিচলিত হওয়া, তার দুঃখ মোচনে সক্রিয় হওয়া সুখীজনের কাছ থেকে কি কাম্য নয়? অবশ্যই কাম্য, প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই প্রত্যাশা যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, তখন দুঃখীজনের হৃদয় থেকে গভীর এক হাহাকার অভিমানের মোড়কে এভাবেই উন্মোচিত হয় ! তাছাড়া তার আর করারই-বা কী আছে !এই ‘আত্মসুখপরায়ন সমাজ’ সজীব নয়, দস্তুরমতো মৃত এক সমাজ ! ‘মানবসমাজ’ বলা তো একেবারেই ভুল ! এই ভুলের পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, কেবলই আত্মসুখের ভেলায় চড়ে বেশি দূর যাওয়াও কিন্তু সম্ভব নয় !!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct