মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নজরুল সাহিত্য
এম ওয়াহেদুর রহমান
আমরা এমন একটি অবস্থায় উপনীত হয়েছি যে, আজ ভয়াবহ অবক্ষয়িত মূল্যবোধের ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন। এই সমাজ না সামাজিক, না মানবিক, না স্বাভাবিক। আমাদের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার তথা নৈতিক মূল্যের সূচক নিম্নস্তরে। কিন্ত একটি জাতির অগ্ৰগতির পাশাপাশি নৈতিক সর্বোপরি ধর্মীয় শিক্ষা, গণতান্ত্রিক, মানবিক, রাজনৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ না হলে সেই দেশ কখনো অগ্ৰগতির শিকড়ে আরোহণ করতে সক্ষম হয় না। আমাদের জীবনের চলার পথে কোন পেশায় মূল্যবোধে নিরপেক্ষ নয়। এই মূল্যবোধ ব্যাক্তি ও দলগত মানুষের অনুশীলিত আচরণবিধি। মূল্যবোধের অভাবে সমাজে - দেশে অনৈক্যের সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় অবক্ষয় তথা বিশৃঙ্খলার। মনুষ্য সমাজের মাঝে আজ ও শ্রেণি বৈষম্য প্রকট, মেহনতি মানুষের উপর শাসন - শোষণ অব্যাহত। ধর্মান্ধতা ও রক্ষণশীলতা মনুষ্য সমাজকে আচ্ছন্ন করেছে। সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধির হিংস্র থাবা মেলছে, লুটেরা রাজনীতি, ক্ষমতার দৌরাত্ম্য, সন্ত্রাসের আধিপত্য দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলস্বরূপ মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটছে। এই অবস্থায় কাজী নজরুল ইসলামের রচনা থেকে আমরা সংকটের সমাধানের পথ খুঁজে পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবী ব্যাপ্ত হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবেশে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে কাজী নজরুল ইসলামের উজ্জ্বল আবির্ভাব। তাঁর কবি মানসের শিকড় প্রোথিত ছিল নব জাগ্ৰত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেনির মানস মৃত্তিকায়। রাজনীতি সচেতনতা ও জন মূল - সংলগ্নতা নজরুলের কবি চৈতন্যে এনেছিল নতুন মাত্রা। বাংলা সাহিত্য - সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ, যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কালজয়ী প্রতিভা ও জীবন দর্শন, মানবিক মূল্যবোধের স্ফুরণ, সমৃদ্ধশালী লেখনী বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তিনি কেবলমাত্র জাতীয় কবি নন, তিনি জাগরণের কবি, সাম্যের কবি। তিনি শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, কুসংস্কার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তাঁর লেখনিতে। তিনি সমাজে যে অনিবার্ণ প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলেন তার আলোকচ্ছটা আমাদের কে অনুপ্রাণিত করে মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে। তিনি মনুষ্য সমাজের বিরাজমান ভেদাভেদ কে নির্মলকরণের তাগিদে নির্ভিক কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যাবধান, / যেখানে মিশেছে হিন্দু - বৌদ্ধ - মুসলিম - ক্রিশ্চান।’
......... গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান / নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ - অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে / সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। ‘মানবাত্মার মুক্তিসাধনই নজরুলের সাহিত্য কর্মের কেন্দ্রিয় অন্বিষ্ট। মানুষের সামূহিক অবচেতনায় তিনি জ্বেলে দিতে চেয়েছেন মানবিকতার আলো। কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যর অঙ্গনে ‘ বিদ্রোহী কবি ‘ কিংবা ‘ জাতীয় কবি ‘ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। একথা আমরা অকপটে স্বীকার করলেও ভুলে যাই সাম্য, মানুষের মুক্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাববোস্ত তথা মূল্যবোধের প্রসারে তাঁর অবদানের কথা। স্বাধীনতার জন্যে মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দাঁড়াতে হবে, তিনি তা বারংবার তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। মানুষের প্রথম পরিচয় তার ব্যক্তিসত্বা, তারপরেই আসে জাতিসত্বা _ এগুলো সঠিক ভাবে বিকশিত হলেই ঘটবে মূল্যবোধের বিকাশ। তিনি নারী- পুরুষ, হিন্দু - মুসলমান-- সবার ব্যক্তিক ও সমষ্টিক স্বাধীনতার কথা নজরুল ইসলাম বলেছেন। তাঁর সাহিত্যে ফুটে উঠেছে সম্প্রদায়গত মিলন, মানুষের মুক্তি, নারী ও পুরুষের সমতা, মানুষের স্বাধীন সত্তা। হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক দুই শক্তি। তাই তিনি বলেছেন, ‘ কাটিয়ে উঠেছি ধর্ম - আফিম - নেশা, ধ্বংস করেছি ধর্ম- যাজকী - পেশা / ভাঙি মন্দির ভাঙি মসজিদ, ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত এক মানবের একই রক্ত মেশা /কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেসা। ‘কখনো তিনি আবারও বলেছেন, ‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র। ’‘ জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত- জালিয়াৎ খেলছে/জুয়া ছুঁলেই তোর জাত যাবে ? জাত ছেলের হাতের নয় কো- মোয়া। ’ ‘ মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন মনি, হিন্দু তাহার প্রাণ। ’তিনি নারী ও পুরুষের সমানাধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। ’‘ নারী এনেছে শান্তিময় রাত, প্রশান্তিময় বাতাস আর মেঘ/ মানুষ আসে মরু- তৃষ্ণা নিয়ে; মহিলা মধু পান করে। /মানুষ উর্বর জমি চাষ করে; মহিলা তাতে ফসল বপন করে সবুজ করে। ’
যুগে যুগে প্রগতিবাদী ও বিপ্লবী কণ্ঠ উচ্চারিত না হলে মানব সমাজে শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন নিপীড়নের শোষণে বিচূর্ণ ও বিপর্যস্ত হয়ে যেত। তচনচ হয়ে যেত সমাজ তথা সভ্যতার মূল্যবোধ। ভেঙে পড়ত সমাজ ব্যবস্থা। কেননা শোষক, শাসক, নিপীড়কেরা শুধু নিজেদের স্বার্থ ভালো বুঝে। আর সে স্বার্থ উদ্ধার করতে যে কোন স্বেচ্ছাচার বা অপকর্ম করতে তারা দ্ধিধা করে না। নতুন সৃষ্টির সাধনা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের শিল্পীসত্তার মূল প্রেরণা ও প্রবণতা। আর সেই জন্যেই সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প সর্বক্ষেত্রে পুরাতন ধ্যান -ধারণা ও মূল্যবোধ ভাঙার জন্যে তিনি বিদ্রোহী। তাঁর ঘোষণা, ‘ সংগ্ৰামে আমি ক্লান্ত, আমি মহা বিদ্রোহী, /আমি তখনই শান্ত হব যখন আমি / নির্যাতিতদের করুন আর্তনাদ থেকে আকাশ বাতাস মুক্ত পাবে। ’ তাঁর কবিতা, গান মানুষকে সব সময় অনুপ্রেরণা দেবে। বিশ্বের যে কোন পরিস্থিতিতে তাঁর ভাবাদর্শন মানুষ অনুসরণ করবে। এর মধ্য দিয়েই কবি অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর সাহিত্য সম্ভারে নানাবিধ মূল্যবোধ ও নানান ধরনের ভাবদর্শন বিদ্যমান। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা শোষকের বিরুদ্ধে, জুলুমের প্রতিবাদে, বন্দি, কারারুদ্ধ মজলুমের বা বিপ্লবী শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত আহ্বান। দেশে দেশে বিপ্লবী, প্রতিবাদী, সংগ্ৰামী কবিদের কবিতা যখন আমরা পড়ি, এমনকি দেশের জন্য আত্ম উতসর্গ কারী বা ফ্যাসিবাদের বলি হওয়া কবিদের ও আমরা যখন দেখি, তাদের সবার মধ্যে নজরুলের তুল্য এমন দ্রোহী, মুক্তিকামী কবি আর একজনকে ও খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বলেছিলেন, ‘ আকাশ -বাতাস- চন্দ্র- তারায় সাগর জলে পাহাড়- চূড়ে। /আকাশ সীমার বাঁধন টুটে/দশদিকেতে পড়ব লুটে, / পাতাল ফেড়ে নামব নিচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে, /বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে। ’ ‘ দেখব এবার জগৎটাকে / কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। ’ তিনি আমাদের গর্ব ও অহংকার। তিনি ছিলেন মানবিক মূল্যবোধের কবি। নজরুল ইসলাম যেমন মুসলিমদের জন্য সংগীত রচনা করেছেন, ‘ তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে / যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে। ’ তেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য ও লিখেছেন, ‘ আমার কালো মায়ের পায়ের নিচে/ দেখে যা আলোর নাচন ; / মায়ের রুপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব / যার হাতে মরন বাঁচন .....’ নজরুল ইসলাম মানুষ দ্বারা মানুষের উপর শোষণ - শাসন ও নিপীড়ন দেখে গভীর মর্মাহত হয়ে ব্যথিত হৃদয়ে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘ বন্ধু গো! আর বলিতে পারি না, বড় বিষ জ্বালা ঐ বুকে, /দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে/ রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, / তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা। ’ এছাড়াও তিনি জেহাদি কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ মহা-বিদ্রোহী রণ- ক্লান্ত --/ আমি সেই দিন হব শান্ত / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন - রোল আকাশ বাতাসে ধ্বনিবে না। ’সকল মানুষ সমান ভাবে, শান্তিতে বসবাস করতে পারবে - এই মন্ত্র আমরা কেবলমাত্র কাজী নজরুল ইসলামের নিকট থেকেই পেয়ে থাকি। তাঁর কবিতা, গানে ভালোবাসা ও মানবিক সখ্য, মূল্যবোধ - সবকিছু রয়েছে। ফলে তাঁকে কিংবা তাঁর সাহিত্য কে চর্চা করা মানে একটা মানবিক সমাজ নির্মাণের দিকেই যাত্রা করা। আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি প্রগতিশীল, গণতন্ত্রকামী সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আন্দোলনে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা আজ ও রয়েছে। আজকের দিনে ও বিশ্বে চলমান মানবতার সংকট, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ সত্ত্বেও নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধির এই প্রবনতা থেকে মুক্তি পেতে নজরুলের অমর বাণী সমৃদ্ধ কবিতা পাঠের বিকল্প নেই। তিনি যে মানবতাবাদী মূল্যবোধ গুলো তুলে ধরেছিলেন তা সর্বজনীন গ্ৰহনযোগ্য এবং সকল মানুষ কে আকৃষ্ট করে। এই কারণে তাঁর রচনা গুলো প্রতিরোধ মূলক কার্যকলাপের জন্য ব্যাবহারিক যন্ত্রে পরিণত হয়। অর্থাৎ ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানবিকতা, মুল্যবোধ, ভালোবাসা কে যিনি বেঁধেছেন একই সুতোয়, সেই কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য অনুপ্রাণিত করবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। তাঁর কবিতা কুশলতার সঙ্গে রচিত। তাতে ও আছে পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর কবিতার সর্বকালীন আবেদনের মূলে রয়েছে প্রগাড় মানবতাবাদ। তা মূর্ত হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতিতে, দুঃখি মানুষের অসহায়তার আন্তরিক উপলব্ধিতে এবং শোষিত - নির্যাতিত মানুষের জন্য প্রবল সহমর্মিতায়। চিরন্তন মূল্যবোধের প্রতি অনুরাগী কবি তাই সত্য কে সত্য বলেছেন, আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। নজরুল ইসলাম অনায়াসেই বলেছেন, ‘ যে বাঁশি আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে, তার জন্য দায়ী আমি নই, দোষ আমার ও না, আমার বীণার ও নয়, দোষ তাঁর, যিনি আমার কণ্ঠে তাঁর বীণা বাজান। ’ তাঁর কবিতা, গান আজ ও আমাদের চলার পথে বিশেষতঃ মূল্যবোধকে সঠিক ভাবে প্রস্ফুটিত করার ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে পাথেয় হয়ে থাকবে। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘ আমি মহান বিদ্রোহী / হে দারিদ্র্য, তুমি আমাকে মহান করেছো ...../ তোমার অভিশাপ আমার বেহালাকে তলোয়ারে পরিণত করেছে ....। ’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct