সপ্তম শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইসলামি পণ্ডিতবর্গ বহুল আর ব্যাপক ইতিহাস চর্চার মারফত বিশ্বসভ্যতার ক্রমবিকাশের পরিচয় সভ্য দুনিয়ার সামনে পেশ করে রেখেছেন। সেই সব খ্যাতি যশে সিক্ত অনন্তজীবী আর অবিনশ্বর ঐতিহাসিক বর্গের কথা এখনও অনেকেরই অজানা রয়ে গেছে। ইসলামধর্মী বিদ্বৎসমাজের প্রখর ইতিহাস সচেতনতা ও তাদের সন্দর্ভ গবেষণার ফসল সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বকে। সেই সব ঐতিহাসিক কয়েকজন মনীষীতুল্য বিদ্বানের জীবন আলেখ্য তুলে ধরেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
বিধবা-বিবাহ সমাজে স্বীকৃত ছিল না। তৎকালীন মন্দিরগুলোও ছিল ‘জনপদবধূ’ বা বারবনিতাদের দ্বারা ভর্তি। আদতে বিধবাবিবাহর প্রচলন না থাকার কারণেই গণিকাবৃত্তির উদ্ভব ঘটে। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জনগণের ভগবানও ছিল অজস্র। অবশ্য আলবেরুনি একথাও বলেছেন যে শিক্ষিত বিবেক সম্পন্ন হিন্দুরা ‘God is in the Singular number’ এই একবচনাত্মক তত্ত্বাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আলবেরুনির রচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি সে এতদ্দেশীয় ব্রাহ্মণরা অর্থদণ্ড থেকে মুক্ত ছিলেন। সামাজিক বৈষম্য প্রখরভাবে জনজীবনকে গ্রাস করেছিল।আলবেরুনি এবং ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজের মধ্যে ‘মাধ্যম ভাষা’-র অনুপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এমন একটি বিশাল সমাজ, রাষ্ট্রিক চিন্তন সংক্রান্ত গ্রন্থ রচিত হয়েছিল সে এক অবিশ্বাস্য প্রহেলিকা। রাজকীয় আরবি ভাষায় গ্রন্থখানি রচিত। ফারসি ভাষায় পরবর্তীতে অনুদিত হয়। সত্যসন্ধানী মহাপণ্ডিত-দার্শনিক আলবেরুনি ১০৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন। প্রখ্যাত সাহিত্যক ড. সৈয়দ মুজতবা আলি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে ছ’জন পণ্ডিতের নাম উচ্চারিত হলে আলবেরুনির নাম অবশ্যই উঠে আসবে। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা আবু রিহান আলবেরুনিকে সভ্যতার আলোকবাহী ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন।১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার টিউনিসে জন্ম হয়েছিল, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আর সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশিষ্টতম ইবনে খালদুন-এর। অসাধারণ মনীষী ইবনে খালদুন ইতিহাস বিজ্ঞানের জন্মদাতা। চতুর্দশ শতাব্দীতে সমাজনীতি, রাজনীতি অর্থনীতিতে অমূল্য অবদান রেখেছিলেন আফ্রিকার এই মনীষী ইবনে খালদুন। (তথ্যসূত্র: সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পৃঃ ৩০৮)ইবনে খালদুন ঐতিহাসিক এবং মহাজ্ঞানী দার্শনিক হিসেবে দামাসকাস-এর বিচারপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর রচিত বিশ্ববিশ্রুত ইতিহাস গ্রন্থখানির নাম ‘তারিখ এবনে খালদুন’। জনৈক ইতিহাসবেত্তা মন্তব্য করেছেন যে বিশ্বের সমস্ত ইতিহাসগ্রন্থ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও ইবনে খালদুন-এর ইতিহাস গ্রন্থের সাহায্যে পুনরায় একখানি তথ্যবহুল ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হবে। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভাবধারার সৃজন করেছিলেন তিনি। এই সময়ের আর একজন খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক ইবনে খালেকান। তিনি অরবেসা নামক একস্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ‘ওয়াকিয়াত-উল-আয়ান’ নামে আরবি ভাষায় একখানি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় এই তিনি প্রথিতযশা কবি আবার বিজ্ঞানীও বটে। ‘ওয়াকিয়াত-উল-আয়ান’ ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে। ইবনে খালেকান-এর জন্ম হয়েছিল ১২০০ (বারোশত) খ্রিস্টাব্দে ১২ সেপ্টেম্বর। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কর্মময় জীবনের অবসান হয়েছিল।নিজামি কবি ঐতিহাসিক। কবিতার আকারে ‘সেকেন্দার নামাহ’ রচনা করেছিলেন। আরও দশখানা কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এই বাবদে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তাঁকে ১৪ খানি গ্রামের খাজনা আদায় ও সংগৃহীত অর্থ ব্যয়ের অধিকার দিয়েছিলেন।মাসাউদি একজন ভ্রমণপিপাসু ঐতিহাসিক। ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুস্তান’ ভ্রমণে আসেন। ভারত ভ্রমণ শেষে চিন ও সিংহল গিয়ে পৌঁছন। তাঁর নির্মিত ‘মদান-উল-জওয়াহির’ তিনখণ্ডে বিভক্ত প্রথম খণ্ডটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ড. স্পেঞ্জার (Sprenger)। ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাসাউদির জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।রাশিদ-উদ-দীন-আমির যশস্বী চিকিৎসক ও ইতিহাসবিদ এর জন্ম ১২৪৭ খ্রিস্টাব্দে। ‘জজমা-উৎ-তোয়া-রিখ’ নামক ইতিহাস আর সমাজ চিত্রণ-এর গ্রন্থটি তাঁর রচনা। যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়ে পারস্যের সুলতান-এর পারিবারিক চিকিৎসকের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সুলতান তাঁর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ‘ওয়াজির’-এর পদে বহাল করেন। মন্ত্রিপদ-এর দায়িত্ব আর চিকিৎসা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস চর্চা আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণাধর্মী লেখাতেও তাঁর অশেষ দক্ষতা প্রমাণিত।বহু আলোচিত মোরিস ভ্রমণকারী ইবন বতুতা সভ্যতার ইতিহাসে এক বর্ণময় ব্যক্তিত্বের নাম। তাঁর মতো ‘চেকার্ড লাইফ’-এর মনীষী সে যুগে প্রায় বিরল ছিল বলা যেতে পারে। তিনি ‘কিতাব উল রাহলাব’ শীর্ষক যে গ্রন্থখানি দুঃসাহসের ওপর ভর করে নির্মাণ করেছিলেন তা তামাম দুনিয়ার পণ্ডিতবর্গের কাছে ‘রিহালা’ নামে সুপরিচিত হয়ে রয়েছে। ইউরোপীয় প্রায় প্রত্যেকটি ভাষাতেই গ্রন্থটির অনুবাদ হয়েছে। বহুল পঠিত এমন ‘Travelogue’ প্রায় ক্ষেত্রে অপ্রাপনীয় হয়ে থাকে। ‘রিহালা’ আরবি সাহিত্যের অমূল্য ‘ট্রেজার’। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর ভ্রমণ শুরু করেন। উত্তর আফ্রিকা, আরব, ইরান, কনসট্যান্টিনোপল ঘুরে ‘মাভেরিক’ ইবন বতুতা হিন্দুস্তান-এর সিন্ধু অঞ্চলে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১২ সেপ্টেম্বর পৌঁছন। দীর্ঘ ৯ (ন’ বছর) তিনি প্রত্যক্ষত অর্জন করলেন বিস্তীর্ণ এক জীবন অভিজ্ঞতা। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দশ বছর তিনি এই উপমহাদেশে অতিবাহিত করেছিলেন। আদর্শবাদী সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলক ইবন বতুতাকে প্রভূত সম্মান আর প্রধান কাজির পদে নিয়োগ করেছিলেন। আট বৎসরকাল কাজে ব্যাপৃত থাকার মধ্যেই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন প্রণালীর কারণে কারারুদ্ধ হন। কিছুকাল পরে মুক্ত হলে তাঁকে রাজদূত হিসেবে চিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় (১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তী অংশ আগামী সপ্তাহে
মালদ্বীপ অঞ্চলে বছরখানিক অবস্থান করেছিলেন। সেখানেও ‘কাজি’র দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহলে পৌঁছন। সেখান থেকে ফিরে হিন্দুস্তান-এর মাদুরা অঞ্চলে অবস্থান করেন। এমন ‘অ্যাডভেঞ্চারাস একসপ্লোরার’ ইবন যে আধুনিক কালের বহু উপাদান তাঁর যাপন প্রণালীতে দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠেছে। মাদুরা থেকেই পবিত্র এবং অবশ্যপালনীয় ‘হজ’-এর জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেও মান্যজনদের সাহচর্যে কিছুকাল অতিবাহিত করে স্বদেশ-স্বভূমি মরোক্কা-তে ফিরে যান (১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে)। আজকের দিনে ভ্রমণের বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে বলা হয়ে থাকে, যেন পায়ের তলায় সরষে। বতুতা-র ক্ষেত্রেও বিষয়টির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বদেশে ফিরে আবার তাঁর যাত্রা হল শুরু। এবার গন্তব্য মধ্য আফ্রিকা। মধ্য আফ্রিকা থেকে নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে মরোক্কো-তে প্রত্যাবর্তন করলেন। ১৩৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ কিংবা ৭৪ বছর বয়সে জীবনের শেষতম ‘মঞ্জিলে’ তিনি পৌঁছে গেলেন। এমন চাঞ্চল্যকর জীবনযাপন সেই কালে ভাবলেও বিস্ময়াবিষ্ট হতে হয়। বতুতা প্রকৃষ্ট অর্থে একজন বহুদর্শী-ভূ্য়োদর্শী বিদ্বান ব্যক্তি।আরবি ভাষায় রচিত ‘রিহালা’ গ্রন্থে তুঘলক আমলের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বিষয়ের ওপর অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। তাঁর গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। নিখিল বিশ্বের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের কাছে ইবন বতুতার নাম অমর হয়ে রয়েছে। ইবন বতুতার সমসাময়িক ঐতিহাসিক শাহাবুদ্দিন। দামাসকাসের সন্তান। মুহাম্মদ তুঘলকের শাসনকালে দীর্ঘকাল শাহাবুদ্দিন এদেশে অবস্থান করেন। বিভিন্ন শাস্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ ছিল। ‘মাসালিক-উল-আবসর’ তাঁর রচিত চিত্তাকর্ষক এক ভ্রমণকাহিনি। মুহাম্মদ-বিন-তুঘলকের শাসনকালের এবং তাঁর রাজসভার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় ‘কিতাব’টিতে। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কেও আভিজাত্য আর সম্ভ্রমও গাম্ভীর্য বজায় রেখে চমকপ্রদ বর্ণনা পেশ করেছেন জনাব শাহাবউদ্দিন। তৎকালীন সমাজের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি সম্পর্কেও তাঁর উপলব্ধি খোলাখুলি ব্যক্ত করেছেন। তাঁর রচনা থেকে মুহাম্মদ বিন তুঘলক-এর রাজসভার একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য উল্লেখ করা যাক: অতীব উচ্চরুচির মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভায় এক হাজার কবি (১০০০), বারো শত গায়ক (১২০০) এবং এক হাজার হাকিম (১০০০) বা চিকিৎসক ছিলেন।মুঘল আমলের বিদ্বৎসমাজের কাছে আবুল-ফজল ‘আইকন’ হিসেবে বিবেচিত হতেন। তাঁর সম্পর্কে আধুনিক ইউরোপের পণ্ডিতবর্গ (যাঁরা ভারতেতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল) মন্তব্য করে থাকেন যে, তিনি মুঘল ভারতের একজন ‘Great Savant’ যথার্থ মূল্যায়ন। সীমাহীন জ্ঞানচর্চার মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন আবুল ফজল। একটি বাক্যের মধ্যে তাঁর পরিচয়টি তুলে ধরা যাক। তিনি ঐতিহাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সমালোচক সর্বোপরি তিনি একজন পূর্ণ লেখক। ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। ড. ভিনসেন্ট স্মিথ, তাঁকে ফ্রান্সিস বেকন-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বহুধা বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের বিস্তৃতি ছিল ছড়িয়ে। প্রতিটি আলোচনা, ডিসকোর্স গভীরজ্ঞান আর পরিণত চিন্তার ফল। প্রাচ্যদেশে এমন মনীষীর আবির্ভাব ক্বচিৎ-কদাচিৎ লক্ষ্য করা গেছে। অধ্যাপক ইরফান হাবিব বাদশাহ আকবরের শাসনকালকে যে আধুনিক ভারতের সূত্রপাতের প্রাথমিক কেন্দ্র বা বিন্দু বলে বিবেচনা করেন, তাতে আবুল ফজলের উপস্থিতি আর অবস্থানকেও মনে রাখতে হবে কেননা আবুল ফজলের চিন্তাচর্চার মধ্যে মানুষকে মূল্য এবং মর্যাদা আরোপের প্রসঙ্গ রয়েছে। স্থবির রীতি-নীতিকেও আবুল ফজল সমর্থন করতেন না। উপরন্তু সম্রাট আকবর যে নানান ‘বাহাস’ বা বিতর্ক সভার আয়োজন করতেন তাতে প্রত্যেকটি ধর্মের বোদ্ধাবর্গের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগও ছিল। এই বিষয়টি আধুনিকতার লক্ষণ বহন করে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত জ্যাকব বুকহাডর্ট ‘মানুষকে আবিষ্কার’ (Discovery of man) করা আর প্রশ্ন উত্থাপন করার বিষয়টিকে আধুনিকতার উপাদানবাহী বলে বিশ্বাস করেন। মহামতি আবুল ফজল এই ধারারই একজন চিন্তক পুরোগামী ইতিহাসবেত্তা ও দার্শনিক। তাঁর লেখার সততা, পাণ্ডিত্যপূর্ণ সৌন্দর্যের অতুলনীয়তা আমাদের আজও বিস্মিত করে। এই উপমহাদেশের মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চ গুণমানসম্পন্ন মাদ্রাসাগুলোতে তাঁর নির্মিত সাহিত্য রাজি আজও এখনও পাঠ্যসূচির অর্থাৎ ‘সিলেবাস’-এর অন্তর্ভুক্ত। সুফিবাদের অনুরাগী, সত্যের প্রতি প্রগাঢ় আর অমলিন বিশ্বাস তাঁর চিন্তাধারাকে শ্রদ্ধা আর সমীহযোগ্য করে তুলেছিল। ব্রিটিশ সমাজতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক ব্লকম্যান-এর নিরীক্ষণ হল এই রকম: আবুল ফজলের লেখাই ঘৃণা, অবিশ্বাস, সংশয় আর সামান্য কোনও নোংরামিও দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠেনি।
আবুল ফজলের মহান দুই সাহিত্যসৃষ্টি ‘আকবরনামাহ’, আর ‘আইন-ই-আকবরি’ তে বাদশাহ আকবরের শাসনকালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সমাজ আর দেশ-দশের অবস্থা, আর্থিক আর রাজনৈতিক অবস্থা বা তার ক্রমবিকাশ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার চর্চা, সমীক্ষা-বিচার-বিশ্লেষণ সবিশেষ প্রাধান্য আর গুরুত্ব পেয়েছে। বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার মধ্যেও সৌজন্য আর নম্রতার প্রকাশ, শিষ্টাচার লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক ঈশ্বরীপ্রসাদ, আবুল ফজলের সাহিত্য সৃষ্টি সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন এইভাবে- ‘হিজ প্রোজ ইঝ ভিগোরাস, এলিগান্ট য়্যাল্ড ফ্রি ফ্রম সোলেসিজম’। মুঘল জমানার বিশিষ্ট ‘স্টেটসম্যান’ আবদুল্লাহ উজবেগ রসিকতা করে আকসার বলতেন, ‘আমি আকবরের তরবারিকে ভয় ভীতির মধ্যে রাখি না। কিন্তু আবুল ফজলের কলমকে নিয়ে আমার ভয়-ডর দুটোই আছে। বুঝলেন জনাব।’ রাজসভার পণ্ডিতবর্গ উজবেগের রসিকতা বেশ উপভোগ করতেন। এর চেয়ে চমকপ্রদ আর কোনও প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করার অবকাশ রাজনীতিবেত্তা আবদুল্লাহ বেগ রাখেননি। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দের ২২ অগাস্ট, আবুল ফজলের তারিফদার বর্গ তাঁকে ‘আখরি সালাম’ জানাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। এমনতর সময়ে আবুল ফজলের মৃদু উচ্চারণ ‘আল-বিদা-দোস্ত’!আকবরের আমলের অতি বিশ্বস্ত এবং প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিন একজন রুচি-মার্জিত আর বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে সম্মানিত হতেন। তাঁর প্রধানতম বৌদ্ধিক সৃষ্টি হল ‘তবকত-ই-আকবরশাহি’। নিজামউদ্দিন ভারত ইতিহাস চর্চার সময় নির্ধারণ করেছিলেন আফগান শাসক সবুক্তিগিন-এর রাজত্বকাল থেকে আকবরের শাসনকাল পর্যন্ত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে শহর লাহোরে সমাধিস্থ করা হয়।আবদুল কাদের বদায়নি মুঘল ভারতের একজন বহুমান্য পণ্ডিত, স্কলার। ইতিহাসচর্চার বিষয়টিকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই উপমহাদেশের যথার্থ ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী একজন গবেষক। জ্যোতির্বিদ, সঙ্গীত, ইতিহাস বিষয়ে লক্ষণীয় দক্ষতা তিনি দেখিয়েছিলেন। ‘মুন্তাখাব-উৎ-তোওয়ারিখ’ নামক গ্রন্থখানির জন্যই তিনি অনন্তজীবী হয়ে থাকবেন। বদায়ুনির গবেষণাটি চার ভাগে বিভক্ত। প্রথম পর্যায়ে গজনীর শাসক, দ্বিতীয় পর্যায়ে দিল্লির ‘স্বাধীন শাসক’, তৃতীয় অংশে পুরুষ সিংহ জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর’ এবং হুমায়ূন-এর রাজত্বকালের বর্ণনা দিয়েছেন। চতুর্থ অংশে আকবরের রাজত্বকালের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। উপরন্ত সেই সময়ের বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির জীবনীও তিনি রেখেছিলেন। তিনি সম্রাট আকবরের ব্যক্তিজীবনের দোষগুণ অকপটচিত্তে লিখে রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে মুঘল রাজসভা একজন মহান মনীষী আর প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিক হারিয়েছিল।মোহাম্মদ কাজিম শাহ ফেরিস্তা হিন্দুস্তানি ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তিনি’ ফেরিস্তা’ নামেই আধুনিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে পরিচিত। তিনি বিজাপুর-এর শাসক ইব্রাহিম আদিল শাহর অনুরোধে ইতিহাস রচনা করতে শুরু করেন। তাঁর একখানি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘এব্রাহিমি-নৌসরনামাহ্’। তার ‘তারিখ-ই-হিন্দুস্তান’ ইতিহাস সাহিত্যের সার্থক নিদর্শন। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ডো মন্তব্য করেছেন, তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যেমন পক্ষপাতহীন ছিলেন রাজনৈতিক তোষামোদ অথবা ভয় সম্পর্কেও অনুরূপ ছিলেন।মুর্শিদাবাদের নিজামত আমলের ঐতিহাসিকবর্গ মুঘল জামানার দুর্যোগকালের ইতিহাস লিখে গেছেন এঁদের মধ্যে ‘রিয়াজুসসালাতিন’ এর লেখক গোলাম হোসেন সলিম বিশিষ্টতার দাবি রাখেন। সলিম ছিলেন মালদহের ডাক-বিভাগীয় কর্মচারী জর্জ উড়নি’-র মুনশি। মুনশি থেকে ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত হন। ইতিহাসচর্চায় তাঁর দক্ষতা স্বীকৃতি পেয়েছিল।এই ‘যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক মহাপণ্ডিত সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতাবায়ি রচিত ‘সিয়ারউল-মুতাখখিরিন’ অর্থাৎ ‘সমসাময়িককালের প্রতি দৃষ্টিপাত’ কে নিঃসন্দেহে অসাধারণ কৃতিত্ব পূর্ণ অর্থাৎ ‘মনুমেন্টাল’ সাহিত্যকর্ম বলা যায়। ফারসি ভাষায় তিনখণ্ডে রচিত এই সুবিশাল গ্রন্থে আছে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজীবের মৃত্যুর পরে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম পর্যন্ত ভারতে রাজত্বকারী সাতজন মোগল সম্রাটের ইতিহাস। সেই সঙ্গে আছে সেই সময়ের বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা এই তিন সুবার ইতিহাস।’ নবাবি আমলের সেই বিস্তারিত ইতিহাসে বিশেষভাবে বর্ণিত আছে পলাশির যুদ্ধ নামক প্রহসনে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পরাজয় এবং বাংলার স্বাধীনতাকে সাম্রজ্যবাদী ইংরেজ কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার করুণ কাহিনি। বাংলায় ইংরেজদের প্রাধান্য এবং হতভাগ্য সিরাজউদদৌলাহ আর সুজাউদ-দৌলাহ-র পারিবারিক জীবনের নানা কিসিমের বর্ণময় উপস্থাপনা। এই সুবিখ্যাত আর সুবিশাল গ্রন্থখানি বাংলার ইতিহাসের জন্যই ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ফারসি ভাষায় ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনখণ্ডে রচিত হয়েছিল সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন।
প্রাসঙ্গিক কয়েকটি তথ্যের সংযোজন
‘মূল ফারসি থেকে সেই ইতিহাস (সিয়ার উল মুতাখখিরিন), বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন, ---বহুভাষাবিদ ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জনাব আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।’ অনুবাদের এই অংশটি তিনটি খণ্ডের সমাহার নয়। জনাব যাকারিয়া শুধুমাত্র বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অংশটুকু বঙ্গানুবাদ করেছেন। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯০৪ (ন’শো চার পৃষ্ঠা)। গ্রন্থটির ফারসি পাঠের ৩০১ (তিনশো এক) পৃষ্ঠা থেকে ৮৪৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শুধুমাত্র জ্ঞানগতভাবে, কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি’তে সযত্নে রক্ষিত আছে। জনাব যাকারিয়া ঢাকা (বাংলাদেশ) থেকে গত শতকের নয়ের দশকের শুরুতে কলকাতায় আসেন এবং মওলানা আজাদ কলেজের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো ড. আবদুস সোবহান-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রসঙ্গে বলে রাখা জরুরি যে ড. সোবহান এবং জনাব যাকারিয়া ব্যক্তি জীবনে দুই বন্ধুও বটে। জনাব যাকারিয়া অকুণ্ঠচিত্তে স্মরণ করেছেন যে ড. আবদুস সোবহানের মদত ব্যাতিরেকে এই মহাগ্রন্থের অনুবাদ সম্ভব হোতনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি পণ্ডিত মসিঁয় রেমন্ড গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং হাজি মোস্তাফা এই নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। অনুবাদিত ইংরেজি গ্রন্থটির মারফত সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাবাতাবায়ি বিশ্বের বিদ্বৎসমাজে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।
১. কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন-- সিয়ারউল মুতাখখিরিন, সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ি (তাবাতাবায়ি), মূল ফারসি থেকে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া কর্তৃক অনুদিত সুবিশাল গ্রন্থটি এই অভাজনকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন ইসলামি চিন্তাবিদ, আর্তজনসেবী এবং প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক জনাব মহিউদ্দিন সরকার। বস্তুত এক গোছা অতীব মূল্যবান গ্রন্থ তিনি আমাকে অশেষ স্নেহসহকারে প্রদান করেছেন। কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের মওকা দিয়ে আমাকে বাধিত করেছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct