কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর লেখায় মেহনতি মানুষের কথা পড়ে দেখলেন ড. শেখ কামাল উদ্দীন...
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না,/ বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত!’ একশো দু’বছর আগে কবিতাটি লেখা। কিন্তু কবি এত বছর পরেও শান্ত হতে পারলেন কই? সমাহিত হয়েছেন বটে কিন্তু আমরা জানি না তিনি কেমন আছেন? সেখানে কি তিনি শান্তি পেয়েছেন? পৃথিবীর সাধারণ, খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের উপর উৎপীড়নকারী, অত্যাচারীর খবর যদি শুনতে পান তাহলে তো সেখানেও তিনি শান্তিতে আছেন বলে মনে হয় না! আজও ভারতবর্ষের পরিযায়ী শ্রমিকেরা শাসকের ইচ্ছেমতো কাজের ঠেলায় অস্থির। তাঁদের কাজে স্থিরতা নেই। আছে যখন তখন ছাঁটাই। আর কাজ করিয়ে দিনের পর দিন মজুরি না দেওয়া। কবি শান্ত থাকবেন কি করে?
যে সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বিশ্বসভায় ভারতের নাম উজ্জ্বল করে চলেছেন, শোনা যায় তাঁরা দিনের পর দিন ইসরোতে কাজ করেও বেতন পাননি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কুলি মজুর কবিতার কথা— “বেতন দিয়াছ? -চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/ কত পাই দিয়ে তুই কুলিদের কত ক্রোড় পেলি বল্?” যে শ্রমিক শাবল গাঁইতি দিয়ে রেলপথ বানালো, সেই রেলেই কিনা তাদের ওঠা মানা! কবি সে কথা মনে রেখে লিখেছিলেন ‘কুলি মজুর’ কবিতা। আর করোনাকালে আমরা দেখলাম শ্রমিকের বানানো রেলপথের উপর দিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া শ্রমিকের উপর দিয়ে রেলগাড়ি চলে গেল। রেলপথের পাশে পড়ে রইল ছেঁড়া চটি, খাবারের অবশিষ্টাংশ আর নিথর দেহ। একশোপঁচিশ বছর পরেও এখানেই কাজী নজরুল ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা।
কবি বরাবরই সাম্প্রদায়িকতা, জাত-পাতের ঊর্ধে থেকে নিজে যেমন জীবন যাপন করেছেন তেমনি তাঁর লেখাতেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। আজকের ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা বড্ড মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে। পরাধীন ভারতবর্ষে জাত-পাত, সাম্প্রদায়িক হানাহানির লড়াই হয়েছে কিন্তু কবি কখনোই ভগবানের কাছে জাত-পাতের লড়াইয়ের জন্য নয় বরং সাধারণ মানুষের ভাতের সঙ্গে একটু নুনের সংস্থান যাতে হয় তারই প্রার্থনা করেছেন। তাঁর কবিতার স্থায়িত্ব নিয়ে, কবিতার মান নিয়ে, কবিতার দর্শন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তার কৈফিয়ৎ কবি দিয়েছেন, সেখানে স্পষ্ট করে শিশুর কাছে স্বরাজের চেয়ে ভাতের প্রয়োজনীয়তা যে বেশি সে কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য– “ক্ষুধাতুর শিশু
চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন!/ বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন!” আর তিনি সেই সমস্ত ভেকধারী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ভগবানের কাছে নালিশ করেছেন, যারা শিশুর খুন নিয়ে খেলা করে– “কেঁদে বলি, ওগো ভগবান, তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুণ/ কেন ওঠে না’ক তাহাদের গালে, যারা খায় ওই শিশুর খুন?” তিনি আরও বলেছেন, “মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!/ হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!” কবি এই সমস্ত অত্যাচারী নেতা, যারা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খায় তাদের বিরুদ্ধে তার লেখনি যাতে আরও মজবুত হয়, অকুতোভয়ে তিনি লিখে যেতে পারেন, তার জন্য ভগবানের কাছে তিনি প্রার্থনা করে বলেন, “প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্ৰাস,/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!”
তিনি তো শুধু কবিতা লিখেই মেহনতি জনতার প্রতি তাঁর সমবেদনা জানিয়েছেন তা নয়, তাঁদের পাশে থেকেছেন, তাঁদের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন, উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, এককথায় তাঁদের সংগ্ৰামে সাথী হয়েছেন। কি করে নজরুল এমন হ’তে পারলেন? তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুজফফর আহমেদ–“জনগণের ভিতরে সে মানুষ হয়েছে। জনগণের নিকট হতেই সে প্রেরণা লাভ করেছে। লেটোর দলে সে গান গেয়েছে, তাদের জন্যে গান রচনা করেছে। এই গান শুনে আনন্দ পেয়েছে কৃষক ও মজুরেরা। রুটির কারখানায় সে মজুরি করেছে, আবার গার্ড সাহেবের বাড়িতে ভাত রেঁধেছে।” ১৯২৬-এ কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনের অধিবেশন বসে। সেই অধিবেশন থেকে প্রজাসম্মিলনী কংগ্রেসের সংসদ ছিন্ন করে এবং ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ আলাদা রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। দলের নামকরণ হয় ‘বেঙ্গল পেজ্যান্টস এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি’, ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’। এই দলের সম্মেলন উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বে লিখিত ‘কৃষকের গান’ সমবেত কন্ঠে গৃহীত হয়। নেতৃত্ব দেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেই গানে কৃষকের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে সাবলীলভাবে। কিভাবে কৃষকেরা ফসল ফলায় কষ্ট করে, আর সেই ফসল বৈশ্যের দল লুট করে নিয়ে যায়, তাও এই গানে উল্লেখ করেছেন কবি। গানটি ছিল নিম্নানুরূপ–“ওঠ রে চাষী জগদবাসী দর কষে লাঙল/ আমরা মরতে আছি ভালো করেই মরব এবার চল।/ মোদের উঠান-ভরা শস্য ছিল হাস্য- ভরা দেশ/ ওই বৈশ্য দেশের দস্যু এসে লাঞ্ছনার নাই শেষ/ ও ভাই লক্ষ হাতে টানছে তারা লক্ষ্মী মায়ের কেশ।।” তারপর তিনি সমস্ত কৃষককে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভয়-ডরহীন আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে গাইলেন, “আজ জাগ রে কৃষাণ সব তো গেছে কিসের বা আর ভয়,/ এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।”
শুধু কৃষক নয়, শ্রমিকদের নিয়েও নজরুল গান লিখেছেন। তিনি কয়ারের ভঙ্গিতে ‘শ্রমিকের গান’ পরিবেশন করেন। গানটির কয়েকটি পংক্তি এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা যেতে পারে–“ওরে
ধ্বংসপথের যাত্রীদল/ ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল।।/ আমরা হাতের সুখে গড়েছি ভাই/ পায়ের সুখে ভাঙব চল।” এই গানটি সম্পর্কে ড. অরুণকুমার বসু তাঁর ‘নজরুল-জীবনী’-তে
যথার্থই বলেছেন, “রাজনৈতিক মঞ্চে রাজনৈতিক সংগীত সংঘবদ্ধভাবে পরিবেশন করার এই রীতি সম্ভবত নজরুলেরই প্রবর্তনা।” তিনি আরও লিখেছেন, “শ্রমিকশক্তির রাজনৈতিক তাৎপর্য গানের ভাষায় অর্থবহ করে তোলা হয়েছে। সেখানেই এ গানের গুরুত্ব।” শুধু কৃষক বা হাতুড়ি পেটানো শাবল ধরা শ্রমিকের দল নয়, মৎস্যজীবীদের সম্মেলনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। আবার শুধু অংশগ্রহণ করাই নয়, নতুন রচিত গানে সুর দিয়ে সেই গান গেয়ে সম্মেলনের সূচনা করেছেন। এই সম্মেলনটি হয় ১৯২৬-এর মার্চ মাসের ১১ ও ১২ তারিখে ফরিদপুরের মাদারীপুরে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলন’-এর উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে নজরুল গাইলেন— “আমরা নীচে পড়ে রইব না আর/ শোন রে ও ভাই জেলে/ এবার উঠব রে সব ঠেলে।/ ওই বিশ্বসভায় উঠল সবাই রে/ ওই মুঠে-মজুর-জেলে।/ এবার উঠব রে সব ঠেলে।।/ ও ভাই আমরা জলে জাল ফেলে রই/ হোথা ডাঙার পরে/ আজ জাল ফেলেছে জালিম যত/ জমিদারের চরে।” এত বড় বৃত্তিজীবী সমাবেশ ও এত কবি-শিল্পীর আগমন এর আগে এদেশে দেখা যায়নি।। নজরুলের আগে কোন প্রতিষ্ঠিত কবি এমন করে জেলে-ধীবর-মৎস্যজীবীদের নিয়ে গান রচনা করে পরিবেশন করেন নি। এই গানের জন্য অনেকেই নজরুলকে অভিনন্দন জানান। ১৩৩২ এর ১১ চৈত্র লাঙলের সংবাদ থেকে জানা যায় সেদিনের সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রীপ্রতাপচন্দ্র গুহ রায় তাঁর ভাষণে বলেন, “বাঙালির অগ্নিমন্ত্রের উপাসক, তরুণ প্রাণের অরুণ আলোক-বিজ্ঞান, অগ্নিবীণার শক্তিবাদক শ্রীমান নজরুল ইসলামকে সানন্দে ভ্রাতার আদরে বক্ষে আলিঙ্গন করিয়া ধন্য হইতেছে।” এই প্রাপ্য খুব কম লেখকের ভাগ্যে ঘটে। এইজন্যই নজরুল সাধারণ হয়ে, সাধারণ মানুষের কথা বলে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct