সপ্তম শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইসলামি পণ্ডিতবর্গ বহুল আর ব্যাপক ইতিহাস চর্চার মারফত বিশ্বসভ্যতার ক্রমবিকাশের পরিচয় সভ্য দুনিয়ার সামনে পেশ করে রেখেছেন। সেই সব খ্যাতি যশে সিক্ত অনন্তজীবী আর অবিনশ্বর ঐতিহাসিক বর্গের কথা এখনও অনেকেরই অজানা রয়ে গেছে। ইসলামধর্মী বিদ্বৎসমাজের প্রখর ইতিহাস সচেতনতা ও তাদের সন্দর্ভ গবেষণার ফসল সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বকে। সেই সব ঐতিহাসিক কয়েকজন মনীষীতুল্য বিদ্বানের জীবন আলেখ্য তুলে ধরেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
সুসভ্য আর আত্মসচেতন জাতি তাঁদের নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকেন। খুব সঙ্গত কারণেই তা লিখিতভাবে সংরক্ষণের সওয়ালে যত্নবান হয়ে ওঠেন। জনৈক ব্রিটিশপণ্ডিত বলেছেন, ‘যে জাতি তার অতীত ভুলে গেছে, তার কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কারণ সে তার আত্মপরিচয় হারিয়েছে।’ এই অনুভব আর উপলব্ধির মর্মার্থ অনুধাবন করা একটি জাতির সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রশ্নে অতীব জরুরি বিষয়।ইসলামের মতো একটি বৈপ্লবিক ধর্মাদর্শের অনুসারী মুসলমানরাও তাঁদের ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে শৈথিল্যের কোনও অবকাশ রাখেননি। ইসলামধর্মী মুসলমানরাই যথার্থ আর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার পথ প্রদর্শক। অনেকেই গ্রিসের প্রসঙ্গ নিয়ে আসতে পারেন কিন্তু তাঁদের ইতিহাস চর্চাও সময়ের বিচারে আংশিক সাফল্যের নজির বহন করছে। কিন্তু ইসলামি বিশ্বের ঐতিহাসিকবর্গ তৎকালীন বিচারে সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ব্যাপক নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছেন। বিষয়টি তামাম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকবর্গের মান্যতাও পেয়েছে। ফলত ইসলামি বিশ্বের ঐতিহাসিকবর্গের এই অবদানের প্রসঙ্গটি বিদ্বৎসমাজে তর্কপ্ররোচক হয়ে ওঠেনি। খুব সম্ভব পাঠকবর্গের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারা গেছে।ইসলামি দুনিয়ার ইতিহাসবিদদের বিশিষ্টতা এইখানে যে তাঁরাই সর্বপ্রথম ধারাবাহিক ও প্রামাণ্য জাতীয় ইতিহাস রচনা করেছিলেন। ইউরোপীয় বিজ্ঞজনবর্গ মুসলমানদের ইতিহাসচর্চার জনক হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। সভ্যতা বিকাশের প্রাকৃতিক শর্ত মেনে যুগে যুগে সে সমস্ত প্রাজ্ঞ ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির মুসলমান ঐতিহাসিক শ্রেণি এসেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি স্থানীয়দের প্রসঙ্গে যৎকঞ্চিৎ আলোচনা সজ্জন পাঠকবর্গের সমীপে পেশ করা গেল।প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বালাজারি বাগদাদের এক সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাঁর শিক্ষাজীবন বাগদাদের অভিজাত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই হয়েছে। ইসলাম অনুসারীরা যখন সারা দুনিয়ায় কঠোরভাবে একেশ্বরবাদের আদর্শ, গণতান্ত্রিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম আর লড়াই করছে- তেমন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বালাজুরি ইসলামের একজন মহান, কৃতী সন্তান হিসেবে উত্থিত হয়েছেন। ‘ফুতুহ-উল-বুলদান’ ‘আরবীয়দের বিজয় কাহিনী’, নামক একখানি প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ অশেষ পরিশ্রম সহকারে রচনা করেছিলেন।
তাঁর অভিনব ও চমৎকার রচনা কৌশল পুরনো প্রকাশ ভঙ্গিকে বাতিল করে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক বালাজুরি যে তত্ত্বানুসারে তাঁর গ্রন্থটি নির্মাণ করেন সেটি সংক্ষেপে প্রকাশ করা যাক: When, Where, What, How & Repercus- sion (কখন, কোথায় কী ঘটেছিল, কেমনভাবে হয়েছিল এবং এর প্রতিক্রিয়া কী)। আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকবর্গ এই কাঠামোকে শুধু তারিফ নয়, যুক্তিসঙ্গত বলে তাঁরা এই পদ্ধতি বা ‘Methodology’কে আরও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করছেন। বালাজুরির নির্মোহ তথ্যবিশ্লেষণের বিষয়টি এবং তা পরিবেশনের অপূর্ব রীতি নিরীক্ষণ করলে তাঁকে শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। ২৭৯ হিজরিতে তাঁর ‘জীবন-জিন্দেগি’ খতম হয়ে যায়।ঐতিহাসিক হামদানি হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম সিকি অংশে আরবদুনিয়ায় জন্মেছিলেন। তাঁর ইতিহাস চর্চার বিষয় ছিল আরবের দক্ষিণাংশের জীবনযাপন প্রণালী, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা, জনগণের সমর্থন-অসমর্থন, শাসকবর্গের শাসন পদ্ধতি ও প্রকৃতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মন ও মানসিকতা এবং সর্বোপরি ইসলামি জীবনপদ্ধতির সৃজন ও বিকাশের পরিচয় বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন। জনাব হামদানি পুরনো কীর্তি ও ভৌগোলিক অবস্থা আর হাল-হকিকতের চিত্র তুলে ধরে তাঁর ইতিহাসের বয়ানকে সম্ভ্রমের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। তাঁর রচিত ইতিহাসের বিশিষ্টতা আজও স্বীকৃত।ঐতিহাসিক মাসুদি, আরব জাতির বিশ্বাস্য আর প্রমাণ্য ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর মনস্বিতার দ্বারা অর্জিত সম্পদ যেভাবে বিবৃত করেছেন তা সচরাচর লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে না। এই কিতাবটির তাৎপর্য আর অনিঃশেষ মর্যাদা এইখানে যে পুরো আরবজাতিকে দুনিয়ার সামনে একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইতিহাস গ্রন্থটি খণ্ডিত ছিল না। তাঁর সময়কাল পর্যন্ত ছিল একখানি সম্পূর্ণ বা ‘পারফেক্ট’ ইতিহাস গ্রন্থ। অসাধারণ প্রতিভাধর মাসুদির আগ্রহের বিষয়ও ছিল বহুবিধ। দর্শন, ভূগোল, গণিত, রসায়ন এবং ইতিহাস ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাঁর সাহিত্য ইতিহাস গ্রন্থগুলো লিখেছিলেন। হিন্দুস্তা, পারস্য, চিন, ইত্যবিধ দেশে তিনি হাজির হয়েছিলেন জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে। এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত, হাজারো অভিজ্ঞতা, মনুষ্য চরিত্র তিনি তাঁর ‘Travelogue’-এ অতি মনোরম চিত্তাকর্ষক ‘স্টাইলে’ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ‘সিরাজ জামান’ আর ‘মারাজ আযহার’ তাঁর ভুবনখ্যাত দুই গ্রন্থ।আরবীয় ইতিহাসবিদ তিবরি ৩০২ হিজরিতে ইতিহাস রচনা শুরু করেছিলেন। ৯২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। সীমিত সময়কালের রাষ্ট্র আর সমাজচিত্র সম্পর্কে আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছিলেন। তদানীন্তন সময়ের বিচারে তাঁর রচনার স্টাইলকে চমকপ্রদ বলে অন্যান্য আরবীয় ইতিহাসবিদ পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন বলে তাঁকে ‘আরব ইতিহাস রচনার লিভি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বেদনার কথা, তাঁর মৃত্যুর পূর্বে রচনা শেষ করে যেতে পারেননি। আল-মাসিন নামক এক যোগ্য ‘মুরিদ’ সেই রচনা শেষ করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।শিহাবউদ্দিন আহমদ মিশরের সন্তান। হিজরি ৭৩৩ এ তাঁর মৃত্যু হয়। ‘নেহায়াতুল-আরব’ তাঁর মহত্তম সৃষ্টি। গ্রন্থখানি বিশাল। ‘কালোসাস’ তুল্য। ৩০ খণ্ডে (তিরিশ) বিভক্ত। সমসাময়িক ‘বিশ্বকোষ’ বলে পরিগণিত হত গ্রন্থখানি। মিশরের জাতীয় গ্রন্থাগারে ৩০ খণ্ডের (তিরিশ) মধ্যে ২২ খণ্ড (বাইশ) সযত্নে রক্ষিত। আজও দৃশ্যমান। স্পর্শযোগ্য নয়। আধুনিক পদ্ধতিতে পাঠযোগ্য কপি নির্মাণ করা হয়েছে। পণ্ডিত সমাজ নয়া নির্মিত সংস্করণ গবেষণার কাজে ব্যবহার করে থাকেন।
ইসলামের গৌরবময় যুগে আবির্ভাব হয়েছিল আবরাল আসির নামক এক ইতিহাসবিদের। জনাব আসির ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘আল্-কামিল’ নামক গ্রন্থের রচনা শেষ করেন। তিনি অসাধারণ প্রতিভাধর মনীষী হিসেবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দ্বারা বর্ণিত। তাঁর রচনাকে আধুনিক ইউরোপের যে কোনও শ্রেষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করা যায়।‘তহকক-ই-হিন্দ’ (তারিখ-উল-হিন্দ/কিতাবউল হিন্দ) নামক বিশ্বখ্যাত; (ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত) গ্রন্থের রচয়িতা মহাত্মা ‘আলবেরুনি’-র খ্যাতি মান্যতা আর গ্রহণযোগ্যতা ‘মিথ’ বা কিংবদন্তির পর্যায়ে পড়ে। তাঁর মহান জীবনের সঙ্গে অতি সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দেওয়া গেল। ৯৭০-’৭১ খ্রিস্টাব্দে আবু রিহান (রায়হান) আলবেরুনি মধ্য এশিয়ার খোওয়ারিজম নামক রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। খুব সম্ভব, তিনি বন্দি হিসেবে সুলতান মাহমুদের রাজসভা গজনিতে এসেছিলেন। সুলতাল মাহমুদের নির্দেশে তিনি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রটিকে বিস্তীর্ণ পরিধিতে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। আরবি আর ফার্সি ভাষায় তাঁর দক্ষতা আর ব্যুৎপত্তি ছিল প্রায় সীমাহীন পর্যায়ের। আলবেরুনি তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে অন্যতম। অঙ্ক, ঔষধবিজ্ঞান, তর্কবিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, শরীরতত্ত্ব আর ইসলামি জীবনপদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য প্রখর পরিশ্রমের মারফত সময় ব্যয় করতেন। হিন্দুস্তান-এ অবস্থান কালে সংস্কৃত ভাষা আর হিন্দু ধর্মশাস্ত্র গভীর ধৈর্য আর আন্তরিকতার সঙ্গে অধ্যয়ন এবং স্বীকরণ করেছিলেন।মহাপণ্ডিত জ্ঞানতাপস আলবেরুনি দু’খানি সংস্কৃত গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং কতকগুলো আরবি কিতাব ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। অজস্র গ্রন্থের লেখক তিনি। তাঁর ‘কিতাবউল হিন্দ’ গ্রন্থে সাহিত্য, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক ব্যবস্থা, জাতিভেদ প্রভৃতি বিষয়ের সঠিক আর বিশদ আলোচনা করেছেন। পক্ষপাতদুষ্টতা তাঁর পাণ্ডিত্য আর মননশীলতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেনি।সত্যের অন্বেষক এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির আলোকবাহী এই মহাতাপসের লেখায় সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ আর শক্তির পরিচয় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। অধ্যাপক রেজাউল করিম তাঁর ‘দারাশিকোহ’ নামকগ্রন্থে আলবেরুনিকে ‘সংস্কৃতি সমন্বয়ের অগ্রদূত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আলবেরুনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল পর্যবেক্ষক ছিলেন। সত্য আর নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর চিন্তনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুলতান মাহমুদের ভারতে সামরিক অভিযানকালীন বিভিন্ন অবস্থার ‘বর্ণনা’ গ্রন্থখানিতে রয়েছে। অধ্যাপক সাচাও ‘তহকক-ই-হিন্দ’ গ্রন্থখানি ‘An In- quiry to India’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।আলবেরুনির বীক্ষণ আর বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে জাতীয়তা সম্পর্কে হিন্দুদের কোনও ধারণাই ছিল না। সমাজ ছিল জাতিভেদ প্রথায় জর্জরিত। তৎকালীন ভারতের জনগণ এত গোঁড়া আর সংকীর্ণমনা ছিলেন যে তাঁরা বহির্জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসের ইতিহাসবিদ ভি. ডি. মহাজন মন্তব্য করেছেন যে সংকীর্ণতার জন্য তাঁরা অন্য সকলকে ‘ম্লেচ্ছ’ ও ‘যবন’ বলে চিহ্নিত এবং ঘৃণা করতেন।
পরবর্তী অংশ আগামী সপ্তাহে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct