আপনজন ডেস্ক: উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির প্রাক্তন তৃণমূল নেতা শাহজাহান এখন বসিরহাট সংশোধনাগারে বিচারাধীন বন্দি। জমি দখল সহ প্রায় এক ডজন ফৌজদারি মামলায় নাম রয়েছে তার নামে। আর তাকে ঘিরে রাজ্র রাজনীতির চর্চা তুঙ্গে। বিজেপি চেষ্টা করছে সন্দেশখালির শাহজাহানকে মুসলিমদের ‘প্রকৃত’ চরিত্র হিসেবে তুলে ধরতে। এমনকী তা থেকে রেহাই দেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। তিনিও তার বক্তৃতায় মুসলিম মানেই সন্দেশখালির শাহজাহানের মতো ব্যক্ত্বিত্ব তা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নিউ বয়েজ হোস্টেলের ৫০১ নম্বর কক্ষের আবাসিক বাসিন্দা শেখ শাহজাহান। এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। বীরভূমের এক কৃষকের ছেলে। সন্দেশখালির শাহজাহান আর ২৪ বছর বয়সি মেডিকেল ছাত্র শেখ শাহজাহান যে আলাদা মেরুতে তা আর কে বোঝায়। তাই যখনই রাজনীতির চক্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো মানুষ শাহজাহান নামটি মুসলিম সম্প্রদায়কে কলঙ্কিত করতে ব্যবহার করেন তখন মন কেঁদে ওঠে ডাক্তারি পড়ুয়া শেখ শাহজাহানের। শহর কলকাতা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান তার ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, আমি তার (প্রধানমন্ত্রী) নির্বাচনী ভাষণ দেখেছি। তিনি (সন্দেশখালির শাহজাহানের) নাম ধরে যাচ্ছেন। তিনি গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে খারাপভাবে তুলে ধরছেন। রাজনীতি এত নীচে নেমে গেছে দেখে দুঃখ হয়। সন্দেশখালির শাহজাহান যদি দোষী হন তাহলে তার সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু এই বিভাজনের রাজনীতি অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করে হবু ডাক্তার শাহজাহান।উল্লেখ্য, গত ৩ মে নদিয়ায় এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘সন্দেশখালিতে দলিত বোনেদের উপর এত বড় অত্যাচার হয়েছে। সারা দেশের মানুষ আন্দোলনের দাবি তুলেছেন। কিন্তু তৃণমূল অত্যাচারীদের রক্ষা করতে থাকে। আমি তৃণমূল সরকারকে প্রশ্ন করতে চাই। শুধুই কি অত্যাচারীর নাম শাহজাহান শেখের কারণে?’ সন্দেশখালি নিয়ে শুধু প্রদানমন্ত্র নন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও সেই পথে হেঁটেছেন।বিজেপি সন্দেশখালি নিয়ে এমন একটি গল্প চাপিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে যে সন্দেশখালিতে ক্ষতিগ্রস্থরা প্রান্তিক হিন্দু পরিবার আর মূল অপরাধী মুসলমান। যদিও সন্দেশখালির কিছু অভিযোগ বাংলার শাসক দলের বিরুদ্ধে বিজেপির ষড়যন্ত্র বলে দাবি করে তৃণমূলও একাধিক “স্টিং ভিডিও” উল্লেখ করে পাল্টা আক্রমণ করছে। সন্দেশখালির শাহজাহানের খোঁজখবর রাখলেও ১৩ মে বীরভূমে ভোট দিতে পারেননি বীরভূমের শাহজাহান। ওই দিনই এমবিবিএসের ফাইনাল ইয়ারের কোর্স শুরু হওয়ার আগে ১৫ দিনের বিরতিতে বাড়ি যান তিনি। এ নিয়ে শাহজাহান বলেন,আমি এখানে থেকে গিয়ে ভোট দিতে পারতাম। কিন্তু তার মানে একদিনের ক্লাস এড়িয়ে যাওয়া। আমি সেটা চাইনি। ফাইনাল ইয়ারে তার চারটিই প্রধান বিষয়- মেডিসিন, সার্জারি, ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ এবং শিশুরোগ। তত্ত্ব ও ব্যবহারিক ক্লাসের ফাঁকে তাকে ওয়ার্ডে রোগী দেখতে হয়। আসলে তাকে যে উদ্দেশ্যে তার বাবা মা ডাক্তারি পড়াচ্ছেন সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চান। তাই শাহজাহান বলেন, আমার বাবা-মা আমার পড়াশোনার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমাকে ডাক্তার হতে দেখাটা তাদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমি আমার ১১০ শতাংশ দিতে চাই।শাহজাহানের নাম রেখেছিলেন তার পিতা, যার এক চিলতে জমি রয়েছে যেখানে তিনি বছরে দুবার ধান চাষ করেন। যদিও বহু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম শাহজাহান। সপ্তদশ শতাব্দীর পঞ্চম মুঘল শাসক মির্জা শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ খুররম (যার অর্থ বিশ্বের রাজা) যিনি শাহজাহান নামেও পরিচিত ছিলেন।
শাহজাহান, যিনি অনেক চমৎকার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল। গেরুয়াপন্থীদের লক্ষ্যবস্তু এখন সেই শাহজাহানের তাজমহল। অতীতে তাকে ‘লালসার প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।কিন্তু বীরভূমের শাহজাহানের পরিবার সম্রাট শাহজাহানের থেকে ভিন্ন। বীরভূমের শাহজাহানের বাবা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি কিছু বাড়তি আয়ের জন্য গবাদি পশু- প্রধানত মুরগি পালন করেন। শাহজাহানের মা গৃহিণী। তার দুটি বড় বোন এবং একটি ছোট বোন রয়েছে। তারা সবাই এখন বিবাহিত।শাহজাহান বলেন, আমার বাবা-মা অশিক্ষিত। কিন্তু তারা সব সময় আমাদের পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। আমার বড় দুই বোন দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করেছে। আমার ছোট বোন গ্র্যাজুয়েট।’সম্রাট না হলেও শাহজাহান এখন তার গ্রামের জন্য একটি দৃষ্টান্ত, যেখানে বেশিরভাগ যুবক অভিবাসী শ্রমিক হিসাবে বা অন্য কোনও অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করার জন্য শহরে চলে যান। যারা থেকে যান, তাদের বেশিরভাগই কৃষিকাজ করেন। বাড়িতে এলে তরুণ শাহজাহান গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে যান। তিনি বলেন, আমার বাবা আমাকে বলেছেন আমি যখন ডাক্তারি প্র্যাকটিশ শুরু করব তখন যেন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে টাকা না নিই। বাবার আদর্শ মেনে মেডিক্যাল কলেজে শাহজাহান জেলা থেকে আসা গরিবদের সাহায্য করেন। তিনি তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, সঠিক ডাক্তার দিয়ে যাতে তাদের চিকিৎসায় আর দেরি না হয়। এই শাহজাহান অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সন্দেশখালির তৈরি নয়, এই শাহজাহানকে ডাক্তারি গড়ে তোলার পিছনে অবদান রয়েছে আল-আমীন মিশনের। শাহজাহান আল আমীন মিশনের অনন্য পণ্য।সন্দেশখালির শাহজাহান সংবাদ শিরোনামে আসার পর থেকে ছোট শাহজাহান মাঝেমধ্যে কটূক্তির শিকার হয়েছেন। তবে ‘বেশিরভাগই বন্ধুত্বপূর্ণ ঠাট্টা’ বলে তিনি জানান। সম্প্রতি একটি প্র্যাবটিকাল পরীক্ষার সময় একজন বহিরাগত পরীক্ষক তার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন। শাহজাহান বলেন, ‘আমি উত্তর দিলে তিনি একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন।’ সেটা তার মনকে নাড়া দেয়। যদিও তিনি বলেন, ‘আমি আমার ব্যাচমেট, জুনিয়র ও শিক্ষকদের মধ্যে কখনো কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব দেখিনি। শহাজাহন বলেন, ‘হিজাব নিয়ে অনেক বিতর্ক শুনেছি, পড়েছি এবং দেখেছি। মেডিক্যাল কলেজে অনেক মহিলা শিক্ষার্থী হিজাব পরে ডাক্তার হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন। এখানে কোনো বৈষম্য নেই। কিন্তু যখন সন্দেশখালির শাহজাহানকে মুসলিমদের মুখ হিসেবে তুলে ধারার চেষ্টা হয় তখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিষবাষ্প হবু ডাক্তার শেখ শাহজাহানের বুক যেন চিরে দিয়ে যায়।
কৃতজ্ঞতা: দ্য টেলিগ্রাফ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct