যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনবিরোধী বিক্ষোভ আরো সহিংস হয়ে উঠছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের পাশাপাশি ইসরাইলপন্থিরা হামলা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পরস্পরবিরোধী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে মঙ্গলবার রাতে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) ক্যাম্পাসে চলমান আন্দোলনে ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। লিখেছেন ডেভিড এম পেরি ও ম্যাথিউ গ্যাব্রিয়েল।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনবিরোধী বিক্ষোভ আরো সহিংস হয়ে উঠছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের পাশাপাশি ইসরাইলপন্থিরা হামলা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পরস্পরবিরোধী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে মঙ্গলবার রাতে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) ক্যাম্পাসে চলমান আন্দোলনে ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।এ ধরনের প্রতিবাদী বিক্ষোভ বা আন্দোলনে ক্ষেত্রবিশেষে ‘এজেন্ডা’ থাকা অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নানা মতের, নানা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিও সক্রিয় হয়ে ওঠেন এ ধরনের আন্দোলনের সময়। সেসব আলোচনায় যাব না। বরং ইতিহাসের নিরিখে আমরা যে বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো, শিক্ষার্থীদের রক্ষায় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, সোচ্চার-সরব ভূমিকা পালন করেছেন, তা চোখে পড়ার মতো! এসব দৃশ্য আপ্লুত করেছে আমাদের। দু-একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে।আটলান্টার এমরি ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান নোয়েল ম্যাকাফি ছাত্রদের রক্ষায় প্রবলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এজন্য তাকে গ্রেফতার পর্যন্ত হতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর কারণে হিংস্রভাবে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় অর্থনীতির অধ্যাপক ক্যারোলিন ফোহলিনকে। ঘটনা থেমে থাকেনি এটুকুতেই। এক পুলিশ অফিসার ছাত্রদের সঙ্গে চরম বাজে ব্যবহার করছিলেন দেখে প্রতিবাদ জানান ফোহলিন। ছাত্রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না-করার আহ্বান জানান। আর এ কারণে দুঃখজনকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে।শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন টেক্সাস-অস্টিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরাও। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশি পদক্ষেপের প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ফ্যাকাল্টি। সব থেকে বড় ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে দ্য সিটি কলেজ অব নিউ ইয়র্কে। বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মাঝখানে ‘মানবপ্রাচীর’ তৈরি করেন শিক্ষকেরা, যাতে করে ছাত্ররা অক্ষত, নিরাপদ থাকতে পেরেছেন।এসব ঘটনা অনেকে নানা আঙ্গিকে দেখতে চাইবেন। তবে আজকের আধুনিক যুগে কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই আমরা। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখতে হয়, বর্তমানকালে যেসব কলেজ বা ইউনিভার্সিটি আমরা প্রত্যক্ষ করি, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবাধে বিচরণ করি, তার ভিত রচিত হয়েছিল ছাত্র-বিক্ষোভের হাত ধরে।ইউরোপীয় ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মধ্যযুগের বেশির ভাগ সময় জুড়ে কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই কেন্দ্রীভূত ছিল শিক্ষা কার্যক্রম। এই সময় ক্যাথেড্রালের (গির্জা বিশেষ) চর্চা ছিল বেশ। এসব প্রতিষ্ঠানে থাকত নানান সুযোগ-সুবিধা। ছাত্র-শিক্ষকদের মিলনমেলা হয়ে উঠতে দেখা যেত ক্যাথেড্রালকে। ঐ সময় ক্যাথেড্রালের আর্চডিকন (বর্তমানে ‘প্রোভোস্ট’), প্রধান ধর্মযাজকদের (বর্তমানে ‘ডিন’) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুখরিত হয়ে উঠত ছাত্র-শিক্ষকের ক্যাম্পাস!জানা যায়, ১২ শতকের শেষের দিকে প্যারিসের নটরডেমের ক্যাথেড্রালের চারপাশে গড়ে ওঠা স্কুলে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র ও শিক্ষকেরা আসতে থাকেন। সবাইকে রীতিমতো ‘আকর্ষণ’ করতে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। প্যারিসের ক্রমবর্ধমান সম্পদ এবং ফরাসি রাজতন্ত্রের জৌলুস অবশ্য এক্ষেত্রে বেশ কাজ করেছে।
যাহোক, বেশ ভালোই চলছিল। তবে এরপর বাধে এক বিপত্তি। এক দোকানদারের দ্বারা প্রতারিত হন প্যারিসের একদল ছাত্র। দুপক্ষের দ্বন্দ্বে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ছাত্ররা ঐ দোকানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা শুরু করেন। এর ফলে স্বভাবতই উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে। ছাত্রদের ওপর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন দোকানিরা। শুরু হয় হামলার ঘটনা। এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এক হূদয়বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে। স্কুলের প্রভোস্ট ও শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে বসে বিপরীত পক্ষ! ব্যবসায়ীদের হামলায় নিহত হন বেশ কয়েক জন ছাত্র। এটা ছিল ‘হত্যাকাণ্ড’।এই ঘটনার পটভূমি ছিল ছোট্ট। তবে এর রেশ বয়ে যায় বেশ দূর অবধি। শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন শিক্ষকেরা। ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বসেন।আগেই বলা হয়েছে, ক্যাথেড্রাল ছিল ফ্রান্সের কেবল এই এলাকাতেই এবং স্কুল হিসেবে ঐ প্রতিষ্ঠানের বেশ কদর ছিল। অর্থাত্, শিক্ষার প্রশ্নে এই অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস না চলা সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। শিক্ষকেরা এমনও হুমকি দিয়ে বসেন, ফরাসি রাজা ছাত্রদের কথা না শুনলে এবং এই ঘটনার বিচার না করলে স্কুলটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। এমন ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই নড়েচড়ে বসেন ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ দ্বিতীয় অগাস্টাস। তিনি যা করার তাই করেছিলেন! দোষীদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষক ও ছাত্রদের রক্ষার্থে ‘রাজকীয় ডিক্রি’ জারি করে ঘোষণা করেন, ছাত্র-শিক্ষক হলো এমন এক ‘করপোরেট বডি’, যা কিছু বিশেষ অধিকার ভোগ করবে।জানিয়ে রাখার বিষয়, ফিলিপ অগাস্টাস লাতিন ভাষায় যে ‘করপোরেট বডি’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, তার মাধ্যমে তিনি মূলত ‘ইউনিভার্সিটাস’ শব্দের প্রয়োগ করেন, যা আজকের দিনে ‘ইউনিভার্সিটি’।যাহোক, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউনিভার্সিটি বা কলেজ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। আরো বেশি অনুধাবন করা যায়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গভীরতার বিষয়।১২২৯ সালের প্যারিসে আরেক ঘটনা ঘটে। এর শুরুটাও প্রায় আগের ঘটনার মতোই। এক দোকানদার কয়েক জন ছাত্রের সঙ্গে ওয়াইনের দরদাম নিয়ে বাহাসে জড়ান। এক্ষেত্রেও মারধরের শিকার হন ছাত্ররা। পরের দিন দোকানে ভাঙচুর চালায় তারা। দোকানদার বিচারের জন্য কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হলে স্কুলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন ফরাসি রানি। রানির সেনারা স্টুডেন্ট কোয়ার্টারে ঢুকে পিটিয়ে বহু ছাত্রকে আহত করেন। হত্যার শিকার হন কয়েক জন ছাত্র। সেই ঘটনার পর কী হয়েছিল?
বলা বাহুল্য, ছাত্রদের পক্ষেই মাঠে নামেন শিক্ষকেরা। ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন চালানোর প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, ছাত্রদের ‘মর্যাদা’ ক্ষুণ্ন হয়েছে। তারা এ-ও বলেন, স্কুলে বাইরের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ তারা বরদাস্ত করবেন না।এবার রাষ্ট্র অবশ্য বেঁকে বসে। শিক্ষকদের দাবি অগ্রাহ্য করতে থাকে। করপোরেট বডির (ইউনিভার্সিটি) স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন খোদ রাজা! অভিযোগ ওঠে, স্কুলে বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে ছাত্রদের নানা ‘বিপজ্জনক’ বিষয় শেখানো হয়। এহেন অভিযোগ দাঁড় করিয়ে স্কুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা আঁটেন রাজনীতিবিদরা।এরপর কী ঘটেছিল? যথারীতি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান শিক্ষকেরা। শুরু করেন ধর্মঘট। ঐ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজতন্ত্র। স্কুল পুনরুদ্ধার তো হয়-ই, উপরন্তু স্বয়ং পোপ নিজেই শিক্ষক ও ছাত্রদের ওপর বাইরের ক্ষমতা সীমিত করে ডিক্রি জারি করেন। এই সাংগঠনিক নীতি ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে।ইউরোপের মধ্যযুগীয় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ইতিহাস গর্ব করার মতো বটে! বাইরের শক্তিগুলো সর্বদাই শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা ও সাধনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে, তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চাইবে। এই ঐতিহাসিক সত্য যেন আজকের দিনেরও বাস্তবতা!ওপরে বর্ণিত গল্পের শিক্ষা অত্যন্ত স্পষ্ট—বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল তখনই টিকে থাকার রসদ পায়, যখন প্রয়োজনের মুখে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এক কাতারে দাঁড়ান। আর যখন ছাত্র-শিক্ষক ‘এক হয়ে’ রুখে দাঁড়ান, তখন তাদের ক্ষমতাও হয়ে ওঠে সুবিশাল।মনে রাখা দরকার, প্যারিসের ক্যাথেড্রাল স্কুলের এক ঘটনার মধ্য দিয়ে যে ইউনিভার্সিটি শব্দের অবতারণা ঘটে, শতাব্দী পেরিয়ে তা হয়ে ওঠে ‘অনন্য’। যুগের পর যুগ এই শব্দের উচ্চারণ শুনে আসছি আমরা। আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা, টিকে থাকার প্রশ্নে এই ‘ইউনিভার্সিটি’ শব্দকে কতটা কঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই!সত্যি বলতে, ক্যাথেড্রাল স্কুলের সেই ঘটনা আজো মাঝে মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোর ক্যাম্পাসে। আর এর মধ্য দিয়ে নতুন করে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। এরকম অবস্থার মুখে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে দেখাটাই সমীচীন। এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক: যথাক্রমে মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র একাডেমিক উপদেষ্টা এবং ভার্জিনিয়া টেকের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের মধ্যযুগীয় গবেষণার অধ্যাপক
সিএনএন থেকে অনুবাদ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct