রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু করার পর থেকে পশ্চিমারা নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে মরিয়া হয়ে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজেছে। কিন্তু তাদের চেষ্টার অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছে।এমনকি পশ্চিমের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত রাশিয়ার অর্থনীতিকে লাইনচ্যুত করতে পারেনি। এসব নিষেধাজ্ঞার ফল হিসেবে যা হয়েছে, তা হলো, ক্রেমলিন তার সামরিক আচরণ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।রাশিয়া কার্যত সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি অর্থনৈতিক যুদ্ধের দিকেও অগ্রসর হয়েছে। দেশটি এখন ন্যাটোর তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করছে।ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে মস্কো যে পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করত, এখন তারা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন করছে। অন্যদিকে পশ্চিমের বেশির ভাগ দেশ অর্থনৈতিক স্থবিরতার মুখে পড়ে গেছে। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে সস্তায় জ্বালানি কেনার পথ বন্ধ হওয়ায় এবং অন্য জায়গা থেকে বেশি দামে জ্বালানি কিনতে বাধ্য হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।বিশেষ করে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবেই মন্দার মধ্যে রয়েছে। ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিক থেকে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে ইউরোজোনে কোনো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে তখন থেকেই সুদের হার বাড়ানো শুরু করেছে।জ্বালানির উচ্চমূল্য একসময়ের অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউসখ্যাত জার্মানিকে পর্যন্ত উন্নত বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অর্থনীতির দেশের স্তরে নামিয়ে এনেছে।রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে শুধু যে ইউরোপের প্রবৃদ্ধিই ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা নয়।ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মার্কিন ডলারে ‘চোরা ধস’ শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই ডলারের মূল্য ও মর্যাদায় ভেতরে-ভেতরে ক্ষয় শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন ডলার দৃশ্যত তেলের বাজারেও বৈশ্বিক প্রভাব হারিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, পশ্চিম অর্থব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্য অনেক দেশ ডলারের বিকল্প পথ অনুসরণ করছে৷ ইত্যবসরে বৃহৎ পরিসরের ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে চীন, তুরস্ক, ভারত, কাজাখস্তান ও পূর্ব ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমানভাবে সোনা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত সোনার দরকে রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে গেছে।রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছে, সেই সম্পদ থেকে উপার্জিত মুনাফা বাজেয়াপ্ত করার জন্য ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপও অ-পশ্চিমা দেশগুলোর বিকল্প পথে হাঁটার প্রবণতাকে জোরালো করবে।বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের মর্যাদা দেওয়া আছে এবং সে সুবাদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সম্পদগুলো ঐতিহাসিকভাবে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।কিন্তু ইউরোপে থাকা রাশিয়ার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ব্রাসেলসভিত্তিক ক্লিয়ারিং হাউস ইউরোক্লিয়ারের দখলে থাকা সম্পদ আন্তর্জাতিক আদালত কিংবা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই পশ্চিমা সরকারগুলো একতরফাভাবে জব্দ করেছে।এখন ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিতে দিতে ইউরোপ হয়রান হয়ে পড়েছে। এই ‘ইউক্রেন অবসাদে’ আক্রান্ত ইউরোপীয় কমিশন রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ থেকে এক বছরে অর্জিত ৩৪৫ কোটি ডলার সুদ বাজেয়াপ্ত করতে চাচ্ছে।
ইউরোপীয় কমিশনের বর্তমান প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই অর্থের বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটির (এই সংস্থা ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর জন্য ইইউভুক্ত দেশগুলোকে তহবিল সহায়তা দিয়ে থাকে) তহবিলে জমা করা হবে। বাকি অর্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় বাজেটে যুক্ত হবে, যা ইউক্রেনের অস্ত্র-উৎপাদনের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার কাজে ব্যবহার করা হবে।কিন্তু ইউরোপীয় কমিশনের এ পদক্ষেপ ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সাহায্য করবে বলে মনে হয় না। কারণ, ইউক্রেনের এখন সত্যিকার অর্থে অস্ত্র ও অর্থের চেয়ে যেটি বেশি দরকার, তা হলো তার হয়রান হয়ে পড়া বিধ্বস্ত বাহিনীতে নতুন দক্ষ জনবল নিয়োগ করা। এ ক্ষেত্রে আর কোনো বিকল্প নেই। ইউক্রেন তার হারানো সেনাশক্তি ফেরাতে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নতুন বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আগের দক্ষ সেনাদের অভাব তারা পূরণ করতে পারেনি।রাশিয়ার বৈধ উপার্জনকে এভাবে বাজেয়াপ্ত করা আন্তর্জাতিক আইনে একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। এটি আইনকানুনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার অগ্রদূত হিসেবে ইউরোপের যে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তার ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে। এ ঘটনা অন্যান্য দেশকেও এই বার্তা দেবে, তাদের অর্থ পশ্চিমে মোটেও নিরাপদ নয়। ফলে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান ও মুদ্রার বিকল্প খোঁজার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠবে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে পশ্চিমের আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা একসময় দুর্বল হয়ে পড়বে। পশ্চিমাদের নিয়মিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইতিমধ্যেই তাদের প্রভাবকে খর্ব করে ফেলেছে।এতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো যে সরকারকে নিশানা করে আরোপ করা হচ্ছে, তা সেই সরকারের আচরণ বদলাতেই শুধু ব্যর্থ হবে না, বরং তা রাশিয়া, ইরান, মিয়ানমার বা সিরিয়ার মতো দেশকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে দেবে। এটি চীনের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত স্বার্থকেও এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং সেই ইস্যুতে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া থেকে চীনের চেয়ে আর কোনো দেশই বেশি লাভবান হচ্ছে না।রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা চীনা মুদ্রা রেনমিনবির আন্তর্জাতিক ব্যবহার অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া এই নিষেধাজ্ঞা চীনের জন্য অনেক বেশি সস্তায় রাশিয়ান তেল, গ্যাস ও শস্য পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নিরাপদ রুটে এসব পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এই পরিবহনপথ অব্যাহতভাবে সুরক্ষিত হচ্ছে, যা তাইওয়ান ইস্যুতে পশ্চিমকে মোকাবিলায় চীন ব্যবহার করতে পারবে।এ ছাড়া চীন ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত তার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত দ্বিগুণের বেশি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্য কোনো দেশ এত দ্রুতগতিতে তার সামরিক শক্তিকে প্রসারিত করেনি।তবু পশ্চিমারা রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে এতটাই স্থিরপ্রতিজ্ঞ যে চীনকে এ বিষয়ে তারা ছাড় দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখন প্রতিরোধের বদলে কূটনীতির ওপর বেশি জোর দিয়ে চীনের সঙ্গে ‘প্রতিযোগিতা পরিচালনা’ করার চেষ্টা করছেন। তিনি তাঁর সর্বশেষ বাজেটে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাজেট কমিয়ে ফেলেছেন। আদতে চীন নীরবে ক্রেমলিনের যুদ্ধ-মেশিনে তেল দিয়ে যাচ্ছে। চীন মনে করছে, পশ্চিমারা যত বেশি ভ্রান্ত থাকবে, ততই চীনের জন্য ভালো।এতে কোনো ভুল নেই যে রাশিয়ার চেয়ে চীন পশ্চিমা স্বার্থ ও নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার জন্য অনেক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে রাশিয়ার উচ্চাভিলাষ তার প্রতিবেশীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সেখানে চীন প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা দখলের চেষ্টায় আছে।এ কারণে পশ্চিম যদি রাশিয়ার বিষয়ে নীতি না পাল্টায় এবং আসল প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের দিকে মনোযোগ না দেয়, তাহলে পশ্চিম সম্ভবত তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্য হারাতে পারে।
অনুবাদ : ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct