দীর্ঘ সাত বছর পর আবারও সোরবোনে (ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়) দাঁড়িয়ে কথা বলতে হাজির হয়েছি। ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে যেসব লক্ষ্য নিয়ে বক্তৃতা করেছিলাম সাত বছর আগে, তার কতটা অর্জিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো কী কী অর্জন করা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করতেই এই কথা বলা। আমাদের ইউরোপের ভবিষ্যত্, যা মূলত ফ্রান্সেরই ভবিষ্যত্—তা কোন পথে, তা নিয়ে কথা বলা। ইউরোপ ও ফ্রান্স অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর এখানে দাঁড়িয়ে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলাম। আরো ঐক্যবদ্ধ, আরো সার্বভৌম, আরো গণতান্ত্রিক ইউরোপ গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এমন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম, যেখানে অন্যান্য শক্তি এবং এই শতাব্দীর নানামুখী পরিবর্তনের মুখেও ভালোভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়। সার্বভৌমের গল্প শুনয়েছিলাম, যাতে বাইরের কেউ আমাদের ভাগ্য, মূল্যবোধ ও জীবনধারার পথ নির্দেশ করার সুযোগ না পায়। আরো গণতান্ত্রিক হওয়ার কথা বলেছিলাম এ কারণে যে, এটা সেই ইউরোপ, যেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে উদার গণতন্ত্র। ফলে এখানে যেন সবাই নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যাহোক, সাত বছর আগে একটা টাইমলাইন নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছিলাম এই সোরবোনে দাঁড়িয়ে। আজ হিসেব করে দেখা দরকার, সেই টাইমলাইন কতটা আলোর মুখ দেখেছে।আমরা যেসব কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছিলাম, তা সম্পন্ন করতে পারিনি সেভাবে। এই সত্য আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে, যখন ইউরোপকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক করার কথা ওঠে, আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এক্ষেত্রে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে। যদিও আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। এসব বুঝতে খুব বেশি পেছনে তাকানোর দরকার পড়বে না।কিছু ক্ষেত্রে বেশ সফলতা এসেছে। বিশেষত ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে ইউরোপ। যদিও এসব অর্জন করা খুব সহজ ছিল না। যখন এসব নিয়ে এগোনো হচ্ছিল, সে সময় ইউরোপ পার করছিল এক কঠিন সময়। অভূতপূর্ব সংকটের মুখে পড়েছিল গোটা ইউরোপ। অবশ্যই ব্রেক্সিটের কথা বলতে হয় সবার আগে। এই ইস্যু নিয়ে কী ধরনের অস্থিরতা ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং ইউরোপকে কীভাবে তার প্রভাব মোকাবিলা করতে হয়েছে, তার সাক্ষী আমরা সবাই। সেই কঠিন সময়েও আমরা এতটাই ঐক্যবদ্ধ থেকেছি যে, আমি লক্ষ করেছি, বাইরের কেউ ইউরোপ বা ইউরো ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার সাহস পর্যন্ত করেনি!করোনা মহামারি নিয়ে বিশ্বব্যাপী হঠাত্ করেই যে সংকট সৃষ্টি হয়, তা আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল। বহু হতাহত বয়ে এনেছিল কোভিড মহামারি। ইউক্রেনে যুদ্ধও তাই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চরম ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে আসে সার্বভৌম ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। বলতে হয়, এই যুদ্ধের অভিঘাতে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায় ইউরোপ মহাদেশ। এসব সংকটের মধ্যেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা যেভাবে অগ্রগতি করে চলেছি, তা অত্যন্ত ইতিবাচক।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের অব্যাহত অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। পরিবেশগত কিংবা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আমাদের জীবনযাত্রা আমূল পালটে গেছে, যা আমাদের ইউরোপকে এগিয়ে নিয়েছে আগামীর পথে।
ইউরোপের সার্বভৌমত্বের এই যে ধারণা, ধীরে ধীরে তা ‘ইউরোপীয়’ হয়ে উঠছে। নানা অভূতপূর্ব সংকট সত্ত্বেও ইউরোপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উন্নতি, অগ্রগতি করেছে, তা আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসেরই ফসল। এই প্রচেষ্টাকে আমি ‘ঐতিহাসিক’ বলে বিশ্বাস করি। ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রত্যক্ষ পরিণতি আমরা আজ লক্ষ করি বিভিন্ন অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের মধ্যে। সর্বত্রই তা দৃশ্যমান। ইউরোপীয় হিসেবে আমরা যতটুকু অর্জন করেছি, তার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। সম্মিলতিভাবে আজ আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিতে পারছি। অর্থনীতির পাশাপাশি বলতে হয় কৌশলগত ঐক্যের কথা। বিশেষত স্বাস্থ্য খাতে এগিয়ে যাওয়ার কথা না বললেই নয়। করোনা ভ্যাকসিন তৈরি এবং সরবরাহ সুরক্ষিত করাসহ এর বিতরণের ক্ষেত্রে ইউরোপ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করে গেছে, তা-ই করোনা মহমারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখিয়েছে।কোনো সন্দেহ নেই, ইউরোপীয় হওয়ার ফলেই আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি ও পারছি। একই কথা বলতে হয় জ্বালানি খাতের ক্ষেত্রেও। কে বিশ্বাস করবে, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠেছি আমার? এত তাড়াতাড়ি এই খাতে আমরা অগ্রগতি করব, বিদ্যুতের বাজার এত দ্রুত সংস্কার করতে সক্ষম হব, তা জানা ছিল না কারোই! এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণেই।আমরা এগিয়ে গেছি প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের একেবারে প্রথম দিন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেভাবে ব্যাপক পরিসরে সামরিক সহায়তা করে আসছে, তা দেখে ‘ইউরোপীয় ঐক্য’ নিয়ে বাজি ধরার সাহস করবে কেউ? আনন্দের বিষয়, এটা আমরা করে দেখিয়েছি।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃহত্তর প্রযুক্তিগত ও শিল্প সার্বভৌমত্বের ভিত্তি স্থাপন করার কাজে হাত দিয়েছি আমরা। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদানের প্রয়োজন মেটাতে আমরা যেভাবে এক হয়ে কাজ করছি, ইউরোপ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও সেরকমটা দেখা যাবে না। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে আমরা আমাদের ব্যাটারি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করি, যা পরে হাইড্রোজেন, ইলেকট্রনিক্স ও স্বাস্থ্যসেবা খাতকে উন্নত করে তোলে। এক্ষেত্রে জার্মানির কথা বলতে হয়। জার্মানির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের ট্যাংক ও ফিউচার কমব্যাট এয়ার সিস্টেমের মতো বড় প্রকল্প চালু করেছি, যা আজ এগিয়ে গেছে অনেকখানি। আমাদের ডাচ বন্ধুদের কথাও বলতে চাই। তাদের সঙ্গে সাবমেরিন নিয়ে বড় উদ্যোগ হাতে নিয়েছি আমরা। মহামারি শুরু হওয়ার মুহূর্ত থেকে এবং এরপর ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের মধ্যেও ভার্সাই সামিটে একটি সত্যিকারের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন তৈরি করেছি আমরা। হ্যাঁ, এটা এমন এক কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, যা আমরাই প্রথম শুরু করি। ইউরোপীয় হিসেবে গর্বিত হই এই ভেবে যে, এই ধারণাটি প্রথম গ্রহণ করি আমরাই। সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাঁচামাল পর্যন্ত আমাদের কৌশলগত নির্ভরতা প্রশংসা করার মতো। একইভাবে বিনিয়োগ, নিরাপত্তা ও সরবরাহ নীতির প্রশ্নে আমাদের পারস্পরিক সমঝোতা সমসাময়িক ইতিহাসে নজিরবিহীন। গত সাত বছরে যেসব সমস্যা, সংকট ইউরোপকে ঘিরে ধরেছিল, একটু একটু করে তা আমরা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি। যদিও আমার দৃষ্টিতে, মাত্র অর্ধেক পথ পাড়ি দিতে পেরেছি আমরা। দুঃখজনকভাবে কখনো কখনো বাহ্যিক সীমানার কথা ভুলে যাই আমরা। এই অঞ্চলকে রক্ষার কথা ভুলে যাই। ইউরোপ যে দুর্ভেদ্য দুর্গ, ভেতরের বা বাইরের সীমানার হিসাবনিকাশের সময় তা আমাদের মনে রাখতে হবে। নিজেদের সার্বভৌমত্বের জন্যই এটা জরুরি। কারণ, সুরক্ষিত সীমানা ছাড়া সার্বভৌমত্ব টিকে থাকতে পারে না।
হ্যাঁ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা অনেক কিছুই অর্জন করেছি। সবাই এগিয়ে না এলে, পদক্ষেপ না নিলে ইউরোপীয় সার্বভৌমত্ব ও ঐক্যের এই অগ্রগতি সাধিত হতো না। যার ফলে নিঃসন্দেহে আমরা পিছিয়ে পড়তাম। শুধু তাই নয়, আর্থিক সংকটের সময় আমরা যদি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতাম, তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। নাটকীয় কিছু ঘটতে পারত।এত কিছুর পরও এ কথাও বলতে হয়, আসলেই কি যথেষ্ট অগ্রগতি করেছি আমরা? ইউক্রেনে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে এখনো জয়ী হতে পারিনি আমরা। বরং জয় থেকে এখনো অনেক দূরে। সুতরাং বলতে হয়, সামনের দিকে তাকাতে হবে আমাদের। কারণ, সামনের দিনগুলোতে ইউরোপ ভূখণ্ড ‘দুর্বল’ হয়ে পড়ার বিশাল ঝুঁকিতে রয়েছে! পেছনে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর কারণ, এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক অভ্যুত্থানের মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।এই অবস্থায় আমি আজ খুব সহজ বার্তা দিতে চাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পল ভ্যালেরি এক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা এখন জানি আমাদের সভ্যতাগুলো নশ্বর’। পলের মতো আমাদেরও অবশ্যই বুঝতে চেষ্টা করতে হবে যে, আমাদের ইউরোপ ‘নশ্বর’। যে কোনো সময় এই ইউরোপ মারা যেতে পারে! আর এই মারা যাওয়াটা নির্ভর করছে আমাদের পছন্দ তথা চাওয়া-না চাওয়ার ওপর। সুতরাং, যা করার, তাড়াতাড়িই করতে হবে।মনে রাখতে হবে, আমাদের মহাদেশ নিয়ে শান্তি ও যুদ্ধের খেলা চলছে। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা না করার ক্ষমতা নিয়ে খেলা চলছে। ইউরোপের মাটি উদ্ভাবন, গবেষণা ও উত্পাদনের পাওয়ার হাউজ হয়ে উঠবে কি না, সে প্রশ্নও সামনে আসছে এসব কারণে! হ্যাঁ, আমরা এমন একসময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের সব সময় মাথায় রাখতে হবে, আমাদের ইউরোপ নশ্বর। বাস্তবতা হলো, আমাদের জোট যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমরা যতই সৌভাগ্যবান হই না কেন, আগামী বছর ও দশকগুলোতে ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা ভাবতে হবে ইউরোপকে। আর তাই, রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও সার কেনা, চীন থেকে আউটসোর্সিং এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে থাকার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। আসলেই, অন্যের ওপর নির্ভর করার দিন শেষ!খেলার ধরন সত্যিই বদলে গেছে। কঠিন যুদ্ধ, সংঘাত ইউরোপের মাটিতে ফিরে ফিরে আসছে। পারমাণবিক আশঙ্কা মাথাচাড়া দিচ্ছে। ফলে নির্ভরতার হিসাবনিকাশে পরিবর্তন আনার কথা চিন্তা করার সময় এসে গেছে। ইউরোপ নির্ভর করে, এমন দেশে ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যেখানে মাথাপিছু মোট দেশীয় উত্পাদন প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে ইউরোপে কমেছে ৩০ শতাংশ। কারণ, এখানেও খেলার নিয়ম-কানুন পালটে গেছে। আমি খুব সহজ ভাষায় বলছি, ইউরোপ যে কোনো সময়ের চেয়ে হুমকির মধ্যে রয়েছে। এটাই বাস্তবতা।
লেখক: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক সোরবোন বক্তৃতা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct