চুরি
তাসলিমা খাতুন
“এই ধর ধর ছেলেটাকে ধর রুটি চুরি করে পালাচ্ছে”রুটিটা নিয়ে প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে দিহান ভয়ের তাড়নায়, খিদের তাড়নায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, দোকানদার তাকে ধরে ফেললো সঙ্গে গালে গালে কয়েকটা চর থাপ্পড়ও বসিয়ে দিল। ক্ষণিকের মধ্যেই কিছু লোকজন সেখানে ভিড় জমালেন, কেউ কেউ দিহানের শীর্ণ দেহ, জরাজীর্ণ পোশাক দেখে সহানুভূতি দেখালো। কেউ বলল, এই সব ছেলেদের জন্যই সমাজটা নষ্ট হচ্ছে।যার দোকান থেকে রুটিটা চুরি করেছিল সেই দোকানি দিহানের হাত থেকে রুটিটা কেড়ে নিল, বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে আবারও মারধর করতে শুরু করলো। এমন সময় কোথা থেকে ত্রিশ - পঁয়ত্রিশ বছরের একজন মহিলা ছুটে এলেন। গায়ে ময়লা ছেড়া কাপর, উস্কো খুস্কো চুল, চোখ কোটরাগত , বহুদিনের অযত্নে ফর্সা রংটা তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। তিনি এসে দিহানকে জড়িয়ে ধরলেন। দিহানকে না মারার জন্য কাকুতি মিনতি করে বললেন,“আমার ছেলেটাকে আর মারবেনা না বাবু ।”“ছেলেকে শাসন করতে পারো না?”“ওর কোনো দোষ নেই বাবু কাল সারাদিন খায়নি তাই চুরি করে ফেলেছে।”একজন মৌলবী সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি বললেন,“দেখেছো ছেলে চুরি করেছে আর তার হয়ে সাফাই গাইছে, ধর্ম মতে তো ছেলেটার হাত কেটে নেওয়া উচিৎ।”কাল সারাদিন দিহানের মায়ের পেটে কিছু পরেনি,আজকেও পরবে কি তার ঠিক নেই, আজ যদি কেউ ভিক্ষে দেয় তবেই....। খেতে না পাওয়ার দুঃখে আর ছেলের দুঃখে তাঁর ভেতর থেকে ক্ষোভ বেরিয়ে এলো ,
“ ধর্ম বুঝি তাই বলে বাবু? তবে দেশের মন্ত্রীদের বড়ো বড়ো ব্যাবসায়ীদের হাত কেন কেটে দেন না?”একজন লোক অবজ্ঞা করে বললেন,“সরকার কিছু দিলে তো ঠিকি হাত পেতে নিতে পারো, আর এসব কথা বলছো জানে ভয় নেই?”“যার কিছুই নেই তার আবার কিসের ভয় বাবু, আছে শুধু এই শরীর যার মধ্যে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোটে না । যারা দেয়, তবে দেয়ার চেয়ে তারা শোষণ করে বেশি। জনসাধারণের জন্য সরকার নিযুক্ত করা হয়, এদিকে জনসাধারণের দিন চলে না আর সরকারও তার খেয়াল করে কৈ!”মহিলার কথায় সত্যি সত্যি মানুষের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কেউ যেন কোনো ভাষা পেল না কিছু বলার জন্য। কিছুক্ষণ নীরবতার পর একজন বললেন,“দোষ তো তোমাদেরই, ছেলেটাকে যদি স্কুলে পাঠাও তবুও তো ছেলে শিক্ষিত হলে সমাজ থেকে দারিদ্রতা কমে, এমন সন্তানের জন্যই তো সমাজ টা নষ্ট হচ্ছে।”দিহানের মায়ের মনে যেন আজ অগ্নিসংযোগ হচ্ছে - সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন,সন্তানের জন্য সমাজ নষ্ট হয় না, সন্তান নষ্ট হয় সমাজের জন্য। আপনারা যাঁরা সমাজের বিচারপতি তাঁরা কখনো হতদরিদ্রদের দিকে চেয়ে দেখেন? সামান্য রুটি চুরির জন্য ছেলেটাকে মারধর করলেন, কৈ তার পরিবর্তে তো সহানুভূতি দেখিয়ে ছেলেটাকে দুটো নীতি কথা শেখাতে পারলেন না, আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ তবে কেন এমন আচরণ আপনাদের? ধিক্কার জানাই আপনাদের মত শিক্ষিতদের ।”কথা গুলো বলে দিহানের মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। দিহান যখন মাস খানেকের ছেলে, তার বাবাকে কি যেন একটা কঠিন ব্যাধি হলো । দিহানের বাবার রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। অভাবের সংসারে দিহানের মা যেনো অথৈ সাগরে পড়লো , কষ্ট করে কিছু জমানো টাকাও ঔষুধ কিনতে শেষ হয়ে গেল, জায়গা জমি কিছু নেই বস্তিতে একটা ভাঙা ঘর ছাড়া। ডাক্তার দেখানোর রাস্তা না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করলেন দিহানের মা ,কিন্তু ভিক্ষা করে ডাক্তার দেখানো তো দুর সংসার চালানোই দুষ্কর হয়ে উঠলো। দিহানের বাবাও মাস খানেক পর মারা গেলেন।দিহানের মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন দিহানের মায়ের যাওয়ার দিকে অবাক নয়নে চেয়ে রইলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct