পাভেল আখতার, আপনজন: রাজশেখর বসুর একটি রম্য-প্ৰবন্ধ আছে। ‘উৎকোচ তত্ত্ব’। প্রবন্ধটিতে ‘উৎকোচ’-কে দুটি গোত্রে ভাগ করা হয়েছে। স্থূল ও সূক্ষ্ম। স্থূল উৎকোচ বলতে টাকাপয়সা দিয়ে ‘কাজ’ হাসিল করা। এক্ষেত্রে উৎকোচ দাতা ও উৎকোচ গ্রহীতা দুজনেই চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বসে থাকে! কিন্তু, সূক্ষ্ম উৎকোচ ঈষৎ শৈল্পিক! দাতা জানে সে কি ও কেন করছে, কিন্তু গ্রহীতা সবসময় তা বুঝতে পারে না। অথচ, তার মন খুশিতে ডগমগ করে ওঠে! ফলাফল একই। সূক্ষ্ম উৎকোচ কেমন ? শখের বাগানে ফোটা সুগন্ধি ফুল, বিখ্যাত দোকানের মিষ্টি, গৃহকর্ত্রীর জন্য জামদানি শাড়ি, অলঙ্কার ইত্যাদি। ‘সূক্ষ্ম উৎকোচ’ বস্তুটা বোঝাতে রাজশেখর বসু কল্পিত এক ‘নীতিবান’ বিচারকের উদাহরণ দিয়েছেন। ‘বেচারা’ বিচারক তার গৃহকর্ত্রীর ঝাঁঝে ‘রায়’ দেন ইচ্ছের বিরুদ্ধে। গৃহকর্ত্রী ততক্ষণে যে সূক্ষ্ম উৎকোচ পেয়ে গেছেন, তিনি তো ‘ঝাঁঝ’ দেখাবেনই!যে দুর্নীতির চর্চা আমরা অষ্টপ্রহর করে থাকি, তার মূলে আছে উৎকোচ। যাকে গোদা বাংলায় বলে ‘ঘুষ’। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উৎকোচ বা ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া ব্যাপারটা কি কেবল ‘চাকরি’তেই সীমাবদ্ধ ? মোটেই নয়। বিয়েতে যে কুখ্যাত ‘পণপ্রথা’র অস্তিত্ব জগদ্দল পাথরের মতো আজও সমাজে গেড়ে বসে আছে তাকে কি উৎকোচ বা ঘুষ বলা যায় না ? সরকারি অফিসে ‘কাজ’ করাতে গিয়ে উৎকোচ বা ঘুষ দেওয়া তো প্রায় একটা অনিবার্য প্রথায় পরিণত হয়েছে! সাধের বেসরকারি স্কুলে কিংবা কলেজে ভর্তির জন্য যে মোটা অংকের ‘ডোনেশন’ দিতে হয় তা-ও কি উৎকোচ বা ঘুষ নয় ? বিনা টিকিটে অথবা সাধারণ টিকিটে ট্রেনে উঠে সংরক্ষিত আসনের জন্য টিকিট পরীক্ষককে উৎকোচ বা ঘুষ দিতে আমাদের বাধে না! কাম্য জায়গায় বদলির জন্য উৎকোচ বা ঘুষ দিতেও আমরা দ্বিধাহীন! তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই। পরিশেষে উৎকোচ হয়তো নিজেই গান ধরবে : ‘’আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব...!’’মাটির গভীরে চারিয়ে যাওয়া শক্ত শিকড়ের মতো এটা একটা নিদারুণ সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধিকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবনযাপন। আমরা নানা আঙ্গিকের ‘দুর্নীতি’-কে তো ‘ব্যাধি’ হিসেবে চিহ্নিত করতেই পারিনি। তাহলে তার ‘নিরাময়’ কীভাবে হবে ? ‘দুর্নীতির সঙ্গে সমঝোতা’ কথাটা ভুল। আসলে আমরা ‘দুর্নীতি’র মধ্যে বেঁচেবর্তে থাকাকেই ‘চয়ন’ করে দিব্যি আছি! এজন্যেই মাঝেমধ্যে যে তীব্র ‘বিরুদ্ধ ঢেউগুলি’ ওঠে তা অবশেষে ‘অর্থহীন শব্দের জঞ্জালে’ পরিণত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না!গোটা সমাজটাই যখন নানা কিসিমের দুর্নীতির পাঁকে ডুবে থাকে তখন সহসা কোনও ‘বিরাট বিস্ফোরণে’ সমাজের সমবেত ক্রুদ্ধ গর্জন অর্থহীন! মনে রাখতে হবে যে, ‘দুর্নীতি’ নামক অপকর্মটি সম্পন্ন হয় দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের অংশগ্রহণে। সব ক্ষেত্রেই।
ধরা যাক, একজন আপাদমস্তক সৎ, আদর্শবাদী, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু, বড় কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নয়। ছোট দল, অথবা নির্দলও হতে পারে। পক্ষান্তরে, আরেকজন মানুষ ভোটে দাঁড়িয়েছেন, বড় রাজনৈতিক দলের ব্যানারে। তিনি সৎ না কি অসৎ জানা নেই ; অথবা জানা আছে যে, সৎ নন। এবং, তিনি ততটা শিক্ষিতও নন। কে জিতবেন ? চোখ বন্ধ করে বলা যায়, দ্বিতীয় ব্যক্তি। অভিজ্ঞতা বলে, যাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছিল তিনি সমাজের জন্য ‘কিছু’ করেননি, কিন্তু নিজের জন্য ‘যথেষ্ট’ করেছেন! তাঁর কি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়া উচিত ? কিন্তু, আমরা কী দেখি ? অতএব, একটি প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী। অসৎ রাজনৈতিক নেতা গড়ে ওঠার ‘দায়’ জনগণের উপর কি বর্তায়, না কি বর্তায় না ? ‘দুর্নীতি’ কোনও একক জিনিস নয়। সুতোর দুটি প্রান্ত থাকে। বিয়েতে যে ‘পণ’ নেয় সে খারাপ আর যে দেয় সে কি ধোয়া তুলসীপাতা ? ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে বিয়ের একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার তার ছেলেকে বলছেন, ‘যে দুধে কেরোসিনের গন্ধ সে দুধ তোমরা গিলতে পারো, কিন্তু আমি গিলতে পারব না!’ প্রসঙ্গ : ছেলের শ্বশুর গর্বের সঙ্গে যখন বলছিলেন তিনি জামাইকে বিয়েতে কি কি দিয়েছেন। ‘দুর্নীতি’ নিয়ে দারুণ কলরব হতে পারে, কিন্তু তা জনগণের কাছে কোনও দিনই ‘সিদ্ধান্তকর বিষয়’ হয়নি। আর সম্ভবত হবেও না, বিশেষত চলমান ভোটের রাজনীতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ নামক পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি নিয়েও কিছু সামাজিক দায়বদ্ধ মিডিয়াসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর কোলাহল, গর্জন লক্ষ করা গেছে। কিন্তু, সমাজের অভ্যন্তরে যদি নিরপেক্ষ সমীক্ষা করা যায় তাহলে এটাই দেখা যাবে যে, এজন্য সেখানে কোনও বিরূপতার ঢেউই বইছে না! তার কারণ, ছোট-মেজো-বড় নানা আঙ্গিকের ‘দুর্নীতি’র সঙ্গে মিতালি পাতিয়েই সমাজজীবনের স্রোত বয়ে চলেছে! একথায় কোনও সন্দেহ নেই যে, দুর্নীতি হচ্ছে এমন একটা ‘অভিশাপ’, যা না থাকলে আমাদের দেশ সত্যিই ‘অন্যরকম’ হ’ত! পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে দেখে আমরা নিত্যদিন আক্ষেপ ও অনুশোচনায় দগ্ধ হই! আত্মদর্শন বা আত্মসমালোচনা ব্যতীত এই ‘আক্ষেপ’ অর্থহীন। মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমরা আজও কেন রয়ে গেলাম ‘উন্নয়নশীল’ সেকথা উপলব্ধি করার এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। যদি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে বলতে হবে যে, আমাদের কপাল থেকে ‘উন্নয়নশীল’-এর তকমা আজ অবধি না ঘোচার প্রধান কারণ হ’ল ‘দুর্নীতি’। শুধু যে ক্ষমতার অলিন্দে দুর্নীতি আছে তা নয়, সমাজের সমস্ত স্তরে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি রয়েছে। অফিসে অফিসে দুর্নীতি। যেখানে বাচ্চারা মধ্যাহ্নকালীন খাবার খায় সেখানে পর্যন্ত দুর্নীতি হয়। তাহলে আর কী হবে! আর, একথাও ঠিক যে, মানুষের নৈতিক চরিত্র সঠিকভাবে গঠিত না হলে ‘দুর্নীতি’ নামক এই ‘অভিশাপ’ দূরীভূত হওয়াও সম্ভব নয়! কিন্তু, সেই ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা কোথায় ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct