কৃতজ্ঞতা
জহির-উল-ইসলাম
সচরাচর দূর পাল্লার সফরে গেলে গাড়ি নিয়ে যায় না সুমাইয়ারা। আজ তার ব্যতিক্রম। আরামদায়ক রেলপথ ত্যাগ করে সড়ক পথে নিজস্ব গাড়িতেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল তারা। আজকে আর তাদের কেবল সোজা আলীনগর থেকেই ফিরে আসা সম্ভব হবে না। একটু আনাচে-কানাচেও ঢু মারতে হবে। সুতরাং গাড়ি ছাড়া স্বাচ্ছন্দে সেটা সম্ভব নয়। হারুন নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। আজও গাড়ির স্টিয়ারিং তারই হাতে। সঙ্গে আছে চার বছরের পুত্র নাহিদ। স্কুল-কলেজ তিনদিন ছুটি। টানা কাজের মধ্যে এমন ছুটি-ছাটা পেলে বেশ ভালোই লাগে। ছোট-খাটো সফর শেষে সামনের দিনগুলোতে নতুনভাবে কাজ করার যথেষ্ট এনার্জি আসে। কাজের চাপে অনেকদিন গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাদের। আলীনগর থেকে সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ি খুব একটা বেশি দূরে নয়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। একবার দেখা করে তাদের দোয়া নেওয়া দরকার। সামনে রমজান মাস আসছে। রোজার আগে আর যাওয়া হবেনা হয়তো। রোজা উপলক্ষে তাদের হাতে কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে আসাও যাবে। তবে প্রথমেই দেখা করতে হবে দীনু কাকুর সঙ্গে। আহা, ইদানীং বেচারা কত কষ্টেই না দিন গুজরান করছে। আগের মতো আর খাটতে পারেন না। তার উপর সামনেই মেয়ের বিয়ে। এই সময় কত টাকার প্রয়োজন! কাছে কেউ নেই যে একটুখানি পাশে দাঁড়ায়। গতকাল সকালে মায়ের ফোন পেয়ে জেনেছে এ মাসের সতেরো তারিখে প্রিয়াঙ্কার বিয়ে। হঠাৎ করে এ সময়ে হাজির হয়ে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।
চৈত্র মাস শেষ হতে চলল। আমগাছে কচি কচি আমের কলি লুকোচুরি খেলা করতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’ধারে নাম না জানা অযত্ন লালিত কত-শত ঝোপঝাড়। রঙ-বেরঙের নতুন পাতা আর বাহারি ফুলের উজ্জ্বল হাসি নিয়ে তারা চলমান ক্লান্ত পথিকের মনে অফুরন্ত সুখানুভূতি ছড়িয়ে চলেছে দিবারাত্রি। এতক্ষণ বকর বকর করে নাহিদ সুমাইয়ার কোলে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চলতে চলতে কত কথা মনে পড়ে তার। অনেক স্মৃতি ভীড় করে মনের শূন্য পর্দায়। লালগোলা বাজার থেকে পাঁচ কিমি দূরে অবস্থিত আলীনগর গ্রামে সুমাইয়ার জন্ম, বেড়ে ওঠা। রাস্তাঘাট নামেই পাকা। স্থানে স্থানে পিচ উড়ে গিয়ে খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। আগের মতো বর্ষার সময় পায়ে কাদা মাড়াতে হয়না বটে, তবে বর্ষা আসলেই রাস্তার জায়গায় জায়গায় জল জমে জলাশয়ে পরিণত হয়। এমন দুর্গম পথঘাট অতিক্রম করে স্কুল জীবনের দীর্ঘ কয়েকটি বছর কী কঠিন সংগ্রাম করেই না বড় হয়েছে সে! আজ সেসব ভাবলে নিজেই আশ্চর্য হয়। রাস্তাঘাটে তখনো টোটো নামেনি। মানুষের জীবনে এখনকার মতো এত স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি। সেই দিনগুলোতে তার একমাত্র ভরসা ছিল দীনু কাকুর প্যাডেলওয়ালা তিন চাকার সাধারণ রিকশা। স্কুল থেকে প্রাইভেট-টিউশন যেখানেই যাওয়ার দরকার দীনু হাজির। দিনের নির্ধারিত সময়ের জন্য সারা বছরই রিজার্ভ থাকত। শুধু নিয়ে যাওয়া-আসায় নয়, তার সম্ভ্রম-মর্যাদা রক্ষার জন্য সদাই সচেষ্ট থাকত দীনু সিংহ। সুমাইয়া এমনিতেই হিজাব পালন করত। ফলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে থাকা বখাটে যুবকেরা তার দিকে কোনদিন ঘুরেও তাকাত না। তবে একবার একটা ঘটনায় সুমাইয়া বেশ ঘাবড়ে গেছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। টিপটিপ বৃষ্টিও ঝরছে। নির্জন রাস্তাঘাট। এই সুযোগে সেইদিন দু’জন মাতাল তাদের গাড়ির সামনে এসে পথরোধ করে। ‘আমার লাস না ফেললে একদমই এগুতে পারবিনা’ বজ্রগম্ভীর স্বরে দীনুর এই একটা হুংকারের সঙ্গে ওদের একজনের পিঠে একটা লাঠির ঘা পড়তেই নিমেষে ভয় পেয়ে দুজনেই গায়েব। সুমাইয়াও হাফ ছেড়ে বাঁচে। ব্যাটাদের কী মতলব ছিল কে জানে। ঘটনাটি মনে পড়লে আজও তার গা শিউরে ওঠে।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট নিয়েই উচ্চ শিক্ষার জন্য সুমাইয়া রওনা দিল কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলো। যথেষ্ট মেধাবী বলে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। উচ্চ শিক্ষা শেষ করে জেলা সদর বহরমপুরের অদূরে কোন এক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহজেই শিক্ষকতার সুযোগটা জুটে গেল। বেকারত্বের যন্ত্রণা কেমন, একদিনের জন্য অনুভব করেনি সে। সুমাইয়ার এই সাফল্যের পেছনে স্বামী হারুনেরও অবদান কম নয়। শিক্ষা জীবনের মাঝপথেই সুমাইয়া বাবাকে হারিয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনায়। তাই অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পা দিতে না দিতে মা আর ঝুঁকি নিতে চাইল না। মেয়ের বিয়ের জন্য উতলা হয়ে উঠল। তাছাড়া ভাবল, এখনই বিয়েটা দিয়ে দিলে সুমাইয়ারও একটু হিল্লা হবে। তাকে আর দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না, ছোটাছুটি করতে হবে না। ওর নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়াদি জামায়-ই সব দেখে নিতে পারবে। তখনও হারুনের চাকরিটা হয়নি। একরূপ বেকার বললেই ভালো হয়। ভালো ডিগ্রি আছে। নিকট ভবিষ্যতে কিছু একটা হবেই। তাই প্রস্তাব আসলে সুমাইয়ার মা-ও পিছপা হননি। ভেবেছিলেন, আল্লাহ্ রুটি রুজির মালিক। কেউ না খেয়ে থাকে না। ছেলে সৎ ও ধার্মিক। সাতে-পাঁচে নেই। এযুগে এমন ছেলে পাওয়া দুষ্কর। কম খাওয়া-পড়া করলেও মেয়েটা ভালো থাকবে। তবে এত দ্রুত কপাল ফলবে কেউ ভাবতেই পারে নি। আল্লাহর ইচ্ছায় বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই হারুনও একটা কলেজে অধ্যাপনার সুযোগটা পেয়ে গেল। সচরাচর দেখা যায় এমন প্রতিষ্ঠিত দম্পতিদের মধ্যে কোথায় যেন একটা বোঝাপড়ার অভাব থাকে। আর তা থেকেই নিজেদের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব তৈরি হয়। পরস্পরের মন না পাওয়ার এক অব্যক্ত বেদনা শেষ পর্যন্ত অনেক দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদও ডেকে নিয়ে আসে। সুমাইয়া-হারুনের দাম্পত্য জীবনে মিশে আছে কিসের এক সুদৃঢ় মেলবন্ধন। হারুন দাবি করে, পবিত্র ইসলামের ছায়া তাদের জীবনে এই অনাবিল প্রশান্তির এনে দিয়েছে। কাজে যোগ দিয়েই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সুমাইয়াকে নিয়ে বহরমপুরে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছিল হারুন। ইদানীং শহরের এক নির্মল পরিবেশে ছিমছাম গোছের একটা ফ্লাটও কিনে ফেলেছে সে।
আগামী সপ্তাহে পরবর্তী অংশ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct