ডা. শামসুল হক, আপনজন: একটাসময় সমগ্ৰ শিক্ষা জগৎ এবং সেইসঙ্গে সাংস্কৃতিক ঘরানার এই বিশাল পরিমণ্ডলের মধ্যে মুসলিম মহিলারা এতটাই পিছিয়ে পড়েছিলেন যে সেটা দেখে ভীষণ বিষণ্ণও হয়ে উঠেছিল তাঁর মন। তাই কালবিলম্ব না করে নিজস্ব মেধা এবং সাহসের উপর ভর করে নিজ প্রচেষ্টাতেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন এবং পুরোপুরিভাবে সফল হয়ে সমাজের আরও অনেক মহিলাদের নতুনভাবে উদ্ধুদ্ধ করার কাজে সফলও হয়ে উঠেছিলেন। তিনি খুজিস্তা আকতার বানু। তিনিই হলেন প্রথম ভারতীয় মুসলিম মহিলা, যিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতি প্রত্যাশিত ডিগ্ৰীটি অর্জন করে দেশের মুখও উজ্জ্বল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের প্রধান একজন পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্রও পেয়েছিলেন। আর এই ব্যাপারে তিনিই হলেন এই উপ মহাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা, যিনি এই বিশাল কৃতিত্বের স্বাক্ষরও বহন করেছিলেন।সেইসময় অবশ্য লেখাপড়া সহ সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে মুসলিম ছেলেরা প্রতিযোগিতা মূলক একটা পরিমণ্ডলের মধ্যে অবস্থান করলেও মেয়েরা কিন্তু ছিলেন একবারে পিছনের সারিতেই। বলাই বাহুল্য, নিজের চোখের সামনে দেখা সেই করুণ দৃশ্য তখন ভীষণভাবেই ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। বেগম রোকেয়ার মতো মুসলিম মহিলারা অবশ্য সেইসময় শিক্ষার প্রসারের জন্যই অকৃত্রিম প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মহিয়সী সেই নারীর সঙ্গে আবার উপযুক্ত সহায়তা দিচ্ছিলেন তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের মতো যোগ্য মানুষও। কিন্তু তখন যে কোন কারণেই হোক তাঁদের সংগ্ৰামের সেই ঢেউ তেমন মারাত্মকভাবে প্রকট হয়ে ওঠেনি।আকতার বানু লক্ষ্য করেছিলেন সব কিছুই। তাই সবকিছু বুঝেই বেগম রোকেয়ার এবং তাঁর স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই, মুসলিম মহিলাদের শিক্ষা বিস্তারের সেই মহাসংগ্ৰাম আরও জোরদার হয়ে উঠুক এবং সকলেই নিজস্ব সাহসের উপর ভর করেই গড়ে তুলুক নিজেদের ভবিষ্যতও।
নিজের শিক্ষাজীবনের একেবারে শুরু থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন যে মেয়েদের শিক্ষার মধ্যে আছে হরেক বাধা, আর মুসলিমদের ক্ষেত্রে তো সেই বাধার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল আরও বহুগুণ। কিন্তু তার মধ্যেও তিনি চেয়েছিলেন আগে নিজে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হন, তারপর ভাববেন অন্যদেরও শিক্ষিত করার কথা।খুজিস্তা আকতার বানুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় হুগলি শহরের একটা মিশনারী স্কুলেই। পাশাপাশি হুগলি মাদ্রাসা স্কুল থাকলেও সেখানে তখন মেয়েদের পড়াশোনা করার কোন সুযোগই ছিল না। সেটা তখন সেই এলাকার হিন্দু, মুসলমান সহ অন্যান্য আরও অনেক সম্প্রদায়ের ছেলেদের জন্য আদর্শ একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হলেও মেয়েদের জন্য তেমন সুব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু সেই স্কুলেই নিজস্ব প্রচেষ্টায় তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেকটাই পথ। যদিও বর্ধিত মুসলিম পরিবারের অত্যন্ত রক্ষণশীল একটা বেষ্টনেই বন্দী হয়ে দিনাতিপাত করার কথা তাঁর। কিন্তু সবকিছু অগ্ৰাহ্য করে মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বেরিয়েও এসেছিলেন তিনি। আর এই ব্যাপারে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর পিতার পূর্ণ সহযোগিতাও। ১৮৭৮ সালে জন্ম তাঁর হুগলি শহরে। তাঁর পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ইরাকের বিখ্যাত সুরাহওয়ারদি বংশের সন্তান। ইরাক থেকে তাঁরা প্রথমে আসেন মেদিনীপুরে। তারপর হুগলি। স্থানীয় একটা কলেজে অধ্যাপনার কাজও নেন তিনি। একসময় কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা ব্যারিষ্টার রহিম জাইদি সুরাহওয়ারদি সাহেবের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হন তিনি। স্বামী স্ত্রী মিলে এবার সমাজসেবা মূলক নানান কাজে এগিয়ে যেতেও শুরু করেন তাঁরা। মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বিস্তার দিয়েই শুরু হয় সেই পরিক্রমা। দীর্ঘদিন ধরে চালিয়েছিলেন বহুবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষাও। অবশেষে সফল হন এবং তার পুরস্কার হিসেবে ভারত সরকারে এগজামিনেশন বোর্ডের তরফ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সন্মান সূচক পদবি ডিগ্ৰী অব অনার্স। যেকোন ধর্ম বা ধর্মীয় পরিমণ্ডলের মধ্যে কোন মানুষকে তিনি কখনও দেখেননি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে। অশ্রদ্ধার চোখে তো নয়ই। গরীবদের কথাও তিনি শুনতেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গেই। ছিল মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রতি তীক্ষ্ম নজরও। মেয়েরা যাতে সবসময় সঠিক চিকিৎসা পায় সেজন্য তিনি নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতেন লেডি ডাফরিনের সঙ্গেও। সমাজের উন্নয়নমূলক অনেক কাজেরই সাক্ষী হয়ে আছেন সেই মহিলা। কিন্তু একেবারে সীমিত আয়ূ নিয়েই তিনি এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। ১৯১৯ সালে কলকাতার বেশ কয়েকটা বস্তিতে দেখা দিয়েছিল কলেরা রোগ। একসময় সেটা মহামারির আকারও নিয়েছিল। সেখানেও ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন রকমভাবে তাঁদের সাহায্যও করেছিলেন । কিন্তু কয়েকদিন পর তিনিও সেই রোগে আক্রান্ত হন । তারপর অনেক চেষ্টার পরও বাঁচান সম্ভব হয়নি তাঁকে । মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন তিনি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct