প্রতি বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কি?
প্রিন্স বিশ্বাস
আবার বাষ্পমোচনের ফলে উদ্ভিদের মেসোফিল কলায় যে ব্যাপন চাপ ঘাটতি (Diffusion pressure deficit) দেখা যায় তা জাইলেম বাহিকায় যে বিশেষ চোষণ চাপ (suction pressure) সৃষ্টি করে মূল থেকে খনিজ লবণ মিশ্রিত জলকে ঊর্ধ্বমুখে পরিবাহিত করে, তাকে বাষ্পমোচন টান বা প্রস্বেদন টান বলে। এই প্রস্বেদন টানের ফলে উদ্ভিদদেহে মূলরোম থেকে পত্ররন্ধ পর্যন্ত একটি জলবাহী চ্যানেল (পথ) তৈরী হয়। এই চ্যানেল বরাবর চোষণ টানের জন্য মূলরোম দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে (কিছুটা সাইফনের মত) মাটির জল শোষিত হয়ে কলাকোষের মধ্যে দিয়ে কোষান্তর অভিস্রবন প্রক্রিয়ায় পত্ররন্ধ্রে পোঁছাতে থাকে বিরামহীন ভাবে। এই বিরামহীন টানের ফলে মাটির জল অভিকর্ষ বলের টানে পাতাল গামী হতে পারে না। ফলস্বরূপ ভূ-পৃষ্ঠের উপরিতল জলসিক্ত থাকার ফলে ভূূ-পৃষ্ঠে শোষিত তাপ বা সরাসরি সৌরতাপের দ্বারা মাটির জল বাস্পীভুত হতে সুবিধা হয়। আবার এই প্রস্বেদন টানের ফলেই পরোক্ষে উদ্ভিদদেহের বাস্পমোচনের হার বৃদ্ধি পায়। এইভাবে নিয়মিত বাস্পমোচনের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের বিশাল জলরাশির বাস্পীভবনের মাধ্যমেই মেঘ তৈরী হয় হয় এবং নিয়মিত বৃষ্টিপাত ঘটে। তবে শুধু বাস্পমোচন বা প্রস্বেদন টানের মাধ্যমেই নয় উদ্ভিদ পরিবেশের উষ্ণতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে অন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান নিয়ন্ত্রণ করে। প্রযুক্তির বলে বলীয়ান আমাদের যন্ত্রচালিত সভ্যতার আগ্রাসনে জীবাশ্ম-জ্বালানীর লাগামহীন ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান। আর এই কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধিতে বেড়ে চলেছে ‘গ্রীন হাউস এফেক্টের’ মাত্রা। যার ফলে পৃথিবী থেকে ফেরতগামী অপেক্ষাকৃত বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপ-তরঙ্গকে মহাশূন্যে ফেরত যেতে বাধা দিচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইডের তৈরী বলয় বা আবরণ। ফলে 34% অ্যালবেডোতেও থাবা বসাচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইডের আবরণ। এই এই ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। তাই বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধিও পৃথিবীর বসবাস মন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যত্তম একটি কারণ। সূতরাং এর পরিমান নিয়ন্ত্রণও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের হাতে তার তেমন কোনো অস্ত্রই নেই। একমাত্র উদ্ভিদই তার নিজের খাদ্য তৈরীর জন্য সালোক সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে্ পরিবেশকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন দান করে। তাই কলকারখানা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমান তালে উদ্ভিদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারলে কিন্তু সমাধানের তেমন কোনো পথই নেই। তবে ফী-বছর নিয়মিতভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বৃক্ষছেদন বা অরণ্যহ্রাস মূল কারণ হলেও এটি একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে রয়েছে আরও ভিন্ন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন, ভূ-গর্ভের জলরাশি উপরে তুলে আনার ফলে বৃষ্টিপাত জনিত জল পুনরায় দ্রুত পাতালগামী হওয়ার প্রবনতা তৈরী হয়েছে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের আর্দ্রতা বজায় থাকছে না। ভূ-গর্ভ থেকে কয়লা, পেট্রোলিয়াম বিভিন্ন সহ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ফলেও একই প্রবনতা তৈরী হচ্ছে। এমনকি ভূগর্ভের তাপও উপরিস্তরে উঠে আসছে। যন্ত্রচালিত সভ্যতায় যন্ত্রের থেকে নির্গত তাপও (যা অন্য শক্তি থেকে তাপে রূপান্তরিত হয়ে তৈরী হয়) পরিবেশের গড় উষ্ণতাকে বৃদ্ধি করে চলেছে। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী রাতের বেলা পৃথিবী অন্ধাকার থাকার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান সভ্যতায় আমারা আলোক প্রযুক্তির দাপটে রাতেও ক্রিকেট, ফুটবলের টূর্ণামেন্ট খেলছি। পৃথিবীর বসবাসময় স্থানগুলি এখন আর রাতে আলোকবিহীন থাকে না। ফলে আলোক শক্তি থেকে রূপান্তরিত তাপশক্তিও যোগ হচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে। আবার সেই আলোর চালিকা শক্তি যোগান দিতে চালু থাকছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি। সেখান থেকেও তাপের উদ্ভব ঘটছে। একইভাবে প্রতিটি যন্ত্রপাতি চালনার সময় অন্য শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশছে। এরই সঙ্গে আছে ফ্রীজ, এসি ইত্যাদি হিমায়ক যন্ত্রের CFC গ্যাসের ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট দূষণ যা ওজোনস্তরের ক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ওজোনমন্ডলের এই ক্ষয়ের ফলে পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছে ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি যা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর আবহমন্ডলীয় তাপমাত্রার বৃদ্ধির অপর একটি কারণ। তবে একই তাপে সব (সমভরের) বস্তু সমান গরম হয় না। যেমন, শুকনো মাটি(0.2 Cal/g) থেকে টিনের চাল(.054 Cal/g) অনেক দ্রুত উত্তপ্ত হয়। কোন বস্তু কতটা উত্তপ্ত হবে তা নির্ভর করে বস্তুটির আপেক্ষিক তাপের মানের উপর। আপেক্ষিক তাপের মান কম হলে সেই বস্তুগুলি দ্রুত উত্তপ্ত হয়। তাই পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা অপেক্ষাকৃত কম আপেক্ষিক তাপ বিশিষ্ট পদার্থগুলিকে (বিশেষত ধাতব পদার্থের ব্যবহার) ভূ-অভ্যন্তর থেকে তুলে এনে ভু-পৃষ্ঠের উপরে নানা ইমারত নির্মানে ব্যবহার করার ফলে সেগুলি সহজেই তাপ শোষণ করে উত্তপ্ত হওয়ার পর সেই তাপ বিকিরণ করে তার পরিমন্ডলকে উত্তপ্ত করে চলেছে। অর্থাৎ, আমাদের নানা কৃত্রিমতাই আমাদের বাসভূমির এই পুনঃপুনঃ উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা তাপ প্রবাহের জন্য দায়ী। অতএব, এই সংকটের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে হলে রাষ্ট্রনায়কদের সকলের সহমত হয়ে ইতিবাচক ও সমষ্টিগত পদক্ষেপ গ্রহণ ভীষণ জরুরী। তবে ব্যক্তি হিসাবে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত বৃক্ষরোপন ও অরণ্য বিস্তারের কর্মসূচীর সফল রূপায়নের মাধ্যমে পরিস্থিতির যতটা মোকাবিলা সম্ভব, ততটার জন্যই সচেষ্ট হওয়া। আসলে, এই বিপদ কিন্তু একদিনে আসেনি তাই একদিনে সমাধানও সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। তাই এখনই সচেতন না হলে কিন্তু দুর্বিষহ এবং পরিত্রাণ হীন, ভযাল-ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
লেখক : প্রিন্স বিশ্বাস, শিক্ষক নব বালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct