জাইদুল হক, আপনজন: লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সেই তালিকায় ছিল পশ্চিমবঙ্গের তিনটি লোকসভা কেন্দ্র। তবে পরবর্তী ভোটকে কেন্দ্র করে বাংলায় রাজনীতি এখন তুঙ্গে। বিজেপি একা লড়লেও বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোট পশ্চিমবাংলায় হচ্ছে না। ফলে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস ও সিপিএম সহ বাম দলগুলো বিচ্ছিন্ন ভাবে লড়ছে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, দেশে জুড়ে এবার তাদের আসন ৪০০ পার, আর রাহুল গান্ধি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন বিজেপি ২০০ পেরোবে না। মমতার দাবি তৃণমূল গতবারের থেকে বেশি আসন পাবে। কংগ্রেস যদিও রাজ্যে বেশ কয়েকটি আসন পাওয়ার আশা করলেও তারা গতবারের দুটি আসন ধরে রাখার বিষয়ে প্রত্যাশী। অপর দিকে গতবার কোনো আসন না পাওয়া সিপিএম আশার আলো দেখছে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে মুহাম্মদ সেলিমের জেতা নিয়ে।
উল্লেখ্য, এবার পশ্চিমবাংলায় লোকসভার লড়াইয়ে নতুন মুখ নওশাদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আইএসএফ। গত বিধান সভা নির্বাচনে সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চায় শরিক হয়ে আইএসএফ ভাঙড় বিধানসভায় জয়ী হয়েছে। ভাঙড়ের বিধায়ক ফুরফুরার পীরজাদা নওশাদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আইএসএফ এবার লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। যদিও, সিপিএম বা কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের কোনো জোট হচ্ছে না। অবশ্য বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট করেই রাজ্যে লড়ছে। আর জোট নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় সংযুক্ত মোর্চা গঠিত না হওয়ায় ভোট কাটাকাটির আশঙ্কা রয়েই গেছে। তবে, বিধান সভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস নবাগত আইএসএফকে যেভাবে ভোট কাটুয়া বলে অভিহিত করেছিল, এবার প্রায় একইভাবে ভোট কাটুয়া তকমা দিতে শুরু করেছে কংগ্রেস ও সিপিএম। বিশেষ করে সিপিএম সংযুক্ত মোর্চা ভঙ্গের দায় নওশাদ সিদ্দিকীর উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আর তার পরেও ভোট ভাগ করে বিজেপিকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তুলছে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু থেকে শুরু করে পলিটব্যুরো সদস্য মুহাম্মদ সেলিম এমনকি তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীও নওশাদের দলকে ভোট কাটুয়া তকমা দিতে শুরু করেছেন। বিষয়টা নিয়ে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি চলছে।
সম্প্রতি বিমান বসু বলেছেন, আইএসএফ ২০২১ সালে গড়ে উঠেছে। নতুন দল ১২টি আসন চাইছে, যা সম্ভব নয়। তাদের ভোট লড়াইয়ের শক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিমান বসু আইএসএফের বিরুদ্ধে ভোট কাটার অভিযোগ তোলেন। বিশেষ করে বামফ্রন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কোনো আলোচনা ছাড়াই মুর্শিদাবাদে প্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়ায় তেড়েফুঁড়ে ওঠেন ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী মুহাম্মদ সেলিম। মুসলিম অধ্যুষিত এই আসনে মুহাম্মদ সেলিম জিতে যাবেন বলে আগেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন অধীর চৌধুরী। তাই সেলিমের ভোট ব্যাংকে আইএসএফ থাবা বসাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বামফ্রন্ট। যে সেলিম গত বিধানসভায় নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চায় আইএসএফকে শামিল করতে বিশেষ প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আইএসএফ আসলে কার বিরুদ্ধে লড়ছে, বিজেপির বিরুদ্ধে না সিপিএমের বিরুদ্ধে? লড়াইটা হচ্ছে বিজেপির বিরুদ্ধে। কেউ কেউ বিজেপির বিরুদ্ধে বলছে, কেউ কেউ সিপিএমের বিরুদ্ধে। বুঝতে হবে কে কার পক্ষে।
এক ধাপ এগিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ভাঙড়ের বিধায়ককে ‘ছোট ওয়েইসি’ এবং ‘বিজেপির ভোট কাটুয়া’ বলে কটাক্ষ করেছেন। অধীর বলেছেন, আমাদের এখানকার ওয়াইসি এসেছেন! ছোট ওয়াইসি হায়দরাবাদ থেকে এখানে এসেছেন। তিনি এখন অনেক মন্তব্য করবেন। সব বিজেপির ভোট কাটুয়া। বিজেপির পয়সায় ময়দানে নেমেছে।
থেমে নেই তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সম্প্রতি মমতা আইএসএফকে আক্রমণ করে বলেছেন, বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস, আরেকটা নতুন মুসলিমদের দল হয়েছে। যেমন হায়দরাবাদের মিম, বিজেপির থেকে টাকা নিয়ে সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করে নেওয়া ওদের কাজ। যাতে তৃণমূল জিততে না পারে...দয়া করে ওদের চক্রান্তে পা দেবেন না।
তবে, নওশাদ সিদ্দিকী ভোট কাটুয়া তকমা নিতে রাজি নন। নওশাদ বলেছেন, যাঁদের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে বসাতে চাইছি, তাঁরাই আবার পিছড়ে বর্গদের নিয়ে তৈরি দল আইএসএফকে কোণঠাসা করছেন! দুঃখের বিষয়, জানি না কোন দলের মধ্যে কীভাবে আরএসএসের লোক ঢুকে বসে আছে। তবে ভোট কাটাকাটির খেলায় যে বিজেপি রাজ্যের বেশ কিছু আসনে জিততে পারে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। গত লোকসভা ও বিধানসভায় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেহেতু গত লোকসভা নির্বাচনে আইএসএফের অস্তিত্ব ছিল না, তাই ওই নির্বাচনে তাদের ভূমিকা ছিল না। কিন্তু ২০২১ এর নির্বাচনে ভূমিকা ছিল।
উল্লেখ্য, গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির ব্যাপক উত্থান হয়। এমনকি বিধানসভায় নির্বাচনে। তাতে দেখা গেছে ভোট কাটাকাটির জেরেই বিজেপির বহু আসনে জয় এসেছে। এই ভোট কাটুয়ার দলে কোন কোন বিজেপি বিরোধী দলের বিশেষ ভূমিকা ছিল তা ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে। বোঝা যাবে আসলে ভোট কাটুয়া কারা আইএসএফ, সিপিএম না কংগ্রেস?
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৮টি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। আর সেই সূত্রেই বিজেপি ২০২৪ নির্বাচনেও দাবি করছে তাদের আসন বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিজেপির ১৮টি আসনে পিছনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রয়েছে সিপিএমের। তারপরে কংগ্রেসের। হ্যাঁ বিষয়টি অবাক করতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলের তথ্য সেই কথাই বলছে। বাম দল ও কংগ্রেস যদি ভোট কাটাকটিতে ভূমিকা না নিত তাহলে তৃণমূলের অন্তত আটটি লোকসভা আসন বাড়ত। আর বিজেপির কমে যেত আটটি আসন। বিজেপি পেত মাত্র ১০টি আসন।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের তথ্য বলছে, বালুরঘাট, ব্যারাকপুর, বিষ্ণুপুর, বর্ধমান-দুর্গাপুর, হুগলি, ঝাড়গ্রাম ও রায়গঞ্জে বিজেপির জয়ের মূলে বাম দলগুলির ব্যাপক ভোট। বালুরঘাটে বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত মজুমদার ৬০,৬৯৬ ভোটে জিতেছিলেন। কিন্তু আরএসপি প্রার্থী রনেন বর্মন পেয়েছিলেন ৭২,৯৯০। ভোট কাটাকাটিতে জিতে যান সুকান্ত। যে ব্যারাকপুরে অুর্জন সিং বিজেপির টিকিটে জেতার ব্যাপারে এবারও প্রত্যাশী তার জেতার ভিত্তি ছিল সিপিএমের ভোট কাটার উপর। ২০১৯-এ অর্জুন সিং জিতেছিলেন ১৪, ৮৫৭ ভোটে। কিন্তু সিপিএম প্রার্থী পেয়েছিলেন ১,১৭,৪৫৬ ভোট। তার ফায়দা তোলেন অর্জুন সিং। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে সৌমিত্র খাঁ জিতেছিলেন ৭৮,০৪৮ ভোটে। সেখানে সিপিএমের সুনীল খান ১,০২,৪৫৬ ভোট পেয়ে বিজেপির জয়ে পথ সহজ করে দেন।
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের ডা, মমতাজ সংঘমিতাকে বিজেপির এস এস আহলুওয়ালিয়া হারান মাত্র ২,৪৩৯ ভোটে। কিন্তু সিপিএম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য ১,৬৭,৫৯০ ভোট পাওয়ায় মমতাজের জেতার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। হুগলি কেন্দ্রে লকেট চ্যাটার্জি বিজেপির টিকিটে ৭৩,৩৬২ ভোটে জেতেন, যেখানে সিপিএমের প্রদীপ সাহা ১,২১,৩৬২ ভোট পান। ঝাড়গ্রামে বিজেপির কুনার হেমব্রেম ১১,৭৬৭ ভোটে জিতেছিলেন। অথচ, সিপিএমের দেবলীনা হেমব্রেম পেয়েছিলেন ৭৫,৬৮০ ভোট। একইভাবে রায়গঞ্জেও ভোট কাটাকাটিতে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরি। তিনি ৮৪,২৮৮ ভোট পেলেও সিপিএমের মুহাম্মদ সেলিম ১,৮২,০৮৫ ভোট পেয়েছিলেন।
অপরদিকে, মালদা উত্তর কেন্দ্রে বিজেপির খগেন মুর্মু জেতেন ৮৪,২৮৮ ভোট। কিন্তু কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরি ৩,০৫,২৭০ ভোট পাওয়ায় তৃণমূলের মৌসুম নূর হেরে যান। এই আটটি কেন্দ্রে ‘ইন্ডিয়া’ জোট হলে বিজেপির পরাজয় প্রায় সুনিশ্চিত ছিল।
আর গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সিপিএম ও কংগ্রেসের ভোট ভাগাভাগি না হলে বিজেপির আসন ৭০ থেকে ৪৭টি আসন কমে যেত। আর তৃণমূলের আসন বেড়ে যেত ৪৭টি। তাই বিজেপিকে হারাতে বাংলায় ইন্ডিয়া জোটের প্রয়োজনীয়তা ছিল।
সেজন্য ইন্ডিয়া জোট না গড়ার খেসারত দিতে হতে পারে তৃণমূল, কংগ্রেস ও সিপিএমকে। তাই ভোট কাটুয়া হিসেবে আগেভাগে আইএসএফের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে। তারা হয়ত ভাবছেন বিজেপির জয়ের মূলে হয়ত আইএসএফের ভোট কাটাই আসল হয়ে উঠবে। অথচ, গত বিধানসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে ভাঙড়ে জেতা ছাড়াও ছটি বিধানসভা কেন্দ্রে আইএসএফ প্রভাব ফেলেছিল। তার তিনটিতে ছিলেন মুসলিম প্রার্থী আর তিনটিতে ছিলেন হিন্দু প্রার্থী। এই ছটি কেন্দ্রে আইএসএফ ব্যাপক ভোট পাওয়ার কারণে তৃণমূলের জয় হয়, আর বিজেপির হার হয়। তাই আইএসএফ যে শুধু মুসলিম ভোট পায় সেই ধারণা নাও মিলতে পারে। তার সপক্ষে আইএসএফ চেয়ারম্যান সম্প্রতি এক শীর্ষ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আইএসএফকে শুধু মুসলিমদের দল বললে ভুল হবে, আইএসএফ তফশিলি জাতি উপজাতি, আদিবাসী, দলিত শ্রেণি তথা দরিদ্র অবহেলিত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই সঙ্গে তিনি ভোট কাটুয়া তকমারও বিরোধিতা করেন। যদিও ২০২৪-এর ভোটে বাংলায় ইন্ডিয়া জোট না হওয়ার ফায়দা লুটতে পারে বিজেপি। তখনই বোঝা যাবে প্রকৃত ভোট কাটুয়া কোন দল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct