একজন হত্যাকারীর অতিপ্রাকৃত জবানবন্দি
আহমদ রাজু
‘ইরাম করে যদি চলতি থাহে তালি কয়দিন পরে হয়তো পুরো গাইদগাছি গ্রামডাই কুহুর শূন্য হয়ে যাবে। ওষুধ খাওয়ার জন্যি এট্টা কুহুরও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ কথাটা বলে ফিক করে হেসে ওঠে ছবেদ মল্লিক। সে বরাবরই একজন রসিক মানুষ। সিরিয়াস কথার ভেতরেও রহস্য জুড়ে দেয়। যে কারণে সময়-অসময় হাসির রোল পড়ে যায় মোড়ের মাথার এই চায়ের দোকানে।বাদ সাধে কাদের মেম্বার। সে সবেমাত্র বড় সাইজের একটা পানের খিলি জোর করে মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কথা বলতে না পেরে হাত ইশারা করে থামতে। তারপর মিনিট খানেক দু’পাটি দাঁত উপর নিচে করে দোকানের দক্ষিণ দিকে ঝুকে ফিচ্ করে পিক ফেলে। ততক্ষণে সবাই নীরব। কেউ কোন কথা বলে না। অথচ কিছুক্ষণ আগে সরগরম ছিল দোকানের সামনে পাতানো বেঞ্চগুলো। বয়সে অনেকের ছোট হলেও কাদের মেম্বারকে গ্রামের লোকে সমীহ করে, ভালবাসে। তবে কেউ কেউ যে ঘৃণা করে না একথা বলা যাবে না। যদি ঘৃণা না করবে তাহলে পরপর তিনবার বিজয়ী হাদু মেম্বারের সাথে মাত্র ষোল ভোটের ব্যবধান থাকবে কেন? ‘কাহা তুমি ইডা কী কতা কলে?’ বার দু’য়েক মুখের ভেতরে জমে থাকা পানের রস গিলে কথাটা বলল কাদের মেম্বার।মেম্বারের কথা শুনে ছবেদ মল্লিক বোকা বনে যায়। নিজে কি কিছু ভুল বলেছে? আসলেইতো বেশ ক’দিন থেকে এলাকায় একটা কুকুরও দেখা যায় না। ঘরের উত্তর কোনায় চালতা গাছের নিচে প্রতিদিন যে খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলা হয় তা সেভাবেই পড়ে থাকে। কেউ যেন ছুঁয়েও দেখে না। বরং সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় প্রতিনিয়ত। অথচ একসময় সেখানে কুকুরের দল সময়-অসময় খাবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে নিজেদের ভেতরে কামড়া কামড়ি করতো! তাদের যত্রতত্র দেখা যেতো, রাস্তার মোড়ে, উষাদের বাঁশ বাগানে, রান্নাঘরের পেছনে, মল্লিক বাড়ির উত্তর ভিটায়!ছবেদ মল্লিকের মুখ দেখে নুরু মুন্সী বুঝতে পারে, মেম্বারের কথায় তার মনটা ছোট হয়ে গেছে। সে ছবেদ মল্লিকের সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ‘মেম্বার তুমি এলাকায় থাহোনা না কী? কয়দিন আগেও এহানে দু’চারটে কুহুর সবসুময় ঘুরাফিরা করতো। কেউ কিছু ফেললিই তারা হুমড়ি খায়ে পড়তো। এহন সারা এলাকা ঘুরে যদি এট্টাও খুঁজে পাও তালি আমার নাম তুমরা পাল্টায় রাখপা।’যেদিকে পানের পিক ফেলেছিল সেদিকে ততক্ষণে একজন ইজিবাইক চালক এসে দাঁড়িয়েছে। কাদের মেম্বার তার ঘাড় আলতো করে ধরে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে পিক ফেলে বলল, ‘আমারে তো কথা কওয়ার সুযোগ দিবা; নাকি তার আগেই তুমরা বিচার বিশ্লেষণ করে ফ্যালবা? মেম্বার তো আমি, না কী?’দু’জনের সম্মানে আর একবার ধাক্কা লাগে। তারা মুখ থেকে কোন কথা বের না করলেও পাশের একজন বলল, ‘তাইতো; মেম্বাররে আগে কথা কতি দিতি অবে। অত বুঝলি চলবে ক্যানো?’মেম্বার এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। অল্প বয়সী একজনের উদ্দেশে বলল, ‘এই এট্টু সরে বয় তো।’ ছেলেটি উঠে পশ্চিম পাশের বেঞ্চে যেয়ে বসলে কাদের মেম্বার সেখানে বসে বলল, ‘কাহা তুমি যিডা কয়ছো সিডা ঠিক না। কুহুর শূন্য অবে মানে কী; কুহুর শূন্যতো এহনি হয়ে গেচে। আমার দফাদার সেদিন সারা এলাকা ঘুরে এট্টাও কুহুরির অস্তিত্ব পায়নি। আমার বুজি আসে না, ফটকে একা অতগুলো কুহুর মারলো কীরাম করে?’
এই একই প্রশ্ন অনেকের মনের মাঝে ঘুরপাক খেলেও কোন উত্তরই মনোপূত হয় না। একটা মানুষের পক্ষে শতশত কুকুর কীভাবে মারা সম্ভব? তার প্রাণটাইবা কেমন? একবারও হাত কাঁপে না! অনেকেই বলে- ওর মাথা খারাপ। যদি মাথা খারাপ হয় তাহলে শুধু কী কুকুর মারার ক্ষেত্রেই? অন্য সব কাজে সে একদম স্বাভাবিক একজন কর্মঠ মানুষ। ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও আয় রোজগার একেবারে কম নয়। এর অর্থ এই নয় যে, বছরে দশ বিশ হাজার টাকা জমিয়ে রাখে। শুধু দিনটা তার চলে যায় এই যা। অন্তত ধার-দেনা তো করতে হয় না। আগে একসময় ছিল গেরস্থরা বাড়িতে কুকুর-বিড়াল পুষতো। সেটা বেশি আগের কথা নয়- পনের বিশ বছর হবে হয়তো। এখন আর সে চল তেমন একটা দেখা যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ির কোনায় কোনায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো। কুকুরের কাজ এখন ক্যামেরা দিয়ে করানো হয়। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-কলকারখানার কথা না হয় বাদই দিলাম। সেখানেতো বিভিন্ন ইলেকট্রিক ডিভাইজের এলাহি কাণ্ড।‘ওর মারার কৌশোলই আলাদা। এক পাড়ার কুহুর মারতি খুব বেশি সময় লাগে না। ফুড়াডান পাউরুটির সাথে মিশেই দিলি কিছুক্ষণ পরে শ্যাস! ওর মনে এট্টুও নাড়া দেয় না! আমি বহুবার কইছি, ফটকে এবার ক্ষ্যান্ত হ। উপরে একজন আছে; সে কিন্তু সব দেখতেছে। এর শাস্তি একদিন না একদিন তোর পাওয়াই লাগবে। কার কথা কিডা শোনে।’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল নুরু মুন্সী।‘এই নবি এট্টা পান দেতো?’ মেম্বারের বলতে যত সময় লাগলো তার আগেই নবি দোকানের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে তার দিকে একটা পানের খিলি এগিয়ে দেয়। মেম্বার সেটি হাতে নিয়ে মুখের ভেতর পুরে দুই আঙ্গুল দিয়ে ঠেসে দেয়। তারপর নিচের দিকে ঝুঁকে একটা পান থেকে বোটা ছিঁড়ে তাতে খানিক চুন মাখিয়ে হা করে দাঁতে লাগিয়ে বার কয়েক পেষণ দেয়। বলল, ‘ইউনিয়ন পরিষদেরতে তারে অনডিং দিলিও থামানো যায়নি। অবশ্যই শুধু ওর দোষ দিয়া যাবে না; এলাকার মানষির দোষ একদম কম না।’ হঠাৎ রিং বেজে ওঠায় উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে কথা বলতে বলতে আঁধারের মাঝে মিলিয়ে যায়।
মেম্বার একদম ঠিক বলেছে। ফটকে কুকুর মারতে পারে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তবে সে সবসময় ইচ্ছে করে মারে তা নয়। যে পাড়ায় কুকুরের উৎপাত বেশি সেখানেই তার ডাক পড়ে। কখনও কখনও এমন হয়েছে যে, প্রতিনিয়ত পাড়ার হাঁস-মুরগী খেয়ে সাবাড় করছে কুকুরের দল। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট এলাকাবাসী। দলীয় সন্ত্রাসীদের মতো তারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় এপাড়া ওপাড়া, যাকে সামনে পায় তার দিকে তেড়ে আসে। ওদের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া দস্কর হয়ে পড়ে। স্কুল-কলেজগামী ছেলে মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধের উপক্রম। কুকুরের কামড়ে যখন ভ্যাক্সিনের অভাব তৈরি হয়, যখন সেখানকার মানুষগুলোর আর কোন পথ খোলা থাকে না তখনি ডাক পড়ে ফটকের। নামমাত্র টাকা দিলেই সে খাবারের মধ্যে ফুড়াডান দিয়ে এলাকাবাসীকে মুক্ত করে- তাদের মাঝে এনে দেয় শান্তির বারতা। এভাবে বহুদিন ধরে সে হত্যাযজ্ঞ চালাতে চালাতে বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আপাতদৃষ্টিতে কুকুরের দেখা পাওয়া কষ্টসাধ্য। ক’দিন থেকে ফটকে কেমন যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। জামায়াতের সাথে চার ওয়াক্ত নামাজ পড়ে খানপাড়ার মসজিদে; শুধু ফজরের ওয়াক্ত বাদে। বরাবরই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস থাকলেও এখন বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের মুখ না দেখে ঘর থেকে বের হয় না। এই ফটকের সাথে সেই ফটকের বিস্তর ফারাক। তার শরীরে-মনে সেই জৌলুস নেই- নেই কুকুর নিধনের তীলছায়া। কুকুর মেরে সাবাড় করলেও কোন বিড়ালের গায়ে আঘাত করেনি আজ পর্যন্ত; তবে যখনি যে অবস্থায় থাকুকনা কেন বিড়াল দেখলে দাবড়ানি দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছে। এখন তার সামনে সময় অসময় বিড়াল ঘুরে বেড়ালে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। শুধু কী তাই? সেদিন বাজারে হরিহরের কাপড়ের দোকানে অপরিচিত একজন বয়স্ক ব্যক্তি তাদের এলাকায় কুকুরের উৎপাতের কথা বললেও সেদিকে সে কর্ণপাত করেনা! কী হলো- কেন হলো এলাকায় এ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা! ফটকে কী তাহলে সাধু হয়ে গেল? কেউ কিছু বললে উত্তর দেয় না, ভাল করে কথা বলে না। আর কুকুরের কথা? সে তো না-ই। বরঞ্চ তার সামনে কুকুর নিয়ে কথা বললে ক্ষেপে উঠে। প্রথম যেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল সেদিন ছিল অমাবশ্যা। সারাদিন ভালভাবে চালিয়ে রাতে বাড়ি এসে ভ্যানগাড়িটা উঠানে তালা মেরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখে। যেন শিশির কণা সদ্য করা রঙ নষ্ট করতে না পারে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে যেয়ে ভ্যানের দিকে চোখ ফেলতেই তার চক্ষু ছানাবড়া। টায়ার টিউব থেকে শুরু করে সিট পর্যন্ত সবই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। দেখে বোঝা যায়, কোন হিংস্র জন্তুর তীব্র দাঁতের প্রতিশোধ! মানুষের পক্ষে অন্তত এভাবে সম্ভব নয়। কে করতে পারে এমন কাজ! তার সাথে এমন কারো শত্রুতা নেই যার দ্বারা এ ন্যাক্কারজনক কাজ সম্ভব। অন্তত মানুষের দ্বারাতো নয়ই। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
অধিকাংশ বাড়িতে মটরসাইকেল থাকায় প্রকৃত যাত্রী সংখ্যা অনেক কম। তার ওপরে এই বিপর্যয় বেশ খানিকটা সমস্যায় ফেলে ফটকে কে। ক’দিন আগেও এমন ছিল না। রাস্তায় উঠলে যাত্রীতে ভ্যান ভরে যেতো। কপাল পুড়লো নতুন রেললাইনের কাজ শুরু হওয়ায়। জমি অধিগ্রহণের টাকা পেয়ে যার একেবারে প্রয়োজন নেই সেও একটা মটরসাইকেল কিনেছে। ভ্যান গ্যারেজে কোনমনে টেনে নিয়ে গেলে মিস্ত্রিতো দেখে অবাক। ভ্যানের সাথে যে এমন হতে পারে তা সে কোনদিন ভাবতেই পারেনি। প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মেরামত করে দিলে তার কোন ক্ষতি না হয়! অনেক অনুরোধ করার পর সে অবশ্য মেরামত করে দিয়েছিল। গত পনের দিন সমস্যা মুক্ত ছিল। ফটকের ধারণা- কোথাও থেকে হয়তো কুকুর- শেয়ালের দল এসে ভ্যানের এমন অবস্থা করেছে। রাগে তার শরীর জ্বলে ওঠে। এবার আসলে তাদের নিস্তার নেই। ডোজ বেশি দিয়ে ব্যবস্থা একটা নিতেই হবে।সে পাউরুটির সাথে ফুড়াডান মিশিয়ে ভ্যানের আশপাশে রেখে অপেক্ষায় থাকে প্রতিনিয়ত। যেদিন আসে সেদিন চাঁদের আলোয় আলোকিত রাতের নির্জনতা। বেশ দূরে দেখা যায় স্পষ্ট। এর মধ্যে এক পসলা বৃষ্টি সবার কাছে আশির্বাদ স্বরূপ। গরম অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। মাঝ রাতে হঠাৎ আকাশ মন খুলে ভিজিয়ে দেয় মাঠ ঘাট প্রান্তর। প্রায় শেষ রাত; ফজরের আজান দিতে আরো আঠারো মিনিট বাকী। হঠাৎ বাইরে মরমর শব্দ হওয়ায় বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভ্যানের দিকে তাকাতেই ফটকের পিলে চমকে যায়। বাড়ির পূর্ব কোনায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী! তার ভেতর থেকে একেরপর এক কুকুর বেরিয়ে এসে ভ্যানের ওপর আক্রমন করছে! এটা কীভাবে সম্ভব। ইয়া বড় বড় কুকুরের রং কুচকুচে কালো। সবাই একসাথে ধ্বংসযোগ্য চালালেও কারো মুখে কোন শব্দ নেই। সবকিছু ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তারা আবার ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতরে যেয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। অসাড় হয়ে গিয়েছিল ফটকে। যে দৃশ্য তার চোখের সামনে অবমুক্ত হয়েছিল, তা সে আগে কোনদিন দেখাতো দূরের কথা, ভাবেওনি। পা তার যেন চলতেই চায় না। মুখেও কোন কথা নেই। অনেক চেষ্টা করেও কোন কথা বের হয় না। কাছেই স্ত্রী-সন্তান শুয়ে থাকলেও তাদের ডাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে মুহূর্তে। সে জানে, এ এলাকায় ওমন কুকুর একটাও নেই। অন্য এলাকা থেকে এসে তার ক্ষতি করবে তাও বিশ্বাস হয় না। তাহলে কী এসেছিল? কোথা থেকে এসেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সে নিজেকে আবিষ্কার করে অন্য এক জগতে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct