ডা. শামসুল হক, আপনজন: অভিজাত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম তাঁর। ইংরেজ আমলের এক জমিদার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তাঁর পিতা। ছিলেন একজন সরকারী কর্মীও। তবে ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করলেও সেই সরকারের কাছে তিনি নিজেকে কখনও বিকিয়েও দেননি। আর নিজের ছেলেকেও তিনি মানুষ করেছিলেন ঠিক সেই ভাবেই। তিনি হলেন স্বাধীনতা আন্দোলনেরই মহান সৈনিক রফি আহমেদ কিদওয়াই। পরিচিত ছিলেন সংগ্ৰামের এক মূর্ত প্রতীক এবং সফল একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবেও। নিজের দেশের মঙ্গল কামনায় সারাটা জীবন ধরে তাঁর সেই আপোষহীন সংগ্ৰামের কথা তাই এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে রেখেছেন সমস্ত দেশবাসীও। শুধু তাই নয়, দেশের হতদরিদ্র কৃষক সমাজের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা এবং আর্থিক বুনিয়াদকে মজবুত রাখার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটিও ছিল না তাঁর।
১৮৯৪ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি জন্ম তাঁর উত্তর প্রদেশের বড়বাঁকী জেলার মাসাউনি গ্ৰামে। প্রাথমিক শিক্ষার শুরু গ্ৰামের স্কুলেই এবং তারপর তাঁর স্কুল পর্বের পড়াশোনা শেষ হয় সরকার পরিচালিত স্থানীয় একটা হাইস্কুল থেকেই। স্কুলের পর শুরু হয় তাঁর কলেজ জীবন। ভর্তি হন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন অবশ্য সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত ছিল আলিগড় মহামেডান অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কলেজ, সেই নামেই। ১৯১৮ সালে সেখান থেকেই স্নাতক হন তিনি। তারপর ভর্তি হন আইন কলেজে। কিন্তু সেই পর্বের পড়াশোনা আর শেষ করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। কারণ নতুন সেই শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার কাজ চলাকালীনই পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার জন্য দেশের অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্ৰামীদের সঙ্গে তখন তিনি এমনইভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তখন পড়াশোনায় আর মন বসানোও সম্ভব হচ্ছিল না তাঁর পক্ষে এবং একটা সময় ভুলেও গিয়েছিলেন কলেজের পথও। আর সেই কারণে তখন ভীষণভাবে হতাশ হয়েছিলেন তাঁর পরিবারের সকল সদস্যরাও। স্বাধীনতা আন্দোলনের মুক্ত মঞ্চটাই তখন যেন চুম্বকের মতো আকর্ষিত করছিল সেই কলেজ পড়ুয়াকে। তাই একসময় সেই ঠিকানাটাকেই বেঁচে থাকার আসল উপায় বলেই ভেবে নিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি অবশ্য যোগাযোগ ছিল রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও। পরিচয় হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গেও এবং তারপর তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন ধারাও।১৯২০ সাল, রফি আহমেদ কিদওয়াই তখন বাইশ বছরের তরতাজা তরুণ একজন স্বাধীনতা সংগ্ৰামী। নাম লেখান খিলাফত আন্দোলনে। তখন আবার তাঁর সামনে পথ প্রদর্শক হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীও। তাই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঈপ্সিত লক্ষ্যেরই দিকে। ইংরেজ সরকারের নানান কাজকর্মে ভীষণভাবে ক্ষিপ্তও হয়ে উঠছিলেন তিনি। তাই তার বিরুদ্ধেই তখন চলছিল তাঁর আপোষহীন সংগ্ৰামও। আর সেইসব সংবাদ সঠিক সময়ে পৌঁছে যাচ্ছিল ব্রিটিশ রাজ দরবারেও। ফলে ঘটনা যা ঘটার ঘটলও তাই। মিথ্যা অভিযোগে গ্ৰেপ্তারও করা হল তাঁকে। নিক্ষেপ করা হল কারাগারের অন্ধকারেও। কিন্তু তাতে তেজ কমেনি রফি আহমেদের। ১৯২২ সালে মুক্তি পান তিনি। তারপর চলে যান এলাহাবাদে। সেখানে মতিলাল নেহেরুর সচিব হিসেবে কাজে যোগ দেন। আর সেইভাবে কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা বছরও। কিন্তু সংগ্ৰামী মন তাঁর, তাই যখন তখনই সেই মন আবার ছুটে চলত সেইসব সৈনিকদেরই কাছে, যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। অতএব আর না, নিজের কর্তব্য তখন নিজে নিজেই ঠিক করেও নিয়েছিলেন তিনি। তাই সব কাজ ছেড়েই আবারও তিনি ফিরে আসেন তাঁর সেই পুরাতন আখড়াতেই।
সেইসময় আবার রায়বেরেলির কৃষকদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল নানান ক্ষোভও। সেটা ১৯২৬ সালের কথা। একটা সময় বিদ্রোহের আগুন যখন একেবারে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তখন আর চুপচাপ বসে থাকেননি তিনি। সময় বুঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদেরই পাশে। তারপর সকলে মিলে জেহাদ ঘোষণা করেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সেইসময় সেই সরকার গরীব চাষীদের উপর ধার্য করছিল মাত্রাতিরিক্ত খাজনাও। আর তারই প্রতিবাদে সেদিন সকলকে নিয়েই তিনি নেমে পড়েছিলেন একেবারে সন্মুখ সমরেই।গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল রফি আহমেদ সহ প্রতিবাদী আরও অনেককেই। আদালতে চালান করেও দেওয়া হয়েছিল। চলেছিল বিচারের নামে প্রহসনও। তারপর ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল রফি আহমেদ কিদওয়াই সাহেবকে।জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবারও দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। অবশেষে আসে সেই প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন দেশের সব প্রান্তের মানুষজনও। শুরু হয় নতুনভাবে দেশ গঠনের কাজও। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। সেই মন্ত্রীসভারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বিভাগ, যোগাযোগ দপ্তরের দায়িত্বও তুলে দেওয়া হয় তাঁরই হাতে।শুরু হয় নতুন জীবন। খুঁজে পান দেশ সেবার সেরা উপায়টিও। আর সেই ভাবেই অতি নিশ্চিন্তেই পৌঁছে যান সব শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ের অনেক কাছেও। কিন্তু সেইভাবে চলতে চলতেই হঠাৎই ঘটে বিশাল এক অঘটন। আসে সেই অভিশপ্ত ২৪ শেষ অক্টোবর, ১৯৫৪। সেদিন একটা জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি। মঞ্চেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁর। তারপরই বন্ধ হয়ে যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াও। মাত্র ষাট বছর বয়সেই এই পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নেন তিনি। তাঁর নিজের জন্মভূমিতে নিজস্ব গোরস্থানেই সমাহিত করা হয় তাঁকে।দেশের কৃষক সমাজের জন্য তিনি চালিয়েছিলেন আজীবন সংগ্ৰাম। তাই তাঁর সন্মনার্থে ১৯৫৬ সালে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানেই ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদ কৃষিক্ষেত্রেরই গবেষকদের স্কীকৃতি দেওয়ার জন্য গঠন করা হয় একটা নতুন কমিটি। আর তাঁদের মাধ্যমেই দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় পুরস্কারও। দুই বৎসর অন্তর অন্তর পদক এবং নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমেই সন্মানিত করা হয়ে থাকে সেই পুরস্কার প্রাপককে।দেশের অনেক জায়গাতেই আছে তাঁর নামে অনেক রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে । মুম্বাই শহরের ওয়াদালয়ে এবং কলকাতার ওয়েলিংটনের কাছের রাস্তার নাম রাখা হয়েছে তাঁরই নামে এবং সেটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বেরও ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct