আপনজন ডেস্ক: বুধবার তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করেছে, যেখানে একাধিক সমাজকল্যাণমূলক পদক্ষেপ এবং কেন্দ্রে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে সিএএ প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। দলের সদর দফতরে ইস্তেহার প্রকাশ করেন অমিত মিত্র, ডেরেকও ব্রায়েন ও চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, পরবর্তী সরকার গঠনের সময় ইন্ডিয়া ব্লকের অঙ্গ হিসাবে আমরা এই প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করব। তিনি বলেন, আমরা প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠনের মাধ্যমে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাতিল করার এবং দেশে এনআরসি অনুশীলন বন্ধ করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। বাড়ি বাড়ি রেশন ও বিপিএল পরিবারগুলির জন্য ১০টি রান্নার সিলিন্ডার বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দল। বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে মতবিরোধের জেরে জানুয়ারিতে ইন্ডিয়া জোট থেকে বেরিয়ে যায় তৃণমূল। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন দল জানিয়েছে, জাতীয় স্তরে তারা এখনও ইন্ডিয়া জোটের অংশ। তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তেহারটি মোট ১০৪ পাতার। ইস্তেহারের প্রথম পাতায় তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সহ স্লোগান রাখা হয়েছে, ‘জনগণের গর্জন, বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন, তৃণমূল করবে অধিকার অর্জন।’ ইস্তেহারের প্রথমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদন তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ‘দিদির শপথ’ শিরোনামে ১০টি প্রধান প্রতিশ্রুতির সারকথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
এই দশটি প্রতিশ্রতি হল:
বর্ধিত আয়, শ্রমিকদের সহায়
সমস্ত জব কার্ড হোল্ডারদের ১০০ দিনের গ্যারান্টিযুক্ত কাজ প্রদান করা হবে এবং সমস্ত শ্রমিকরা দেশজুড়ে দৈনিক ৪০০ টাকা বর্ধিত ন্যূনতম মজুরি পাবেন।
দেশ জুড়ে বাড়ি, হবে সবারই
দেশের সকল দরিদ্র পরিবারের জন্য আবাসন নিশ্চিত করা হবে, প্রত্যেককে নিরাপদ ও পাকা বাড়ি প্রদান করা হবে।
জ্বালানির জ্বালা কমবে, দেশের জ্বালা ঘুচবে
প্রত্যেক বিপিএল পরিবারকে বছরে বিনামূল্যে ১০টি সিলিন্ডার দেওয়া হবে। যাতে তারা পরিশ্রুত রান্নার জ্বালানি পেতে পারে। এর মাধমে পরিবেশ বান্ধব রন্ধন প্রক্রিয়া ব্যবহারের অভ্যাস বাড়ানো হবে।
অনেক হয়েছে শাসন, এবার দুয়ারে রেশন
প্রতিমাসে প্রত্যেক রেশন কার্ড হোল্ডারকে ৫ কেজি বিনামূল্যে রেশন (চাল, গম, শস্য) প্রদান করা হবে। রেশন প্রত্যেক সুবিধাভোগীর দোরগোড়ায় বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া হবে।
আমাদের অঙ্গীকার, নিরাপত্তা বাড়বে সবার
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যুবকদের উন্নতির স্বার্থে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, তপশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্তদের জন্য উচ্চশিক্ষা বৃত্তি বৃদ্ধি করা হবে। ভারতের ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বিদ্যমান বার্ধক্য ভাতা বৃদ্ধি করে প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা (বার্ষিক ১২,০০০ টাকা) করা হবে।
বর্ধিত আয় নিশ্চিত এবার, ফুটবে হাসি অন্নদাতার
স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে, ভারতের কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের আইনত গ্যারান্টি দেওয়া হবে, যা সমস্ত ফসলের উৎপাদনের গড় খরচের চেয়ে কমপক্ষে ৫০% বেশি ধার্য করা হবে।
স্বল্পমূল্যে পেট্রোপণ্য, ভারতবর্ষে সকলে ধন্য
পেট্রল, ডিজেল এবং এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সাশ্রয়ী মূল্যে সীমাবদ্ধ করা হবে। দামের ওঠানামা পরিচালনা করার জন্য একটি ‘প্রাইজ স্টেবিলাইজেশন ফান্ড’ তৈরি করা হবে।
নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ অর্জন, যুবশক্তির গর্জন
২৫ বছর পর্যন্ত সকল স্নাতক এবং ডিপ্লোমা হোল্ডারকে তাঁদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে ১ বছরের শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। শিক্ষানবিশদের অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের সহায়তা করার জন্য একটি মাসিক বৃত্তি প্রদান করা হবে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রদান করা হবে।
স্বচ্ছ আইন, স্বাধীন ভারত
ধোঁয়াশাযুক্ত সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) বিলুপ্ত করা হবে এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স (এনআরসি) বন্ধ করা হবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) ভারত জুড়ে প্রয়োগ করা হবে না।
এগিয়ে বাংলা, এগোবে ভারত
বাংলার কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৩-১৮ বছর বয়সি মেয়েদের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১,০০০ টাকা এবং এককালীন ২৫,০০০ টাকা অনুদান দেওয়া হবে। বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমস্ত মহিলাকে মাসিক আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমাটির বদলে একটি উন্নততর স্বাস্থ্য সাথী বীমা চালু করা হবে। যা ১০ লক্ষ টাকার বীমার সুবিধা প্রদান করবে। এছাড়া প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজ্যের উন্নয়ন প্রসঙ্গ ছাড়াও সংখ্যালঘুদের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল সাচার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন। উল্লেখ্য, ২০০৬ তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের আমলে প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র স্চারের নেতৃত্বাধীন সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেই রিপোর্টে দীর্ঘ বাম শাসনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের দুর্দশার চিত্র ফুটে ওঠে। এর পর ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে সাচার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই দাবির সপক্ষে ওবিসি-এ সংরক্ষণ চালু করে রাজ্য সরকার। এরপর বিভিন্ন সময় রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের সিংহভাগ করা হয়েছে বলে তৃণমূল সরকার দাবি করে। তার এক দশক পর ফের সাচার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল এবারের তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তেহারে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি তৃণমূল সরকারের আমলে সাচার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি? যদিও ইস্তেহারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার আবেদনে বলেছেন, যদি আমরা (INDIA) কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসি, আমরা সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী (হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ, ইত্যাদি), তপশিলি জাতি (রাজবংশী, নমশূদ্র, বাগদি, ইত্যাদি), তপশিলি উপজাতি (সাঁওতাল, ওরাওঁ, ভুটিয়া, ইত্যাদি)-দের স্বীকৃতি নিশ্চিত করে ভারতের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য বজায় রাখব। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, সাধারণ শ্রেণি, প্রান্তিক এবং ভাষাগত সম্প্রদায়গুলি দেশজুড়ে সুসামঞ্জস্য বজায় রেখে সহাবস্থান করে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ‘বহিরাগতদের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই যারা আমাদের শান্তি ও সম্প্রীতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct