পাভেল আখতার, আপনজন: সেজন্য ধর্মকেই ‘যত নষ্টের গোড়া’ মনে করে দূরে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা অর্থহীন ও শিশুসুলভ আচরণ মাত্র। ‘ধর্মমুক্ত মানবতা’র কথা যারা বলে তারা সম্ভবত এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, ধর্ম ও মানবতা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন দুটি বস্তু! কিন্তু তা তো নয়। কথাটাই অযৌক্তিক। ধর্মের যথাযথ অনুসরণে উজ্জ্বল মানবতার বিপুল দৃষ্টান্ত যেমন আছে, তেমনই ধর্মের বর্ম পরে চূড়ান্ত অমানবিকতার নিদর্শনও ইতিহাসে অনেক আছে। অতএব, ‘ধর্ম’ ও ‘ধর্মের বর্ম’--এই দুটির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হলে তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির, ধর্মের নয়। ‘ধর্ম’ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ও যথাযথ ধারণার অভাবেই যে বহু মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় তারই অভিব্যক্তিগুলি উপরিউক্ত আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়! নজরুলের অনেক কবিতায় ‘ধর্মের বর্ম’ পরিহিত মানুষের কঠোর সমালোচনা আছে, যারা ধর্ম থেকে মনুষ্যত্ব বা মানবতার পাঠ নিতে পারে না, যাদের ধর্মচর্চা যান্ত্রিক ও ধর্মস্থানের সংকীর্ণ চার-দেওয়ালের মাঝে বন্দী। এবং, এইসব ‘বকধার্মিক’দের দেখে কবির ক্রোধ যে ওইসব ‘ধর্মস্থানের’ উপরেও গিয়ে পড়েছে কখনও কখনও, কবির সেই ক্রোধটা আদতে কিন্তু ‘ধর্মস্থানের’ উপরে নয়, ধর্মের প্রতিও নয় ; বরং সেটা ‘ধর্মের যান্ত্রিক অনুসারী’ মানুষের উপরে। কবি ধর্মের মূল শিক্ষাটাই বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। সেটা কী? মানবতাবাদ। যুগপুরুষদের আনীত ধর্মের মূল শিক্ষার দিকে মানুষকে ধাবিত করানোই যে মূল লক্ষ্য তা কবি ‘মানুষ’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন অতি চমৎকার শৈলীতে। ‘ধর্ম’ তাঁর কাছে কখনও ‘চোখের বালি’ ছিল না, ছিল যান্ত্রিক ধর্মচর্চা ও ধর্মের নামে অধর্মের অনুশীলন। বামপন্থী দলের রাজনৈতিক নেতা হোক, অথবা বামমনস্ক শিক্ষিত মানুষ, ‘ধর্ম’ নিয়ে অধিকাংশেরই অবস্থানটি মোটের উপর ‘নির্লিপ্ত’ নয়, বরং ধর্মবিরূপতা বা বিরোধিতায় পর্যবসিত। ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে গিয়ে তারা ধর্মের প্রতিই যে বিরূপতা প্রকাশ করে ফেলেন সেটা তাদের একধরনের বুদ্ধির বিকার ও দূরদৃষ্টিরও অভাবকে চিহ্নিত করে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অবশ্যই ঘৃণ্য। তার বিরুদ্ধতা কাম্য। কিন্তু, সেটা করতে গিয়ে ধর্মের প্রতি বিরূপ অবস্থানের জন্য বামপন্থী দল অথবা বামমনস্ক মানুষরা জনবিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। কারণ, ‘ধর্ম’ মানুষের নিভৃত অন্তরে যে শিকড় বিছিয়ে রেখেছে তাকে ‘ধর্মঘৃণা’ দিয়ে উৎপাটিত করা দূরে থাক, বরং এর দ্বারা তারা জনগণের থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য। আরেকটি বিষয় খুব মজার। ‘সাম্প্রদায়িক দল’ চিহ্নিতকরণে একাংশের বামপন্থীদের মূর্খতা। ধর্মের ধ্বনি গায়ে অনুরণিত হলেই যেকোনও দল বা সংগঠন ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে যায় না। এই কথাটা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, সাম্প্রদায়িকতার মূল উপাদান হ’ল ঘৃণা বা বিদ্বেষ। ধর্মীয় দল বা সংগঠন মানেই ঘৃণাপূজারী বা বিদ্বেষ-বিস্তারক এই ভাবনা নেহাতই অপরিপক্ক। তাহলে দলীয় বামপন্থীদের একাংশ ধর্মের গন্ধযুক্ত সমস্ত দল বা সংগঠনকেই ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দিয়ে বসেন কেন? কারণ, সাধারণ মানুষ অত গভীরভাবে সবকিছু ভাবেন না। ফলে, তাদের কাছে এই বার্তা দেওয়া উদ্দেশ্য থাকে যে--দেখো বাপু, আমরা কিন্তু সবাইকেই একচোখে দেখি! আমাদের ‘দেখার দৃষ্টি’-তে কোনও বৈষম্য খুঁজে পাবে না! এই ভুল চিন্তাপদ্ধতির জন্যেই আবার বামপন্থীরা কার্যত বানপ্রস্থে যেতে শুরু করেছেন কি না সেটা ভাবনার বিষয়!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct