পাভেল আখতার, আপনজন: একটি বিতর্ক প্রায়ই ঘনিয়ে ওঠে। বলা হয়, নিজের নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভাবা ঠিক নয়। এটা ভাবার অর্থ অন্য ধর্মকে ছোট করা। কথাটির মধ্যে সারবস্তু কতটা আছে সেটা দেখার আগে প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই ‘ঠিক নয়’ কথাটা কেবল ধর্মকে নিয়েই কেন ওঠে? কেউ যদি বলে যে, তার বাবা বা মা-ই জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাবা বা মা, তার মানে কি, সকলের বাবা বা মাকে ছোট করা হল? কেউ যদি বলে যে, অমুক কবি বা সাহিত্যিক তার কাছে শ্রেষ্ঠ কবি বা সাহিত্যিক, তার মানে কি, অন্যান্য কবি বা সাহিত্যিকদের ছোট করা হল? “মার্কসবাদই একমাত্র মানুষের মুক্তির পথ”--এই বিশ্বাস বহু মানুষের আছে। এই দৃঢ় বিশ্বাস অনুসারে তারা কি মার্কসবাদকেই শ্রেষ্ঠ মতবাদ বলছেন না? এবং, এটা বলার মাধ্যমে তারা কি তাহলে অন্য সমস্ত মতবাদকে ছোট করছেন না? এই তালিকা আর বড় করে লাভ নেই। বস্তুত, এই সবগুলির ক্ষেত্রে নিশ্চয় বলা হবে : না, ছোট করছেন না। যদি তাই হয় তাহলে ধার্মিকরাই বা কী দোষ করল তাদের নিজের নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করায়? খুবই আজব ব্যাপার! একথা ঠিক যে, শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি সর্বগ্রাসী অহং-এর জন্ম দেয় ; বিদ্বেষ-এরও। এবং, উদারতার বিনাশ করে। কিন্তু, সেটা ধর্মীয় দর্শনে প্রত্যয় থেকে উৎসারিত নয় ; বরং জাতিগত অনুভূতি থেকে উৎসারিত। ধর্ম ও জাতি এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলার বিভ্রান্তি থেকেই উপরিউক্ত ভুল কথাটি বলা হয়। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতির ক্ষেত্রে অহং ও বিদ্বেষ বিস্তারের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফ্যাসিস্ট হিটলারের জার্মানি। তবে, এর একটা অন্য দিকও উল্লেখযোগ্য। ‘শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি’ যে কেবল নেতিবাচকতারই জন্ম দেয় তা কিন্তু নয়। যেমন উল্লেখ করা যাক, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। অর্থাৎ, সারা পৃথিবীর মানুষ আমার আত্মীয়। একথা ভারতবর্ষ শুনিয়েছে। এখন আমি যদি মনে করি যে, ভারতবর্ষ আমার কাছে ‘শ্রেষ্ঠতম দেশ’ তাহলে ভুল হবে না, যদি আমার মননে ও চেতনায় সবাইকে উদার চিত্তে গ্রহণ ( রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘এক দেহে লীন’ হওয়া স্মরণীয় ) করার বহমান ভারতীয় জীবনবোধও সজীব থাকে। রবীন্দ্রনাথের ‘আন্তর্জাতিকতা’ কি স্বদেশের প্রতি সর্বোচ্চ অনুরাগ থেকে মুক্ত বা বিচ্ছিন্ন ছিল? দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন ‘সকল দেশের সেরা’ বলছেন তখন অন্যান্য দেশের প্রতি তিনি যে বিদ্বিষ্ট হচ্ছেন সেকথা বলা যায় না। ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অতএব, আসল ব্যাপার হ’ল ভাবনার প্রক্রিয়া। সেখানে গলদ থাকলে তার অভিঘাতও ভাল হওয়ার কথা নয়। প্রক্রিয়াটা সঠিক হওয়া চাই। আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। আমি যখন কাউকে বলি যে, তিনি ‘শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক’ তখন সবচেয়ে প্রিয়ত্বের অনুভূতি থেকেই বলি এবং দিনের শেষে সেটা ব্যক্তিগত চয়ন। তার মানে এই নয় যে, অপর কারও ব্যক্তিগত পৃথক চয়ন থাকতে থাকতে পারে না। ‘সবচেয়ে প্রিয়’ আর ‘সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ’ বলার মধ্যে পার্থক্যটা কিন্তু খুবই সূক্ষ্ম। ‘সবচেয়ে প্রিয়’ এই শব্দবন্ধের অভিঘাতও নেতিবাচক হতে পারে। কারণ, তার মধ্যেও ‘শ্রেষ্ঠত্বের অনুরণন’ যে একেবারেই নেই তা বলা যায় না। অতএব, সমস্যার ভূত লুকিয়ে আছে মূলত আমাদের ভাবনার প্রক্রিয়ায়। তার শুদ্ধিকরণ বা সঠিক নির্মাণ প্রয়োজন। একটি হ’ল ধর্মবোধ, অপরটি ধর্মীয় অনুশীলন। ‘অনুশীলন’ বলতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন। ‘আচারসর্বস্ব ধর্ম’ কথাটা ব্যবহৃত হয় ঠিকই, কিন্তু কোনও ধর্মই ‘আচারসর্বস্ব’ নয়। কারণ, মানুষকে ‘আচারসর্বস্ব’ করে তোলা ধর্মের মূল অভিমুখ নয়, তাতে ধর্মের কোনও উপযোগিতাই প্রমাণিত হয় না। ধর্ম কেবল সেটায় মানুষকে অভ্যস্ত হতে বলবে এটা পরোক্ষে যেন তার অসারতাকে নিজে নিজেই চিহ্নিত করা। এটা হওয়া যুক্তিবিরোধী। তাহলে মানুষ কথাটা কেন ব্যবহার করে? ধর্মবোধমুক্ত মানুষদের কেবল ধর্মীয় আচারকেই আঁকড়ে চলার ধরন দেখে। ধর্মীয় আচার বা অনুষ্ঠান হচ্ছে ধর্মের বাইরের একটা প্রাণহীন কাঠামো। তাতে প্রাণ সঞ্চার করে ধর্মবোধ। কিন্তু, সেই বোধ যখন শূন্য থাকে তখন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালন করার পরেও মানুষের মধ্যে সেই স্বচ্ছ, সুন্দর, দীপ্তিময়, পরিশীলিত, পরিশ্রুত জীবনপ্রণালী দৃশ্যমান হয় না। আর, তখনই এই ‘আচারসর্বস্বতা’র নির্মাণ সার্থক হয়ে ওঠে। ফলে, সর্বাগ্রে ধর্মবোধ খুব জরুরি। তারপর বাকি সব। তাহলেই সব ঠিকঠাক থাকে।‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই’--লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ‘হৃদয়’-এর জয়গান গেয়েছেন, যা যথার্থ। কিন্তু, বিস্তৃত আলোচনার পরিসরে দেখা যাবে যে, কথিত ‘মন্দির-কাবা’ ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই হ’ল, হৃদয়কে আলোকিত করা--যে আলোর অপর নাম পূর্ণ জাগরিত মনুষ্যত্ব। ধর্মের পীঠস্থান হিসেবে মন্দির, মসজিদ, গির্জা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। এসব জায়গায় মানুষ তার আত্মশুদ্ধির জন্য যায়। গৃহের অভ্যন্তরে হোক আর ওইসব জায়গাতেই হোক, ধর্মের অনুশীলন ভাল বা সুন্দর মানুষ হওয়ার জন্যই। নরেন্দ্রনাথ ‘বিবেকানন্দ’ হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য থেকে উৎসারিত ধর্মের আলোকপ্রাপ্তিতে। জগাই-মাধাই শ্রীচৈতন্যের পরম প্রেমময় ধর্ম উৎসারিত আলোকধারায় স্নাত হয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠেন। হযরত মহম্মদ (স.)-এর আগমনের পূর্বে যে আরব ছিল সবরকম অনাচার ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ, তাঁর সুমহান শিক্ষায় সেই আরবই বিকশিত মানবতার ছোঁয়ায় অখণ্ড শান্তির আবাসস্থলে পরিণত হয়--সেখানেও ওই ধর্মেরই প্রবাহ। তবে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে ধর্মচর্চা করার পরেও যদি কারোর হৃদয় পরিশুদ্ধ ও মানবতাবোধে আলোকিত না হয় তাহলে তার জন্য ধর্ম দায়ী নয়, সেই ব্যক্তির ধর্মচর্চায় যে বিরাট ফাঁকি রয়েছে সেই ফাঁকি দায়ী।
আগামীকাল সমাপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct