আপনজন ডেস্ক: রহস্যটা গোপন রেখেছিলেন ইউসেফ চিপ্পো। তখন সবে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে পা রেখেছেন ইউরোপে। অতিবাহিত হয়েছে মাত্র কয়েক মাস। মরক্কোর এই মিডফিল্ডার নিজেকে প্রমাণে মরিয়া ছিলেন। এমন কিছু করতে চাননি, যে কারণে তাঁর উঠে আসার পথটা রুদ্ধ হয়ে যায়। ইউসেফ তাই ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলেন। তিনি রোজা রেখেই ক্লাবের অনুশীলনে অংশ নিচ্ছেন। একজন মুসলিম হিসেবে ইউসেফের কাছে রোজা রাখাটা প্রত্যাশিত হলেও তাঁর ক্লাবের পরিবেশ ছিল ভিন্ন। ১৯৯৭ সালের সেই শীতে পর্তুগালের ক্লাব এফসি পোর্তোয় খেলোয়াড়দের রোজা রাখাটা ছিল একদমই অপ্রত্যাশিত।
কারণও ছিল। সকালে ও বিকালে—দুই বেলা চলত পোর্তোর অনুশীলন। এমনিতেই ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য, রোজা রাখলে তো কথাই নেই। পানি ও খাবার ছাড়া সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকা, সেটাও দুই বেলা অনুশীলন করে—এটা ভাবতেই তো কারও কারও গলা শুকিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ইউসেফ একটু অন্য ধাতে গড়া মানুষ। রোজা রেখেই দুই বেলা অনুশীলন করতেন। দুর্বলতায় কখনো কখনো তাঁর মাথা ঘোরাত, মাথাব্যথাও করত। কিন্তু ইউসেফ সেসব নিয়ে টুঁ শব্দটি করতেন না। গোপনে ব্যথাগুলো সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন! ইউসেফ একদিন রহস্যটা ভেঙে দিলেন। ক্লাবও খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিল। রোজা রেখে অনুশীলনের পরও ইউসেফের শক্তি ও স্বাস্থ্য কীভাবে অটুট রাখা যায়, সেই পরিকল্পনা করল পোর্তো।
দশকের পর দশক অন্য সব মুসলিম খেলোয়াড়ের জন্য ক্লাবগুলো কিন্তু এতটা ভাবেনি। অন্তত মুসলিম খেলোয়াড়দের রোজা রাখা নিয়ে ক্লাবগুলোর আনুষ্ঠানিক কোনো ভাবনা ছিল না। আর ফুটবল খেলাটাও এমন—মাঠে অহর্নিশ দৌড়াতে হয়, পর্যাপ্ত খেলোয়াড় বদলির নিয়মও নেই। তাই রোজা রেখে ম্যাচের মাঝপথে মুসলিম খেলোয়াড়েরা যে বেঞ্চে বসে একটু বিশ্রাম নেবেন, সেই উপায়ও নেই কিংবা ইফতারের সময় খেলায় বিরতির কথাও কেউ ভাবেনি। রোজা রেখে মাঠে নামা খেলোয়াড়ের জন্য তাই বুদ্ধি করে ইফতারের পথ বের করতে হয়েছে তাঁর সতীর্থদের।
দেখা যেত, ইফতারের সময় কেউ চোট পাওয়ার অভিনয় করছেন, তখন যে বিরতিটুকু মেলে সেই ফাঁকে সাইডলাইনে গিয়ে রোজা ভেঙে আসতেন তাঁর মুসলিম সতীর্থ। স্টাফরা সেই খেলোয়াড়ের জন্য কয়েকটি খেজুর কিংবা মিষ্টান্ন পানীয় রেখে দিতেন। ঠিক সময়ে নিজেরাই তাঁর হাতে তুলে দিতেন কিংবা ইফতারের সময় কেউ চোট পেলে ট্রেনার মাঠে ঢোকার সময় ব্যাগে করে দুটো কলাও নিয়ে যান। কারণটা আপনি জানেন।
রোজা রাখা সতীর্থের জন্য খেলোয়াড়েরা এসবই করেছেন নিজেদের ব্যবস্থায়। মানে ক্লাবের পক্ষ থেকে ব্যাপারগুলো আনুষ্ঠানিক ছিল না।
রোজা রেখে ফুটবল খেলাকে এক সময় নিরুৎসাহিত করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। বিশ্বের সেরা সব লিগে, বিশেষ করে ইউরোপে মুসলিম ফুটবল খেলোয়াড়দের সংখ্যা ও গুরুত্ব বাড়ছে। আর তাই বিশ্বসেরা লিগ ও ক্লাবগুলো—একটি লিগ বাদে (ফ্রেঞ্চ লিগ আঁ)—খেলোয়াড়দের রোজা রাখাকে ইতিবাচক চোখে দেখছে। মুসলিম খেলোয়াড়দের জন্য আলাদা করে পুষ্টি-পরিকল্পনার পাশাপাশি অনুশীলনের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনছে ক্লাবগুলো। এমনকি মাঠে নামার পর ইফতারের সময় মুসলিম খেলোয়াড়েরা যেন রোজা ভাঙতে পারেন, সে জন্য খেলায় কিছু সময় বিরতির অনুমোদনও দিয়েছে কিছু লিগ।
এসব পরিবর্তন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাগুলোর বৈচিত্র্য আরও বাড়িয়েছে। প্রতিযোগিতার ভাবমূর্তিও করেছে আরও ইতিবাচক। তবে আরও গভীরে তাকালে পরিবর্তনগুলোর অন্য কারণও চোখে পড়বে। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের কথাই ধরুন। এসব লিগে মুসলিম খেলোয়াড়দের পেছনে কোটি কোটি ডলার লগ্নি আছে ক্লাবগুলোর। নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো নিয়ে মুসলিম খেলোয়াড়েরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই রোজা নিয়েও ভাবতে হয়েছে ক্লাব ও লিগগুলোকে।
দুই মৌসুম আগের কথা। সাদিও মানে তখন লিভারপুলে। সেনেগালিজ এই ফরোয়ার্ড নিজের অধিনায়কের কাছে একটি অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন কোচকে (ইয়ুর্গেন ক্লপ) গিয়ে বলেন রোজার মাসে অনুশীলনের সূচি পাল্টে সকালে নিয়ে আসতে। এতে ক্লাবের অন্য মুসলিম খেলোয়াড়েরা সাহ্রি করেই অনুশীলনের প্রস্তুতি নিতে পারবেন। ক্লপ অনেকটাই পত্রপাঠ মেনে নিয়েছিলেন।
আর্সেনালে নিজের অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন মিসরীয় মিডফিল্ডার মোহাম্মদ এলনেনি, ‘ওরা ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি নেয়। কারণ, ওরা জানে এটা (রোজা) আমার ও অন্যদের (মুসলিম) জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমাকে ফিট রাখা প্রয়োজন তাদের।’
৩১ বছর বয়সী এলনেনি ছাড়াও আর্সেনালে আরও দুজন এই মৌসুমে রোজা রেখেই খেলছেন। এলনেনি জানিয়েছেন, প্রথম রোজা শুরুর প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকেই খেলোয়াড়দের এ ব্যাপারে প্রস্তুত করতে শুরু করে আর্সেনাল। খেলোয়াড়েরা যেন রোজা রেখেও সেরা ফর্মে থাকতে পারেন, সে জন্য এ ব্যবস্থা। আর রোজা শুরুর আগের দিন থেকেও এই প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনা হয়। প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য ক্লাব ও ইউরোপে এক ডজনের বেশি ক্লাব এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের লিগগুলোয় ম্যাচ চলাকালীন ইফতারের বিরতির নিয়ম চালু করেছে। ইফতারের সময় যেন খেলা থামাতে পারে, সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জার্মানির রেফারিদের।
তবে সব দেশ কিন্তু এই পথে হাঁটেনি। ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশন (এফএফএফ) যেমন ইফতারের সময় রোজা রাখা খেলোয়াড়দের জন্য খেলায় বিরতি না দিতে ক্লাব ও অফিশিয়ালদের নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে গাইডলাইনও বেঁধে দিয়েছে তারা। আর ফেডারেশনের দলগুলোর (জাতীয় দল থেকে বয়সভিত্তিক) রোজা রেখে অনুশীলনে নামলে সেই খেলোয়াড়কে নিষিদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। এ জন্য ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনকে অবশ্য সমালোচনাও সইতে হচ্ছে। ফ্রান্সের ফুটবল কর্তৃপক্ষ অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছে, ফেডারেশনের নিয়ম অনুযায়ী ধর্মীয় নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যেও একজন খেলোয়াড় প্রতিবাদ জানিয়ে ফ্রান্স অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্প ছেড়েছেন। তিনি মাহমাদু দিয়াওরা। ইংল্যান্ডে মুসলিম খেলোয়াড়দের মাঠে ইফতারের জন্য সংক্ষিপ্ত বিরতি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অনুমোদন করেছে ২০২১ সালে। পেশাদার ফুটবলারদের অ্যাসোসিয়েশন রমজান মাসকে প্রাধান্য দিয়ে খেলোয়াড়দের কীভাবে কী করা উচিত, সে বিষয়ে ৩০ পৃষ্ঠার একটি তথ্যমালাও প্রকাশ করেছে। এমন সচেতনতা কিন্তু একসময় ছিল না। অন্তত এখন ইউরোপে ব্যাপারটা যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেভাবে তো নয়ই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct