পাভেল আখতার, আপনজন: আধুনিক যুগে আমরা দেখি যে, ‘যুক্তিবাদ’ শব্দটি নিরন্তর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। যুক্তিবাদ জিনিসটা মন্দ নয়। কিন্তু, যুক্তির পরিসর ও প্রকৃতি নিয়ে খুব একটা ভাবা হয় না। অর্থাৎ, যুক্তি কি অনিয়ন্ত্রিত এবং তার কোনও ধরন বিচার্য নয় ? রাজনীতিবিদ চোরকেও সাধু প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। অর্থনীতির ভারিক্কি অধ্যাপকটি খয়রাতি নিয়ে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ভাষ্য রচনা করলেন। ইতিহাসবিদ ইতিহাসের কল্পনাকে শিল্পরূপ দিলেন। কবি অখাদ্য অ-কাব্যকে পারলে নোবেল পুরস্কার দিতেন এমন বচনামৃত পরিবেশন করলেন। নব্য লেখক বাংলা লেখাপত্তরে ইংরেজি শব্দের অবাধ ব্যবহারকে স্বাগত জানালেন ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য, ইত্যকার সমস্ত ক্ষেত্রেই যা অবলম্বিত হয় তা হ’ল--যুক্তি। অথচ, স্বচ্ছ ও বৌদ্ধিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে দেখা যাবে সবই অপযুক্তি। অতএব, যুক্তি ভাল, কিন্তু যুক্তি দেওয়ার অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাস ভাল নয়। এবং, প্রকৃতি বা ধরনের নিরিখে বিচার করতে গেলে যুক্তি প্রদানের একমাত্র হেতু হ’ল, সত্যের প্রতিষ্ঠা। যে সত্য প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে তার উন্মোচন। সত্যের বিনির্মাণ বা বিনির্মিত সত্যের ঢাকনা খোলা নয়। আমরা চর্চার একটি অভিমুখকে প্রায় মজ্জাগত করে নিয়েছি। সেটা হ’ল, বিরোধ বা সংঘাতের আবহ কল্পনা ছাড়া আমরা যেন অচল হয়ে পড়ি। মৈত্রী কিংবা সহগামিতার সুর আমাদের চেতনাকে আলোকিত করতে পারে না। ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিষয়টি এই বৃত্তেই আবর্তিত। ধার্মিক ভাবছে, ধর্মই সব। বিজ্ঞানবাদী ভাবছে, বিজ্ঞানই সব। বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষের জীবনকে এতটাই উন্নত করেছে যে, ধর্ম কারও কারও কাছে একেবারে অচল মুদ্রার মতো। আবার, ধর্মপ্রিয় মানুষ ভাবে, বিজ্ঞান নিশ্চয়ই দরকারী, কিন্তু নৈতিক সত্তার বিকাশ ছাড়া তা সৃজনশীলতার পাশাপাশি মানুষকে ধ্বংসাত্মকও করে তুলতে পারে, করেছেও; অতএব ধর্মের অনুশীলন আবশ্যক। এভাবেই রচিত, বিবর্ধিত হয়ে ওঠে বিরোধ বা সংঘাতের পরিসর। অথচ, তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, প্রেরণাসঞ্চারী কেন্দ্রগত শ্লাঘার উপরিস্থিত আবরণটা অসার, যা অপসৃত হলে মৈত্রীভাবনা বা সহগামিতা পল্লবিত হতে পারে। এবং, সেই প্রক্রিয়াই মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর। রবীন্দ্রনাথের গানের অংশবিশেষ বারবারই উল্লেখ করতে হয়--’আমার চোখে তো সকলই শোভন....!’ আধুনিক সমাজে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে একটি অংশ সংশয় প্রকাশ করেন। তাদের এই সংশয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদিতার তটরেখা উপচানো ঢেউ-এর প্রাবল্য দেখে যতটা, ঠিক ততটাই সম্ভবত ধর্মে প্রত্যয় স্থাপনকারীদের ধর্ম থেকে বিচ্যুতি দেখেও। ধর্ম ও বিজ্ঞানকে দাঁড়িপাল্লায় মাপার যে প্রবণতা, প্রথমত সেটাই অযৌক্তিক। কারণ, এই দাঁড়িপাল্লা যদি ধার্মিকের হাতে থাকে, তাহলে সে-ও বিজ্ঞানবাদীর পন্থা অনুসরণ করে বিজ্ঞানকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। হয়তো করেও। অথচ, ধর্ম ও বিজ্ঞান কোনওটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য নয়। দুটির পরিসর স্বতন্ত্র। পরিপূরক নয়। ধর্মের প্রয়োজন ধর্ম দিয়ে হয়, বিজ্ঞানের প্রয়োজন বিজ্ঞান দিয়ে। একটির অভাব অন্যটি দিয়ে যখন পূরণ হয় না, তখন একটিকে দিয়ে আরেকটির প্রয়োজনীয়তা অথবা অসারতা প্রমাণ করাও অযৌক্তিক। ‘আধুনিক সমাজ’ শব্দবন্ধটা ব্যবহৃত হয় বিজ্ঞানের বহুবিধ আবিষ্কারের সুফলকে যাপনের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানের বিপুল সুফল সত্ত্বেও দৃশ্যমান আধুনিক সমাজে নানা অবক্ষয়ও চরম পর্যায়ে বিরাজমান। তাহলে মানুষের জন্য যা যা দরকার, দেখা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞানে সেই পূর্ণাঙ্গতা নেই। যেমন তা নেই ধর্মেও। সেটাই স্বাভাবিক। এবং, সেজন্যেই আসলে প্রয়োজন দুটিরই। ভিন্ন ভিন্ন নিরিখে।
তথাকথিত ধার্মিকদের ধর্ম থেকে বিচ্যুতির বিষয়টা আলোচ্য। প্রাচীন যুগের মানুষকে ‘ধর্ম’ বস্তুটা কী তা বোঝার জন্য ‘ধর্মগ্রন্থ’ খুলে দেখতে হয়নি। মূলত সেই ‘জ্ঞানচর্চার পরিসর’ও তখন ছিল না। তারা ধার্মিকদের দেখেই বুঝেছে ‘ধর্ম’ জিনিসটা আদতে কি। আজ যদি কোনও ধার্মিক ধর্মে সংশয়ী কাউকে ধর্মগ্রন্থ থেকে ধর্মজ্ঞান নিতে বলে, জ্ঞানচর্চার পরিসর মুক্ত, প্রসারিত হওয়ায় হয়তো সেকথা আজ আর ভুল নয়ও ; কিন্তু তার সেই উপদেশটা নিশ্চয়ই ব্যুমেরাং হতে বাধ্য, যদি তার নিজের মধ্যেই ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থের আলোছায়া অদৃশ্য থাকে। সম্পূর্ণতার অনুশীলন ব্যতীত কাঙ্ক্ষিত ‘আধুনিক সমাজ’ সমস্ত দিক থেকে ‘নীরোগ, প্রাণবন্ত ও সুখী’ হওয়ার গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হতেই থাকবে। ধার্মিকের বিজ্ঞানচেতনা ও বিজ্ঞানবাদীর ধর্মবোধ হচ্ছে সেই ‘সম্পূর্ণতা’। ‘খণ্ডের’ তরী বেয়ে ‘অখণ্ড’-কে ছোঁয়া অসাধ্য।
ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে যে ‘দ্বৈরথ’ তাতে একটি বিষয় খুব কৌতূক উদ্রেক করে। আসন্ন মৃত্যুর চৌকাঠে যখন রোগীটির পা তখন একমাত্র ঈশ্বরশূন্য বিজ্ঞানে প্রত্যয়ী চিকিৎসকটিকেও বলতে শোনা যায় : ‘এখন ঈশ্বরই কেবল যদি প্রাণ বাঁচাতে পারেন...।’ ঈশ্বরে অবিশ্বাসী রোগীটিও মনে মনে তখন ‘তাঁকেই’ স্মরণ করেন কি না কে জানে ! যুক্তিবাদ ধ্বনিত, পদার্থময় বিপুলা বিশ্বের অগম কোন পার থেকে কোন ‘আলো’ যে তখন চোখে এসে লাগে, তা সামনে উপবিষ্ট মানবচক্ষুগুলি আবার দেখতে পায় না ! অবশ্য ধর্ম ও বিজ্ঞানের সব ভেদরেখা তখন যদি ঘুচেও যায় তাহলেও আর করার কিছু থাকে না ! ‘আমিই তো ঈশ্বর’--একদা এই অনন্ত দর্প থেকে ‘প্রত্যাবর্তন’ করতে চেয়েছিল প্রাচীন মিশরীয় বাদশাহ ফেরাউনও, যখন নীলনদ তাকে আমূল গ্রাস করছিল ! কিন্তু, আর ‘সময়’ ছিল না !
প্রকৃতিকে সাময়িক ‘অস্বীকার’ করা গেলেও পাথরের বুক চিরে জলধারা নির্গত হওয়া কিংবা মাটির ভিতর থেকে বীজের অঙ্কুরিত হওয়ার মতো ‘সত্য’ স্বীকার ও অস্বীকারের অপেক্ষা করে না !
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct