সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনজন: অনেকেরই ধারণা,কোনও ঘটনা আদালতে গেলে, বিচার হয় সঠিক, আসল দোষী শাস্তি পায়। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে বিচার প্রক্রিয়া চলে নির্দিষ্ট ফর্মুলায়,আইনের বিভিন্ন ধারার ভিত্তিতে,সম্পূর্ণটা মানুষের বিচার শক্তিতে নয়।আইন এবং বিচার ব্যবস্থায় পূর্ণ আস্থা রেখে এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি ,এখানে এমন কিছু ফাঁক আছে ,যেগুলো জানলে,একজনের বিরুদ্ধে অপরাধ করে,তাকেই অপরাধী প্রমাণ করা যায়। নীচের ঘটনাটা সেটাই দেখায়। শীর্ণকায় চেহারার এবং দেখতে বোকা বোকা ১৯ বছরের যুবক বিতান সেন সেদিন রাস্তা দিয়ে একাই আসছিল।উল্টো দিক থেকে খুব ফুর্তির মেজাজে আসছিল তার সমবয়সী এবং ওই এলাকার দুই যুবক,যাদের একজন ‘মিন্টু দাস’। কিন্তু ওদের মজাটা যে এই পর্যায়ে যাবে কেউ ভাবেনি। ওরা জানত যে, বিতান নানাভাবেই কমজোর। মুখোমুখী আসতেই ,মিন্টু আচমকা সিনেমার ভিলেনের কায়দায় বিতানের জামাটা বুকের কাছে পেঁচিয়ে ধরে বলল,” কি রে বিরাট মাস্তান হয়ে গেছিস, মাস্তানি ছুটিয়ে দেব”। গায়ের শক্তি এবং জনবলের অভাব থাকলেও, বিতানের ইজ্জতবোধ ভালোই ছিল। সে’ও পাল্টা মিন্টুর জামার কলার পেঁচিয়ে ধরল।“কলার ছাড়,খুব খারাপ হয়ে যাবে।” মিন্টু বিতানকে এক হুংকার দিল।“আগে তুই ছাড়”, বিতানও বলে উঠল। সেকেণ্ডের মধ্যে একটু নীচু হয়ে, মিন্টু রাস্তা থেকে একটা ছোট ইটের টুকরো কুড়িয়ে বিতানের মাথায় জোরে দু-তিনটে আঘাত করল।বিতানের মাথা ফেটে রক্ত পড়তে লাগল। মিন্টু ও তার সঙ্গী চলে গেল। বিতানকে তার বাবা, “সুময়” ডাক্তার “সাহা”-র কাছে নিয়ে গেলেন। ওর মাথায় কয়েকটা সেলাই পড়ল।সুময়, ডাঃসাহাকে এটা ইনজুরি রেজিস্টারে লিখতে বললেও ডাঃসাহা ,তা’ করলেন না, উল্টে সুময়কে ধমকে উঠলেন। বিতানের এক বন্ধু বিতানের বাড়ি এসে, তাড়াতাড়ি রক্তমাখা জামাটা কেচে,মেলে দিল। একটু পরেই এলাকার কয়েকজন বয়স্ক ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিতানদের বাড়িতে এসে বিতানের বাবা, মা এবং বিতানকে সমবেদনা জানালেন। মিন্টু বাইরে ছিল।সবাই তাকে ডেকে, বিতান এবং তার বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ালেন।এবার সবাই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বিতানের বাবা-মাকে বোঝালেন, “ মিন্টুর বয়স মাত্র ১৯ , আপনাদের ছেলের বয়সী, ওর সারাটা জীবন বাকি ,আপনাদের কাছে অনুরোধ যে,থানায় ডাইরি করবেন না, ওর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে”। এইরকম নানা দরদী কথায় তাঁরা বিতানের বাবা-মাকে থানায় ডাইরি না করতে অনুরোধ করলেন। বয়স্ক লোকেরা ছাড়া কয়েকজন উগ্র ধরণের যুবকও ছিল। বিতানের বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে ওরা বলল, “ এত বোঝানো স্বত্বেও থানায় ডাইরি করে ওঁরা কি এখানে শান্তিতে থাকতে পারবেন”? এদেশের সমাজের ধারণা যাঁদের আছে, তাঁরা বুঝবেন যে, এই পরিস্থিতিতে ডাইরি চলেনা। বলাই বাহুল্য যে,থানায় এত বড় অপরাধের কোনও ডাইরি হয়নি। বিতান এটা অন্তর থেকে মানতে পারেনি। এরপর রাস্তায় দেখা হলে, মিন্টু বা তার কোনও বন্ধু “ কি রে , মাথা ফেটে গেছে ? আহাঃ বেচারা রে !” , এইরকম একাধিক বিদ্রূপ বিতানকে ছুঁড়ে দিত।একটা প্রতিশোধ স্পৃহা বিতানকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
সেদিন মিন্টু ও তার তিন বন্ধু মিলে ক্যারাম খেলছিল। পাশে পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরো দিয়ে মেরে বিতান মিন্টুর মাথা ফাটিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। মিন্টুর মা মিন্টুর ৪-৫ জন বন্ধু এবং এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে মিন্টুকে স্থানীয় চিকিৎসক ডাঃ রায়-এর কাছে গেলেন। মিন্টুরও মাথায় কয়েকটা সেলাই পড়ল।এরপর তাঁরা ডাক্তারের ইনজুরি রেজিস্টারে এটাকে নথিবদ্ধ করতে বললেন। কোর্টে সাক্ষী দেওয়ার ভয়ে ডাক্তারবাবু প্রথমে গররাজি থাকলেও অতগুলো লোকের চাপে এটা করতে বাধ্য হলেন। সেখানে আঘাতের কারণ ও বিতানের নাম উল্লেখ করা হল। এরপর মিন্টুর মা সদলে গেলেন সরকারি হাসপাতালে। সেখানে আরেকবার মিন্টুকে দেখিয়ে, সেখানকার রেজিস্টারেও বিতানের নাম দিয়ে ঘটনাটা রেকর্ড করানো হল।এরপর, দুই জায়গার রেকর্ডের কপি নিয়ে, মিন্টুর মা এদের সবাইকে নিয়ে থানায় গিয়ে বিতানের নামে ডাইরি করলেন। ক্যারাম খেলার সঙ্গীরা সমেত আরও কয়েকজন থানায় বিতানের বিরুদ্ধে লিখিত বয়ান দিল।একটা জোরালো কেস তৈরি হল।পুলিশ বিতানকে গ্রেফতার করে, একদিন পুলিশ-হাজতে রেখে পরদিন কোর্টে চালান করল। ভারতীয় দণ্ডবিঢীর ৩৩৮ ধারায় পুলিশ (রাজ্য) বনাম বিতানের মধ্যে মামলা রুজু হল। কোর্টে এনে বিতানকে রাখা হল জেল হাজতে।বিতানের বাবা তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন। মামলা চলতে লাগল। সাক্ষীরা বীরদর্পে সাক্ষী দিতে থাকল। ডাঃ রায় একদিন চেম্বার বন্ধ রেখে ইনজুরি রেজিস্টার নিয়ে , কোর্টে এসে তাঁর বয়ান দিলেন। বিতানের উকিল মানবিক ছিলেন।তিনি সুময়কে পরামর্শ দিলেন, মিন্টুর বাড়ির লোকের সঙ্গে বসে একটা মিটমাট করতে, নয়ত বিতানের শাস্তি হতে পারে। যাঁরা সেদিন মিন্টুর বিরুদ্ধে থানায় ডাইরি না করতে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা সমেত এলাকার একাধিক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সুময় এই ব্যাপারে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সবাই নানা কৌশলে এড়িয়ে গেলেন। মামলার বিচারক ছিলেন মাননীয় এস.ঘোষাল। তিনি ছিলেন সুময়ের এক বন্ধুর কলেজ সহপাঠী। সেই বন্ধুর মাধ্যমে ঘোষাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করে, সুময় সব বললেন। ঘোষাল সাহেব বললেন, “ আমি বুঝতে পারছি ,বাস্তবে বিতান অপরাধী নয় বরঞ্চ অপরাধ তার বিরুদ্ধেই হয়েছে কিন্তু সে পরিস্থিতির শিকার।মিন্টু যখন বিতানের মাথা ফাটিয়েছিল,তখন কোনও ডাইরি হয়নি। আইনের মতে মিন্টুর অপরাধটা বিচার্য নয় এবং আইনের চোখে মিন্টু অপরাধীও নয়। বরং পুলিশে না জানিয়ে,বিতান আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। রাষ্ট্রের চোখে এটাও অপরাধ। আমি বিষয়টা জানলেও বিচার হয় আইনের নির্দিষ্ট নিয়মে,পুরোটা মানুষের বিচারশক্তিতে নয়। এই নিয়মগুলো করা হয়েছিল ,যাতে মানুষ আইন নিজের হাতে না নেয়, সমাজে বিশৃঙ্খলতা না হয়। কিন্তু কিছু মানুষ এর সুযোগ নেয়। যে মানুষ অপরাধ করেও নিজের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ হওয়া আটকাতে পারে, বিচার ক্ষেত্রে সে সুবিধাজনক জায়গায় থাকে আর যে পারেনা বিচার-প্রক্রিয়া তার পক্ষে প্রতিকূল হয়। এই কেসে পুলিশ ফরিয়াদি আর বিতান আসামী। এখানে আসামীর অপরাধই বিচার্য ” । দেখলাম ,কঠিন পদে অধিষ্ট বিচারকও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিলেন। বললেন, “ এইরকম আরও কেস পাই কিন্তু আইনে আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমি মনে করি,ক্ষেত্রবিশেষে মানবিকতাও আইনের পাশে থাক”। আইনের পথেই মহামান্য বিচারক মামলাটা দণ্ডবিধির ৩৩৮ ধারার পরিবর্তে ৩২৩ ধারায় বিতানকে ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন।সবাই বিতানের বাবার মত বিচারক অবধি যেতে পারেনা, ফলে শাস্তি আরও বেশি হয়।কিন্তু এই ঘটনা দেখাল ,সমাজের তথাকথিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের আসল রূপ। দেখা গেল বিচার প্রক্রিয়ায় এমন কিছু জায়গা আছে ,যেখানে জনবলকে কাজে লাগিয়ে একজনের বিরুদ্ধে অপরাধ করে তাকেই অপরাধী বানানো যায়।তাই, ,মানণীয় বিচারক মহাশয়ের কথাই কানে বাজে যে, আইনের পাশে থাক মানবিকতাও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct