জাইদুল হক, আপনজন: গত ডিসেম্বর মাসে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন ঘিরে তেমন উত্তাপ ছিল না। জোর জল্পনা চলছিল রাজ্যের কোন কোন আসনে কোন রাজনৈতিক দলের কে কে প্রার্থী হচ্ছেন। বিশেষ করে তারকা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কারা লড়বেন। তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন বিশ্লেষণ করছিল, তখন ‘আপনজন’ ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কেন্দ্রে মুসলিম ভোট ফ্যাক্টরকে তুলে ধরেছিল। ‘আপনজন’-এর বিশ্লেষণে তুলে ধরা হয়েছিল, বাম কংগ্রেস জোট না হলে রাজ্যের শাসক দল যদি মুসলিম প্রার্থীকে বহরমপুর কেন্দ্রে অধীর কবিরের বিরুদ্ধে প্রার্থী করে তাহলে বিপদের মুখে পড়তে পারেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। সেই প্রশ্নটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক শোরগোল। সেই সময় ইন্ডিয়া জোটের অংশ হিসেবে কংগ্রেস ও তৃণমূলের আসন সমঝোতার প্রশ্নটি সামনে এলে কংগ্রেস বেশ কয়েকটি আসন দাবি করে। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দেন, বহরমপুর ও মালদা দক্ষিণ কেন্দ্র দুটিই তারা কংগ্রেসকে ছাড়তে পারে। তাতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি নারাজ হলে তৃণমূলের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা একলা চলো রে পন্থা নিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হচ্ছে না। তৃণমূল কংগ্রেসের একটি সূত্র বহরমপুর কেন্দ্রে অধীর চৌধুরিকে হারানোর ক্ষমতা রাখার দাবি করে। এরপর অধীর চৌধুরির প্রতিক্রিয়া মেলে। ৪ জানুয়ারি বহরমপুরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে অধীর চৌধুরি বলেন, ‘বহরমপুরে তো হারাবে বলছে, মালদায় তো হারাবে বলছে। ওপেন চ্যালেঞ্জ করছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে, যে কোনও মামুকে এখানে পাঠিয়ে দাও। যদি হারাতে পারে, রাজনীতি ছেড়ে দেব।’
অধীর চৌধুরি তৃণমূলের উপর এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে যান যে, তিনি খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও চ্যালেঞ্জ চুড়ে দেন। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে মমতার উদ্দেশ্যে অধীর চৌধুরি বলেন, ‘আসুন, আপনি নিজে আসুন। আপনি প্রিয়ঙ্কা গান্ধীকে বলছেন মোদীর বিরুদ্ধে লড়তে। আমি আপনাকে বলছি, আপনি আসুন এখানে আমার বিরুদ্ধে লড়তে। কত তাগদ আছে দেখছি আপনার। মালদায় চলুন দেখছি। আপনার দয়ায় আমরা এ সব সিট (আসন) জিতিনি।’
অধীর চৌধুরির সেই চ্যালেঞ্জ জানানোর মাস দুই পরে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ৪২টি আসনে লোকসভার প্রার্থী ঘোষণা করে। তার মধ্যে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ঘোষণা করেন ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেট দলের মারকুটে ব্যাটসম্যান ইউসুফ পাঠানকে। মোদির রাজ্য গুজরাতের বাসিন্দা ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুরে প্রার্থী করায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন অধীর চৌধুরি। অধীর চৌধুরি বলেন, ক্রিকেটের ময়দান আর রাজনীতির ময়দান এক জিনিস নয়। তবে, তৃণমূলের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে অধীর চৌধুরি বিজেপিকে সহায়তা করার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘ইউসুফ পাঠানকে যদি সম্মানিত করতে হতো, তাহলে ওঁকে রাজ্যসভায় সাংসদ করে পাঠাতে পারত। নাহলে গুজরাতের কোনও আসন সেখানকার ইন্ডিয়া জোটের দলের কাছ থেকে নিয়ে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী করতে পারতেন। কিন্তু ওঁকে এখানে পাঠিয়েছেন বিজেপিকে সাহায্য করতে, যাতে কংগ্রেস হারে।’
ফলে, বোঝাই যায়, তৃণমূল কংগ্রেস ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুরে প্রার্থী করায় সত্যিই বিব্রত অধীর চৌধুরি। তখনও কংগ্রেসের তরফে বহরমপুর কেন্দ্র থেকে টানা পাঁচবার জয়ী সাংসদ অধীর চৌধুরির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। যদিও অবশেষে কংগ্রেসে বহরমপুর কেন্দ্রে মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র অধীর চৌধুরিকেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর পরই মুর্শিদাবাদ জুড়ে জোর প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে, অধীর চৌধুরির চিরকালীন ময়দানে এবার কি ইউসুফ পাঠান তার ছক্কা মারার মতো দাপট দেখাতে পারবেন। ইতিমধ্যে ইউসুফ পাঠানকে বহিরাগত তকমা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। তাতে প্রার্থী ঘোষণার প্রথম দিকে আগ বাড়িয়ে আপত্তি তোলেন ভরতপুরের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক হুমায়ুন কবির। তিনি প্রার্থী পরিবর্তন না করলে ইউসুফ পাঠানের বিরুদ্ধে নিজেই দাঁড়ানোর হুঙ্কার দেন।
তৃণমূলের বিধায়কের এই বিদ্রোহী মনোভাব অধীর চৌধুরিকে অনেকটাই কাজে লাগতে পারে মনে হচ্ছিল। কিন্তু তাতে জল ঢেলে দেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ক্ষুব্ধ তৃণমূল বিধায়কের সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব কথা বলার পর একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যান হুমায়ুন চৌধুরি। তার সেই হুঙ্কার হারিয়ে গিয়ে ইউসুফ পাঠানের সঙ্গে এক মঞ্চে হাজির হয়ে অঙ্গীকার করেন, তিনি ইউসুফ পাঠানের হয়ে ভোট করবেন। ইউসুফ পাঠানকে জেতানোর দায়িত্ব তার বলেও মন্তব্য করেন।
ফলে, অধীর চৌধুরির সঙ্গে যে ইউসুফ পাঠানের জোর লড়াই হবে তা বুঝে যাচ্ছেন মুর্শিদাবাদের মানুষ। আর তৃণমূল কংগ্রেস যে হিসেব কষেই ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুর কেন্দ্রে অধীর চৌধুরির বিরুদ্ধে ঢাল করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে এই রাজনৈতিক যুদ্ধকে দারুণ ক্রিকেট যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেন ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভ বলেন, ইউসুফের বিরুদ্ধে অধীর চৌধুরি হলেন ব্রেট লি।
সৌরভ বিষয়টি নিয়ে খারাপ উপমা দেননি। পাঁচ পাঁচবার যিনি বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে থেকে জিতেছেন, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা তো সহজ কাজ নয়।
আসলে ইউসুফ পাঠানকে তৃণমূল প্রার্থী করায় এক মোক্ষম চাল দিয়েছে। সূক্ষ্ম ধর্মীয় মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে বহরমপুর কেন্দ্রে বাজিমাত করতে চায় তৃণমূল তা অপ্রিয় হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, তৃণমূল দেখেছে সাগরদিঘি বিধানসভা উপনির্বাচনে কংগ্রেস এইভাবে সূক্ষ্ম ধর্মীয় মেরুকরণকে কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছে। সুব্রত সাহার মৃত্যুতে সাগরদিঘি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মীয় সাগরদিঘি ব্লক তৃণমূল সভাপতি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। ৬৩.৫ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত সাগরদিঘি বিধানসভা উপনির্বাচনে দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল বায়রন বিশ্বাসকে। তৃণমূলের জেতা আসনে বায়রন বিশ্বাসের কাছে হেরে যান তৃণমূল প্রার্থী। সে সময় অভিযোগ তোলা হয় কংগ্রেস ধর্মীয় মেরুকরণের তাস খেলে তৃণমূলের জেতা আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। যদিও কংগ্রেসের হয়ে জিতে পরে তৃণমূল কংগ্রেসেই যোগ দেন বায়রন বিশ্বাস। সাগরদিঘি উপনির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে অধীর চৌধুরির বিরুদ্ধে সাগরদিঘি উপনির্বাচনের মতো কংগ্রেসের পন্থাকে তৃণমূল হাতিয়ার করতে ইউসুফ পাঠানকে প্রার্থী করা হয়েছে বলে তৃণমূলের বিভিন্ন মহল সূত্র জানিয়েছে।
এ নিয়ে প্রায় মুখে কুলুপ এঁটে আছেন অধীর চৌধুরিও। কারণ, সাগরিদিঘি উপনর্বিাচন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে মুসলিমদের এক বিশেষ অংশ এখনও কংগ্রেসের উপর আস্থা রাখে। সেই আস্থা কোনওভাবেই নষ্ট করতে চান না অধীর চৌধুরি। কারণ, তিনি ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ তুললেই পাছে মুসলিমরা বিরাগভাজন হয়ে পড়ে। তাই উভয় সঙ্কটের মধ্যে এখন অধীর চৌধুরি।
তবে, ইউসুফ পাঠানকে তৃণমূল প্রার্থী করায় বিজেপি এখনও তার বিরুদ্ধে সেভাবে সরব হয়নি। এমনকি বহরমপুরের বিজেপি প্রার্থী ডা. নির্মল সাহা এখনও এধরনের কোনও অভিযোগ তোলেননি।
বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে সাতটি বিধানসভা এলাকা রয়েছে সেগুলি হল, বহরমপুর, বড়ঞা, রেজিনগর, নওদা, কান্দি, ভরতপুর ও বেলডাঙা। এর মধ্যে বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি বিজেপির দখলে। তৃণমূল ও কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটির খেলায় বিজেপি প্রার্থী সুব্রত মৈত্র জিতে যান। সুব্রত মৈত্র ৪৫.২২ শতাংশ ভোট পেলেও তৃণমূল পেয়েছিল ৩১.৬১ শতাংশ ও কংগ্রেসে পেয়েছিল ২০.৩৩ শতাংশ ভোট। বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিম জনসংখ্যার হার ২৫.১ শতাংশ। তাই বিধানসভা ভোটে মুসলিম ভোটও তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে অধীর চৌধুরি ৬৪.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৯.৯ শতাংশ। ফলে, ভোটারদের প্রবণতা বলছে বিজেপি সমর্থকদের একটা বড় অংশ অধীর চৌধুরিকে ভোট দিয়েছে। গত বিধানসভার ফলাফল দেখলে বোঝা যাবে ঠিক তার উল্টটা ঘটেছে। ২০২১ এর ভোটে বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি পেয়েছে ৪৫.২২ শতাংশ যা লোকসভার ভোটের তুলনায় বহু গুণ বেশি। একই ভাবে লোকসভা ভোটে বড়ঞা বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসে যেখানে ৪০.১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ৬.৯৪ শতাংশ ভোট। অপরদিকে লোকসভা ভোটে বড়ঞা বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি যেখানে ১৮.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে ৪৪.৭ শতাংশ। একইভাবে লোকসভা ভোটে কান্দিতে বিজেপি মাত্র ৭.৩ শতাংশ ভোট পেলেও বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে ৩০.৭৪ শতাংশ ভোট। একই প্রতিচ্ছবি রেজিনগর, নওদা, কান্দি, ভরতপুর ও বেলডাঙা এলাকার ক্ষেত্রে। ফলে, সহজেই বোঝা যাচ্ছে বিধানসভায় বিজেপির সিংহভাগ ভোট লোকসভা ভোটে অধীর চৌধুরির ঝুলিতে পড়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু মুসলিম ভোটও। সেটাই যে এবারের লোকসভা ভোটে হবে কে বলতে পারে। উল্লেখ্য, গত লোকসভায় মোট ভোটার ছিল ১৬৩ ২০৮৭। বুথের সংখ্যা ছিল ১৮৪৪টি। ভোট পড়েছিল ৭৯.১ শতাংশ। তাই হয়তো অধীর চৌধুির বলছেন লোকসভা ভোটে তাকে হারানো মুশকিল। কিন্তু তার শিয়রে কাঁটা হল, বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের ছটিতে জয়ী তৃণমূল। আর সেগুলি মুসলিম অধ্যুষিত। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় মেরুকরণের ফলে মুসলিম ভোট ইউসুফ পাঠানের দিকে ঝুঁকলে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হতে পারে অধীর চৌধুরিকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct