মোঃ সাহিদুল ইসলাম ও নাজমুন নাহার, আপনজন: ‘ভালো’ নামক শব্দটি একটা বিশেষণ এবং এটিকে আপেক্ষিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে যখন কোনো প্রাণী তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পরায়ণতা হয় এবং যদি কোনো দ্রব্য ধাতু-গত ক্রিয়া করে তাহলে সেটিকে আমরা নিঃসন্দেহে ‘ভালো’ রূপে গণ্য করি। যেমন একজন মানুষ- চিন্তাশীল সামাজিক প্রাণী হিসেবে সে তার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে, তাহলে কি ‘ভালো’ নামক শব্দটির কোনো ব্যাবহারিক মূল্য আছে ? বা কোনো দ্রব্য যেমন “বিষ” ধাতু গত ক্রিয়া করে তাহলে কি আমরা ভালো-বিষ বলে মনে করা উচিত নয়। অতএব, “ভালো” শব্দটি একটি আপেক্ষিক বিশেষণ। কিন্তু এই বিশেষণটা কি আজকের যুগে কোনঠাসা হয়ে বিলীন হয়ে গেছে ? ‘ভালো’, হোক সেটা প্রাণিকুলে বা বস্তু-জগতে একটা প্রাকৃতিক ধর্ম বা গুন্ হিসেবে সব ক্ষেত্রেই বিজারণ হয়ে যাচ্ছে। জীবনের প্রতি পদক্ষেপ ও প্রতি-স্তরে “ভালো”ই মরিচা পড়ে যাচ্ছে।সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্ত ক্ষেত্রে ‘ভালো ‘ শব্দ টি যেন ব্যতিক্রম ধর্ম ক্রিয়া করছে। কবি গুরু আজ নিশ্বাস নিলে হয়তো উনি বলতেন ‘আমি এই সুন্দর ভুবনে বাঁচতে চাইনা’।
সামাজিকভাবে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে, সমাজ জীবনের মৌলিক একক হিসাবে পরিবারকে ধরা হয়। সেই পরিবারের মধ্যেও যেন ‘ভালো’ গুণ টা অমিল। জন্ম-ধাত্রী মাতা- পিতার আগে ভালো বিশেষণটা লাগাতে দ্বিধাবোধ করছিনা। মাতা-পিতা ভালো নয় বলে তাদেরকে পরিত্যাগ করে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। আবার সেই মাতা-পিতা পক্ষান্তরে, জন্মের পরে ছেলে মেয়ে কে কিভাবে “ভালো” করে মানুষ করবো সেই তাগিদে পুরো জীবন লাগিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেকেই দুশ্চিন্তায় ভোগে কি করে আজকের যুগে ছেলে ‘মানুষ’ করবো। আর সেই মানুষ আজকে বলছে একটা ‘ভালো’ ভাই চায় , ভালো বোন চায়, ভালো স্বামী চায়-স্ত্রী চায়, একটা বৌমা চায় ইত্যাদি । অর্থাৎ সব কিছু “ভালো’ চাই। তাহলে “ভালো” শব্দটা কি অধরা ? না আমরা আজকে মানুষ হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য-ন্যায়-নিষ্ঠা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু পরিবারের মধ্যেই না বাহিরেও “ভালো “ বিশেষণ টা যেন দুষ্কর হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও জীবন দায়ী ওষুধ থেকে শুরু করে খাবার, পোশাক, রাস্তা-ঘাট, আত্বিয়তা, ভালো শিক্ষক, ভালো ডাক্তার ইত্যাদি বিষয় গুলি আজকে “ভালো” বিশেষণটার দিকে ছুটছে। অথচ ‘ভালো’ গুন্ টাই মানুষের বা বস্তুর বুৎপত্তি ধাতু যেটি তার মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, “বিকশিত ভারত” বা “এগিয়ে বাংলা” নামক বিভিন্ন স্লোগান মন্ত্র দিয়ে যে রাজ-ভান্ডার চালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমাজ কে এক উন্নত দিশাতে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানেও “ভালো” বিশেষণটা যেন অণুবীক্ষক হয়ে পড়ছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচন ক্ষেত্রে হিংসা-মারামারি , খুনখারাবি-চোর-চাপাটি ইত্যাদি বিষয় গুলি যেন শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের অংশ হয়ে গেছে। যে রাজনীতি ‘ভালো’ সমাজ ব্যবস্থা গঠনের অঙ্গীকার করছে তাঁরাই আবার এসবের নেপথ্যে। এ কেমন তুমি “ভালো”? সমাজের একটাই চাহিদা ‘ভালো দল’ চায় , ‘ভালো’ নেতা চায় , ‘ভালো’ সরকার চায় , ‘ভালো’ রাজ্য চায়, ‘ভালো’ দেশ চায় , ভালো শাসন-ব্যবস্থা চায়। তাহলে সবের মূল লক্ষ্য যদি ‘ভালো’ হয় , তাহলে ‘ভালো’ কেন ব্যতিক্রম হয়ে পড়ছে ?
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও, ‘ভালো’ বিশেষণটির চাহিদা ও যোগান এর গরমিল লক্ষ্য করা যায় না সেটি কিন্তু নয়। এখানে কিন্তু “ভালোর” খুব বেশি চাহিদা দেখা দেখা যায় অর্থাৎ যোগান খুব কম। ভারসাম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থ্যা। একদিকে যেমন মুষ্টিমেয় মানুষ পুঁজিপতি হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। একদিকে মানুষ অট্যালিকা-প্রাসাদ গড়ছে অন্যদিকে মানুষ আত্ম-হত্যা করছে। একদিকে মানুষ যেমন শিল্প-কারখানা বানাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষ দেশান্তর হয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন টেকনোলজি-আধুনিকতা বাড়ছে অন্যদিকে মানুষ বেরোজগার হয়ে পড়ছে। একদিকে যেমন উন্নয়ন শীল প্রকল্প শুরু হচ্ছে , অন্যদিকে দুর্নীতির পাহাড় তৈরি হচ্ছে। একদিকে যেমন সাক্ষরতা বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মের বাজারে ধস নামছে, চাকরি ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় নামছে। একদিকে ৫ থেকে ৭ ট্রিলিয়ন অৰ্থ-ব্যবস্থার অঙ্গীকার, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি ফেঁপে উঠছে। তাই আজ চারিদিকে, ভালো কর্ম চাই, ভালো আয় চায়, ভালো অর্থ-নীতি চায় -শুধু একটাই চাহিদা সেটা হলো “ভালো”। সবকিছু আছে কিন্তু শুধু “ভালো” টাই নেয়। ধর্মীয়-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে বিশেষণটার উৎপত্তি দেখা যায় সেটা হলো “ভালো” বা সৎ। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও “ভালো” শব্দ টাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আজ ধার্মিক লোকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার হিংসার দৃষ্টান্তও কম নেই। খোলা রাস্তা থেকে শুরু করে স্কুল- বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ধর্মান্ধর যে কুপ্রভাব সেটা খুব স্পষ্ট। সমাজ ব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে খুব স্পষ্ট “জেনারেশন-গ্যাপ” দেখা যাচ্ছে। শিশুদের শৈশব কাল যেন কোথায় বিলীন হয়ে গেছে। সংস্কৃতির নাম “ইন্টারনেট” এর যুগে কোথাও যেন সমাজ আজ টিক-টক দুনিয়াতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একজন মানুষ হিসেবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সচেতনতার অভাব যেন আষ্টে -পিষ্টে লক্ষণীয়। এখানেও আজকে কোথাও ভালো ধর্মীয়-সংস্কৃতির জন্যে মানুষ কাতরাচ্ছে। যাইহোক, “ভালো” বিশেষণটা শুধু মাত্র একটা ক্ষেত্রেই যে অনুপস্থিত তা নয় বরং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই এর চাহিদা বাড়ন্ত। যে বিশেষণটা মানুষের জীবনের মৌলিক প্রাকৃতিক ধর্ম- গুণ, সেটা আজকে যেন ব্যতিক্রম ধর্ম-ক্রিয়া করছে। মানুষ আজ তার নিজের জন্মগত বৈশিষ্টকে ত্যাগ করে পার্থিব জগতের পরিমাপে ‘ভালো’র পিছনে ছুটছে। মানুষ যদি তার নিজস্ব দায় -দায়িত্ব -কর্তব্য-ন্যায়-পরায়নয়তা পালন করে, তাহলে কি সত্যই সমাজে “ভালো” বিশেষণটার চাহিদা থাকবে? না তা কে মুখোশধারী ভালো মানুষ সেজে পরিচয় দিতে হবে ? না কোনো তার বিজ্ঞাপন দেওয়ার দরকার ?
লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct