জাইদুল হক, আপনজন: সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে িসপিএম প্রার্থী ঘোষণা করেছে মুহাম্মদ সেলিমকে। শনিবার বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু দ্বিতীয় দফায় বামফ্রন্টের যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ সেলিমের নাম ঘোষণা করেন মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের জন্য। বামফ্রন্টের ইতিহাসে রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচনে লড়াই করার নজির খুব কম। ২০১৬ সালে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক থাকাকালীন সূর্যকান্ত মিশ্রকে মেদিনীপুরের নারায়ণগড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএমের প্রার্থী করা হয়েছিল। এবার সেলিম হলেন সিপিএমের দ্বিতীয় রাজ্য সম্পাদক যাকে নির্বাচনে প্রার্থী করা হল। তবে, লোকসভায় প্রার্থী হিসেবে সিপিএমের হয়ে প্রথম মুহাম্মদ সেলিমই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে, সেলিম দক্ষ সাংসদ হিসেবে আগেও পরিচয় রেখেছেন। তবে, তার লোকসভায় লড়াই করার ক্ষেত্রটা এই নিয়ে বার তিনেক পাল্টে গেল। কিন্তু এবারে লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করার পরিস্থিতিটা অনেকটা কঠিন সেলিমের। এর আগে লোকসভায় প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ২০১৪ সালে উত্তর কলকাতা কেন্দ্র থেকে। সেসময় তিনি জাঁদরেল তৃণমূল প্রার্থী অজিত পাঁজাকে হারিয়ে দেন। এরপর তিনি ভোটে দাঁড়ান রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে থেকে ২০২১৯ সালে। কিন্তু একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে কংগ্রেস ও তৃণমূল প্রার্থী থাকায় সেলিমকে নিয়ে চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ভোট কাটাকাটির খেলায় সেলিম মাত্র ১৪.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তৃণমূল প্রার্থী কানাইলাল আগরওয়ালকে পিছনে ফেলে জিতে যান বিজেপি প্রার্থী। আর চতুর্থ স্থান হয় কংগ্রেসের। যদিও রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ দীপা দাশমুন্সী মাত্র ৬.৬ শতাংশ ভোট পাওয়ায় জামানত জব্দ হয়।
এবার উত্তরবঙ্গ ছেড়ে মুহাম্মদ সেলিম লড়তে নামলেন মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে। অবশ্য, মুহাম্মদ সেলিম মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে লড়াই করায় এই কেন্দ্রটি এখন নজরকাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সেলিমকে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে সিপিএমে লড়াইয়ে নামানোর পিছনে নানা কারণ থাকলেও তার এই প্রার্থী হওয়ার পিছনে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরির বিশেষ বদান্যতা রয়েছে। অধীর আগেই জানিয়েছিলেন, মুহাম্মদ সেলিম মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে প্রার্থী হলে কংগ্রেস সেখানে প্রার্থী দেবে না। কংগ্রেস সত্যিই মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে প্রার্থী দেয়নি। তাই সেলিম মুর্শিদাবাদে প্রার্থী হওয়ায় সেখানে মূলত ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কিন্তু লড়াইটা খুব সহজ নয়। বর্তমানে রাজ্যে সিপিএমের একজনও বিধায়কও নেই। সেই পরিস্থিতিতে লোকসভার আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতে সেলিমকে দিয়ে একটা বাজি রাখল সিপিএম।
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রটি বর্তমানে তৃণমূলের দখলে থাকলেও সেখানকার সাত বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা, রানিনগর, মুর্শিদাবাদ, হরিহরপাড়া, ডোমকল ও জলঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্র। আর নদিয়ার করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্র। এর মধ্যে ভগবানগোলার বিধায়ক ইদ্রিশ আলির মৃত্যু হওয়ায় সেখানে উপনির্বাচন হবে। যদিও এখনও সেখানে প্রার্থী ঘোষণা করেনি কোনও দল। তবে,েমুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে একটা বড় ভূমিকা নিতে পারে ভগবানগোলা। কারণ, ভগবানগোলা ও রানিনগর বিধানসভা এলাকা থেকে বিপুল ভোট পাওয়ায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী আবু তাহের খানের জেতা সহজ হয়ে উঠেছিল। এবারও তিনি এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন যেহেতু হেভিওয়েট প্রার্থী মুহাম্মদ সেলিম তাই মুর্শিদাবাদের মানুষ জোর লড়াই দেখবে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
এখন প্রশ্ন, সত্যিই কি আবু তাহের খানের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ সেলিম প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূল চাপের মুখে পড়তে পারে? যদিও গত লোকসভা নির্বাচন ও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রটি কিন্তু তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতে থাবা বসাতে সিপিএম অস্ত্র করতে চাইছে সেলিমকে। আর তাতে সহায়তা দিচ্ছে কংগ্রেস।
এর সবটাই নির্ভর করছে মুর্শিদাবাদের বিপুল সংখ্যক মুসলিম ভোটারদের উপর। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের তথ্য অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোটারদের হার ৬৮.৫ শতাংশ। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের মুর্শিদাবাদ ও করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি বাদে বাকি পাঁচটি বিধানসভা এলাকায় মুসলিমের হার ৬৫ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি মুসলিম ভগবানগোলা বিধানসভা কেন্দ্রে। সেখানে মুসলিমদের হার ৮৫.৭ সাত শতাংশ। এছাড়া, রাহিনগরে ৮১.৩ শতাংশ, হরিহরপাড়ায় ৭৮.৭ শতাংশ, ডোমকলে ৮৪.৬ শতাংশ ও জলঙ্গিতে ৬৮.৯ শতাংশ মুসলিম ভোট। আর এই পাঁচটি কেন্দ্রের উপরই সবসময় নির্ভর করে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে কে জিতবে। একসময় মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রটি কংগ্রেসের খাসতালুক ছিল। ২০০৯ সালে শেষ বার কংগ্রেস প্রার্থী আবদুল মান্নান হোসেন সাংসদ হয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে। মান্নান হোসেন ২০১৪ সালে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের হয়ে লড়লেও ভোট কাটাকাটির খেলায় সিপিএম প্রার্থীর কাছে হেরে যান। তার মূলে ছিল ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সে সময় জয়ী সিপিএম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খান মাত্র ৩৩.২ শতাংশ পেয়ে জয়ী হন। মান্নান হোসেন পেয়েছিলেন ৩১.৭ শতাংশ ভোট। আর তৃণমূল প্রার্থী মুহাম্মদ আলি পেয়েছিলেন ২২.৪ শতাংশ ভোট।
এর পরে তিনি মান্নান হোসেন অবশ্য তৃণমূলে যোগ দেন। তার পুত্র সৌমিক হোসেন রানিনগরের তৃণমূল বিধায়ক। তাই তৃণমূলের শক্ত জমিনে কঠিন ‘খেলা হবে’ মুহাম্মদ সেলিমের। আসলে সিপিএম ও কংগ্রেসের পরিকল্পনা হল বিজেপি বাদে তৃণমূল বিরোধী ভোট একত্র করে রাজ্যের শাসক দলকে হারানো। কংগ্রেস ও আইএসএফ মুর্শিদাবাদে প্রার্থী না দেওয়ায় সেলিমকে সেই সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু কতটা লড়াই দিতে পারেন সেলিম তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে তৃণমূলেরই আধিক্য। বাম ও কংগ্রেস জোট করলেও তৃণমূলের থেকে কোনও আসন ছিনিয়ে নিতে পারেনি। ভগবানগোলা বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল ইদ্রিশ আলিকে। সিপিএম প্রার্থী করেছিল কামাল হোসেনকে। বিজেপিও মেহবুব হোসনে নামে একজন মুসলিমকে প্রার্থী করেছিল। িকিন্তু তা কাজে আসেনি। ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা খেললেও ভগবানগোলার সিংহভাগ মুসলিম ও হিন্দু তৃণমূলকেই বেছে নেয়।
রানিনগর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রদান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কংগ্রেস। তৃণমূলের আবদুল সৌমিক হোসেন ৬০.৭৯ শতাংশ ভোট পেলেও কংগ্রেস প্রার্থী ফিরোজা বেগমকে মাত্র ২৪.৮৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষান্ত থাকতে হয়। এমনকি বিজেপি মাসুয়ারা খাতুনকে প্রার্থী করেও ভোট পায় মাত্র ৯.৫৩ শতাংশ। এই বিধানসভা কেন্দ্রে আইএসএফ প্রার্থী করেছিল গোলাম মাসুম রেজাকে। কিন্তু তিনি মাত্র ১.২৫ শতাংশ ভোট পান। মুর্শিদাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রে এখন বিজেপি বিধায়ক। তৃণমূল ও কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটির খেলায় জেপি প্রার্থী গৌরীশং্কর ঘোষের ভাগ্য খুলে যায়। গৌরীশং্কর ঘোষের বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল শাওনী সিংহ রায়কে। শাওনী মাত্র ২৪৯১ ভোটে বিজেপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। কংগ্রেস প্রার্থী নিয়াজুউদ্দিন সেখ ২৮৮৩৫ ভোট পাওয়ায় শাওনীর জয়ের রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয় নোটা। নোটায় ভোট পড়েছিল ২৯০৪টি। এই মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রটি ছাড়া করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি কিছুটা শক্তিশালী। করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি হারলেও ৩৯.৪৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বিজেপি জলঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রে ১৭ শতাংশ ভোট পেলেও বাকি সব বিধানসভা কেন্দ্রে ৯ শতাংশও ভোট পায়নি। তবুও লোকসভা নির্বাচনে এবার মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে মুর্শিদাবাদের বিধায়ক গৌরীশং্কর ঘোষকে। এবার বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণে খেলা খেলতে চাইছে। যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মুসলিম ভোট পাওয়অর আশায় প্রার্থী করেছিল হুমায়ুন কবিরকে। হুমায়ুন কবির ১৭.২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল। সিপিএম ছিল চতুর্থ স্থানে। তবে সেই হুমায়ুন কবরি পরে তৃণমূলে যোগ দেন। বর্তমানে ভরতপুরের তৃণমূলের বিধায়ক। তাই এবার আর সেই ভুল না করে মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র গৌরীশং্কর ঘোষকে প্রাথী করেছে বিজেপি। সিপিএম মুহাম্মদ সেলিমকে প্রার্থী করায় গৌরীশং্কর ঘোষকে যে অনেকটা ব্যাকফুটে যেতে হবে তাতে সন্দেহ নেই।
সিপিএমের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে জোটের প্রার্থী হিসেবে সেলিমকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন অধীর চৌধুরি। অবশেষে বাম নেতৃত্ব তাতে সিলমোহর দিয়েছে। ঝানু রাজনীতিবিদ সেলিম অঙ্ক কষেই বাম নেতৃত্বের ইচ্ছায় সায় দিয়েছেন। কারণ ভোট প্রাপ্তির নিরিখে মুর্শিাদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের পরের স্থান কংগ্রেসের। ২০২১ বিধানসভা ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে সাতটি বিধানসভায় কংগ্রেস ও সিপিএমের মিলিত ভোটের হার ৩৮.৮২ শতাংশ। আর তৃণমূলের একার ৪২ শতাংশ। তফাত মাত্র ৩.১৮ শতাংশ। কিন্তু মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রটি আবু তাহেরের শক্ত জমিন। গত পাঁচ বছরে তার প্রভাব ও জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিয়েছেন। সেটাকে টপকে যাওয়া সেলিমের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। কিন্তু
সেলিম হয়ত ভাবছেন, যদি নিজের ক্যারিসমায় কিছু বাড়তি ভোট পাওয়া যায় তাহলে তৃণমূল প্রার্থী আবু তাহের খানকে হারানো অসম্ভব নয়। কিছুদিন আগেই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম রাম সব একজোট। মমতার কথা যদি খানিকটা সত্যি হয়, তাহলেও তৃণমূলের প্রার্থীকে প্রবল বেগ পেতে হবে সেলিমের বিরুদ্ধে জিততে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বিজেপির বা তৃণমূলের ভোটে থাবা বসাতে পারলে তবেই সেলিমের কেল্লা ফতে করা সম্ভব। কিন্তু সে কাজটা খুবই কঠিন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct