কয়েক বছরে উন্নয়নের স্লোগান ও পোস্টার চারদিকে ছেয়ে গেছে। যেখানে তাকাও উন্নয়ন আর উন্নয়নের পোস্টার ও বিজ্ঞাপন, আবার কেউ বলছে উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে প্রচারের তুলনায় জনসাধারণ কেমন আছেন। তা নিয়ে লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।
কয়েক বছরে উন্নয়নের স্লোগান ও পোস্টার চারদিকে ছেয়ে গেছে। যেখানে তাকাও উন্নয়ন আর উন্নয়নের পোস্টার ও বিজ্ঞাপন, আবার কেউ বলছে উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্য করলে মোটেই ভালো নেই জনসাধারণ। একদিকে সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে সম্পদের পরিমাণ দিন দিন কমছে অন্যদিকে রুটির সন্ধানে হন্যে হয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কাজের জন্য ছুটতে হচ্ছে শ্রমিক থেকে শিক্ষিত বেকারদের। কয়েকটি রাজ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে প্রযুক্তি শিক্ষিত যুবক যুবতীরা। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে একদিকে সাধারন মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও অন্নের জন্য যখন সরকারি পরিষেবার উপর নির্ভর করছে সেই সময় বহুলোকের টাকা বিদেশে গুচ্ছিত রয়েছে। এছাড়া বিদেশে গাড়ি, বাড়ি, বাংলা থেকে শুরু করে সবকিছু। দেশের শিক্ষার বেহাল দশা,মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা যখন নিরিখে তখন কিছু সংখ্যক মানুষ গ্যাস অম্বলের চিকিৎসা করাতে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের মতো উন্নত দেশে যাচ্ছে। তারপর নেতা-নেত্রীদের গলার আওয়াজ, পতাকা বাহিনী যুবক-যুবতীদের পেট ভর্তা স্লোগান দেখে আফসোস করা ছাড়া উপায় নাই। যে বেকার কর্মসংস্থান নিয়ে দিনের পর দিন অনশন করে, তার বাবা, মা, ভাই, বোন, পরিবার-পরিজন সেই সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও স্লোগান করে প্রচার কয়েকশো টাকা ভাতার বিনিময়ে। দুর্নীতির আখড়ায় নানা সরকারি পরিষেবা ও জনসাধারণ বঞ্চিত হয়। আবার তারাই প্রতিবাদী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দুর্নীতি পরায়ণ নেতা-নেত্রীকে সুরক্ষা প্রদান করে ও আগলে রাখে। যে নেতা জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করে ও জনসাধারণের নানা প্রকল্পের টাকায় নিজের অট্টালিকা বানায়, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সেই নেতা আবার দরিদ্র জনগনের অসহায়তার সময় দানধান করলে দানবীর ও গরিব বন্ধু নামে আখ্যায়িত হয় জনগণ ও হতভাগা মানুষের কাছে। যে সমস্ত নেতা রাস্তাঘাটের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, আবাস যোজনার টাকা নয় ছয় করে, তারাই আবার সকাল সন্ধ্যা জনগণকে গরম গরম চা অফার করেন ও একটি ত্রিপল প্রদান করলে মহান ও রূপকার হিসেবে আখ্যায়িত হয়। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে কত নেতা-নেত্রী যে এলাকার গর্ব তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে দেখা যায় কাজ না পাওয়া শিক্ষিত বেকারদের পোস্ট ও মন্তব্যে। একটাই কারণ, এই শিক্ষিত বেকারদের বেঁচে থাকার মাধ্যমে সেই সব দুর্নীতিপরায়ণ নেতারা। একদিকে চাকরির প্রলোভন অন্যদিকে এই দাদাদের সাথে থাকলে দুই বেলা ফ্রিতে খাবার পাওয়া যায় জনগণের আত্মসাৎ করা টাকায় ও সাথে মদ, জুয়া থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক মনোরঞ্জন। আর কি চাই বলুন তো, কয়েকদিনের পৃথিবীতে ভবঘুরে হয়ে লালনের মত কাটাতে পারলেই তো মুক্তি। চাকরি-বাকরি করলে কত দায়-দায়িত্ব পরিবার-পরিজন ছেলে মেয়ে কত আবদার,ঝুট- ঝামেলা। এইসব ঝুট -ঝামেলা না করে নিজেদের মতো থাকা, খাওয়া-দাওয়া, মোজ-মাস্তি নিয়ে বেঁচে থাকা। দাদা দিদি হ্যাঁয় তো মুমকিন হ্যায়। নো টেনশন, নো গেন (No tension, no gain) আস্থায় বিশ্বাসী, এমন ধ্যান-ধারণা পূর্ণতা পেয়েছে যুবসমাজে তা নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ সামাজিক কাঠামো তৈরি হতে চলেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে না বলে, দুর্নীতিতে শামিল হওয়াটাই ঝামেলা মুক্ত বলে মনে করছেন। তাই প্রত্যক্ষ দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রী ও মানুষগুলো সমাজে ভগবান হয়ে উঠেছে। কিছু টাকার সাম্মানিক পাওয়া নেতা-নেত্রী কোটি কোটি টাকার মালিক। এই নেতানেত্রীরা নিয়ে চলে লাই-লস্কর ও চাকর-বাকর থেকে পেট ভর্তা স্লোগান বাহিনী সহ চোখ রাঙানি মস্তান ও গুন্ডা বাহিনীর। এদের খাওয়া দাওয়া, ভরণ পোষণ এক শ্রেণির নেতারাই বহন করেন।
তারপরও মানুষ দুই হাত তুলে জনসমর্থন দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে সামান্য প্রতিবাদী মানুষদের চুপচাপ থাকা ছাড়া উপায় আছে বলে মনে হয় না। এমন সমাজই তো অধঃপতনের সমাজ যেখানে সামাজিক মূল্যবোধ নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভাবুন আমরা উন্নয়নের এমন দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি যে সমাজে আমরা নিজেদের উপার্জনের কথা চিন্তা না করে বিভিন্ন ভাতার দিকে চাতকের মত চেয়ে আছি। ভিক্ষাবৃত্তির মত নিকৃষ্ট আর কিছু হতে পারে না তেমনই একটি সমাজ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করার জন্য প্রত্যেকে চিন্তাভাবনা ও কাজকর্ম থেকে দূরে রেখে ভাতা দিয়ে চুপচাপ করে রাখা হয়। কিনা সুখের সংসার আজ বাংলার মাটিতে, সকলেই কোন না কোন ভাতার প্রকল্প নিয়ে বেশ ভালো আছে। সরকার ঘর দিচ্ছে আবাস প্রকল্পের মাধ্যমে, পায়খানার ঘর করে দিচ্ছে, ও অপরদিকে রেশনের দোকানে চাল, ডাল ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফ্রিতে ও সামান্য টাকার বিনিময়ে। ধুর তারপর কাজের কথা যারা বলে নেহাত বোকা বোকা মনে হয়। তাও বাদ দিলাম, ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেলে মিড-ডে মিল, স্কলারশিপের টাকা পায়, সবুজ সাথীতে করে কি সুন্দর ভাবে চলাচল করে। এছাড়া একটু বড় ক্লাসে উঠলে ট্যাব পায় পড়াশুনার জন্য যদিও স্কুলে পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক- শিক্ষিকা আছে কিনা তা নিয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার অবকাশ নেই। শুধু তাই নয়, পড়াশোনা করার পর ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কি, স্কুল বন্ধ হচ্ছে ধীরে ধীরে তা নিয়ে খেয়াল ন্যায় কোন অভিভাবকের। আর নেবেন বা কেন উপার্জনের ও কর্ম করার কোন প্রয়োজনও তো নেই। সব কিছু ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে, তারপর খোঁচা দেওয়ার কোন অর্থ হয় না। শুধু কি তাই, আজকাল তো আর পুরুষদের গৃহিণীকে হাত খরচ লাগেনা। ফলে অশান্তি কমেছে পরিবারে ও গৃহিণী আবদার করছে না আলতা, ফিতা ও লিপস্টিক কেনার জন্য টাকার। লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় ঘরের লক্ষ্মীরা হয়েছে কয়েক গুণ বেশি লক্ষ্মী। ঘরে ঘরে আদর বেড়েছে, মহিলারা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছে ও তাদের আজ বরের কাছে হাত পাততে হয় না আলতা ফিতার জন্য। তার ফলে বরের চায়ের দোকানে বিড়ি তামাক,খৈনির জন্য ঘাটতি হয় না। হুহু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে সরকারের কোষাকারে আয়। সবকিছু বিচার করলে বিভিন্ন প্রকল্পের সুফল সবাই স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। বেকার বলতে বাড়িতে এমএ ও বিএ পাস উচ্চশিক্ষিতরা ও পড়াশোনা শেষ করে বসে থাকা যুবক যুবতীরা। যদিও চিন্তা নেই মেয়ে বড় হলে বিয়ের জন্য টাকা দেওয়া হচ্ছে তা দিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষাও হয়ে যাচ্ছে। তারপর সরকারি কাজকর্ম ও নেতাদের নিয়ে সমালোচনা অর্থহীন। উন্নয়নের জোয়ারে সকলেই কোন না কোন ভাতা পায় তারপর রেশনের দোকানে বিনামূল্যে চাল ও গম এবং ঈদ, পূজা-পার্বণে নানা নিত্য সামগ্রী আপ্লুত করেছে জনসাধারণকে। পাশাপাশি সম্প্রীতির বন্ধনের বার্তার মধ্য দিয়ে ভালোই আছে বাংলা ও বাঙালি।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct