জাইদুল হক, আপনজন: ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দল ৪২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবুও রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু আসনে যেখানে নজরকাড়া প্রার্থীরা রয়েছেন। এই সব আসনের মধ্যে আপাতত রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র। বর্তমানে সন্দেশখালি কাণ্ডকে ঘিরে চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বসিরহাট কেন্দ্র। বিরোধী দলগুলি সন্দেশখালি কাণ্ড ঘিরে যেভাবে শোরগোল তুলছে তাতে রাজনৈতিক পারদ ক্রমশ চড়ছে। সেই পারদ বুধবার আরও চড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী জনসভা থেকে বুধবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আহ্বান জানিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী হাজী নুরুল ইসলামকে চার লক্ষেরও বেশি ভোটে জেতানোর জন্য। অভিষেকের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তৃণমূলকে জেতানোর আহ্বান জানানোর মধ্যে নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম বলা যেতে পারে, এখনও বিরোধী দল বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি। ফলে তৃণমূল ধরেই নিচ্ছে তারা রাজনৈতিকভাবে এখন এগিয়ে তাই তাদের জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বসিরহাট নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু করে তুলছেন।
বিগত লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যাবে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রটি তৃণমূল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। তাই হয়তো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিয়ে বলেছেন গত বারের থেকে মার্জিন বাড়িয়ে নিতে। অভিষেকের এই দাবি করার মধ্যে যৌক্তিকতা থাকলেও বিষয়টি ততটা সহজ নাও হতে পারে। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন অভিনেত্রী নুসরত জাহান। কিন্তু সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তার জীবনচরিত নিয়ে বসিরহাটের মানুষজন নানা সমালোচনা শুরু করেন। তাই এইবারের লোকসভা নির্বাচনে তাকে তৃণমূল প্রার্থী করবে না প্রায় নিশ্চিত ছিল। বাস্তবে সেটাই হল। কিন্তু বসিরহাটে প্রার্থী করা নিয়ে দোদুল্যমান ছিল তৃণমূল। তার মূলে তৃণমূলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জেরে প্রচুর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল ২০১৪ সালের বসিরহাটের সাংসদ প্রয়াত ইদ্রিশ আলি। তখন সেই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জন্য আঙুল তোলা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হাজী নুরুল ইসলামের দিকে। অনেকের মতে, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব এড়াতেই গতবার নুসরত জাহানকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। এবারে প্রশ্ন উঠছিল কাকে তৃণমূল প্রার্থী করবে। সেই দিক থেকে বসিরহাটের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ হাজী নুরুল ইসলাম অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। তিনি ২০০৯ সালে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের হয়ে সাংসদ হলেও পরে দল তাকে প্রার্থী করেনি। দলের সেই সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুড বুকে ছিলেন হাজী নুরুল। তার ফলশ্রুতিতে, হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রে হাজী নুরুলকে প্রার্থী করে তৃণমূল। এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে তাকে রাজ্য হজ কমিটির চেয়ারম্যান করে হাজী নুরুলকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে তৃণমূল। সেই হাজী নুরুলের জয় নিয়ে নিশ্চিত হয়ে পড়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ গোটা তৃণমুল কংগ্রেস।
প্রার্থী বিশ্লেষণে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বসিরহাটের জমিনে সাংসদ হওয়ার সাফল্য অর্জন করা হাজী নুরুলের জমি অনেকটাই শক্ত। সেখানে বিরোধী দলের প্রার্থীদের হাজী নুরুলকে হারানোর বিষয়টি সহজ অত সহজ হয়ে উঠবে না।
প্রথম, বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় ভরসা হল মুসলিম ভোট। ২০১১ জনগণনা ও ভোটার লিস্ট বিশ্লেষণের পর দেখা যাচ্ছে এই কেন্দ্রে মুসলিম ভোটের হার ৪৬.৩ শতাংশ। আর গত বার লোকসভা ভোটে তৃণমূল খংগ্রেসের ভোটপ্রাপ্তির হার ৫৪.৯ শতাংশ। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বিন্দ্বী বিজেপি পেয়েছে ৩০.৩ শতাংশ ভোট। ফলে, তৃণমূল শুধূ মুসলিম ভোটের উপর ভর করেই বিজেপিকে টপকে যেতে পারে তা মুসলিম সমর্থন দেখেই বোঝা যায়। এমনকী, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল অনুযায়ী তৃণমূলের ভোটরে হার ৫৩.৭ শতাংশ, আর বিজেপির ভোটের হার ২৮.৬ শতাংশ। তাই বিজেপি তৃণমূলের মুসলিম ভোটের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি ধরে নেওয়া যায়। এমনকী বাম, কংগ্রেস তৃণমূলের অর্ধেক ভোটও পায়নি। তবে, এটা ঠিক, গত লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাটে কংগ্রেস ও বাম দল সিপিআই উভয়ই প্রার্থী দিয়েছিল। াবশ্য, বিধানসভা নির্বাচনে পরিস্থিতি িকছুটা পাল্টাতে শুরু করে। বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছেছ্ সেগুলি হল: বাদুড়িয়া, হাড়োয়া, মিনাখাঁ (এসসি), সন্দেশখালি (এসটি), বসিরহাট দক্ষিণ, বসিরহাট উত্তর ও হিঙ্গলগঞ্জ (এসসি)। এর সবকটিতেই তৃণমূলের বিধায়ক। এরপরও কিন্তু হাজী নুরুলের জয়ের পথ কণ্টকময় হয়ে উটতে পারে যদি বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ জোট হেভিওয়েট প্রার্থী দেয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিজেপি বসিরহাটে তেমন প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। অথবা তারা নিশ্চিত হারের আশঙ্কা করেই বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ প্রার্থীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
যদিও বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদি কিংবা অমিত শাহরা বড় আশা করছেন সন্দেশখালিল ঘটনার জেরে মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন ব্যালট বক্সে দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে লাভবান হবে বিজেপি। কিন্তু তার সম্ভাবনা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, বিজেপি সন্দেশখালির ঘটনাকে প্রথম থেকে একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ সৃষ্টি করে অস্থিরতার মাধ্যমে তফশিলি প্রধান এলাকার মানুষের সমর্থন পেতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। যদিও অস্বীকার করা যাবে না, সন্দেখালি কাণ্ডে সন্দেশকালি এলাকায় কিছু প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু তা কতটা সেটা অনুমান করা দরকার। আর তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে তাদেরকে হারানোর বিষয়টি খুব সহজ বলে মনে হচ্ছে না। যদিও সন্দেশকালিতে বিজেপির শক্তি কুব কারাপ নয়। কিন্তু সেটাকে বিচার করে সমগ্র বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে কথা ভাবলে ভুল হতে পারে। গত বিধানসভা নির্বাচনে সন্দেশখালি (এসটি) কেন্দ্রে তৃণমূল জয়ী হয়েছে। তৃণমূল প্রার্থী সুকুমার মাহাতো পেয়েছিলেন ৫৪.৬৫ শতাংশ। ভোট। এই কেন্দ্রে মুসলিমদের হার ২৪.৬ শতাংশ থাকায় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাল ভোট পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। বিজেপি প্রার্থী ভাস্কর সরদার ভোট পেয়েছিলেন ৩৫.৩৬ শতাংশ। সেই ভোট সন্দেশখালি কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে যদিবা কিছুটা বাড়ে কিন্তু তাতে তৃণমূলকে ততটা বাগে ফেলতে পারবে না। গত বিধানসভা নির্বাচনে বসিরহাট কেন্দ্রের কোনও কেন্দ্রে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলতে পারেনি। বরং, একটি দুটি কেন্দ্রে বিজেপি বাদে অন্য বিরোধী দল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। সেদিকে তাকানোও দরকার।
তবে, বিজেপি বুঝে গেছে, বসিরহাটে হিন্দু প্রার্থী দিয়ে হিন্দু ভোটে থাবা বসানো গেলেও তৃণমূলকে হারানো সম্ভব নয়। তাই তাদের নয়া পরিকল্পনা হতে পারে মুসলিম প্রার্থী দিয়ে মুসলিম বোটে ভাঙন ধরানো। তাই তারা তৃণমূলের কয়দায় বহরমপুরের মতো বসিরহাট কেন্দ্রে কোনও ভাল ক্রিকেটারকে দাঁড় করানো যায় কিনা ভাবছে বলে বিজেপি সূত্রে খবর। সেই পরিকল্পনা কতটা কাজে লাগবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিজেপি সেক্ষেত্রে অন্য বিরোধী দলগুলিকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কৌশল নিতে পারে। সেটা বুঝতে পেরেই তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব বারে বারে কংগ্রেস, বামের বিরুদ্দে বিজেপি সখ্যতার অভিযোগ তুলছেন। এমনখী আইএসএফের বিরুদ্ধে ভোট কেটে বিজেপির রাস্তা সহজ করে তেলার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ তৃণমলূকে জোর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার চেষ্টা করছে বলে দলের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর। তাই সিপিএম চাইছে তাদের শরিক দল সিপিআইয়ে দখলে থাকা বসিরহাট আসনটি তাদের হাতে ছেড়ে সেটি জোট প্রার্থীকে ছেড়ে দেওয়া হোক। সেক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। ভাঙড়ের আইএসএফ সূত্রের দাবি, বসিরহাট কেন্দ্রটি আইএসএফের হাতে ছেড়ে দেওয়অ দাবি তোলা হয়েছে বাম ওকংগ্রেস জোটের কাছে। আর সেক্ষেত্রে তারা প্রার্থী করতে পারে আইএসএফের মূল প্রতিষ্টাতা আব্বাস সিদ্দিকী। আইএএফের একটি মহলের দাবি, আব্বাস সিদ্দিকী বসিরহাটে প্রার্থী হলে ফুরফুরার প্রভাব থাকা বসিরহাটে হাজী নুরুলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মৃুখে পড়তে।
তবে, বসিরহাটে যে আইএএফের একাট প্রভাব আছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে, বসিরহাট উত্তর কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে ছিল আইএসএফ। ২০১৬ সালের সিপিএম বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় তাকে ২০২১ বিধানসভায় প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। তিনি ৫৭.৫৬ শতাংশ ভোট পেলেও মরহুম পীর আল্লামা রুহুল আমিন পরিবারের সন্তান বাইজিদ আমিন ২০.০৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। বিজেপি তৃতীয় হয়েছিল। আর হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রে আইএসএফ প্রার্থী কুতুবউদ্দিন ফতে ২১.৭৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। এমনকী সন্দেশখালি কেন্দ্রে আইএসএফ প্রার্থী বরুণ মাহাতো ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। অপরদিকে বাদুড়িয়া কংগ্রেস প্রার্থী আবদুস সাত্তার বিজেপির প্রায় ২১.২৫ শতাংশ ভোট পান। তাই আইএসএফ-এর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে দাবি উঠেছে নওশাদকে নয়, আব্বাস সিদ্দিকীকে বসিরহাটে প্রার্থী করা হোক। কারণ, তাদের মতে নওশাদকে প্রার্থী করলে ভাঙড় থেকে পালাচ্ছেন বলে আওয়াজ তুলতে পারে তৃণমূল। তাই তারা ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রেও নওশাদকে প্রার্থীমকরার বিরুদ্ধে। তাদের দাবি বসিরহাট কেন্দ্রে ফুরফুরার পীর পরিবারের যথেষ্ট প্রভাব থাকায় একমাত্র আব্বাস সিদ্দিকীকে প্রার্থী করলে আইএসএফ ভাঙড়ের মতো কেল্লা ফতে করতে পারেন বসিরহাট কেন্দ্রে। তবে, একথা অস্বীকার করা যাবে না, আব্বাস সিদ্দিকীকে আইএসএফ প্রার্থী করলে আর বাম কংগ্রেস সমর্থন পেলে হাজী নুরুলের চার লাখে জেতার বদলে কপালে ভাঁজ পড়তে পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct