তারাবির ইমাম
গোলাম মোস্তাফা মুনু
মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেব প্রায় নয় বছর ধরে একই মসজিদে ইমামতি করছেন। একই জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে ইমামতি করার ফলে সেই এলাকার প্রতি একরকম ভালোবাসা জন্মেছে তাঁর। গ্রামের অধিকাংশ মানুষেরই ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা পান তিনি। আর অল্প সংখ্যক লোক বরাবরই তাঁর সমালোচনা করে থাকে। তবে মোলবি সাহেবের সামনা সামনি নয়। মোলবি সাহেব গ্রামের প্রায় প্রতিটা মানুষেরই মন-মানসিকতা বুঝে গেছেন। যারা মোলবি সাহেবের পিঠ পিছে নিন্দা করে তাদের সাথেও তিনি হাসিমুখে কথা বলেন। তাদের সামনে তিনি এমন ভঙ্গি করেন যে, তিনি যেন তাদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না।মাঝে মাঝে সেই নিন্দুকদের প্রতি মোলবি সাহেবের রাগও হয়। মনে মনে। কিন্তু সেই রাগ মুহূর্তের মধ্যে সামলে নেন। বাইরে প্রকাশ করেন না। তিনি মনে মনে ভাবেন, ‘যদি আমি দু’কথা কাউকে বলতে যাই তাহলে সমাজের লোকের সাথে ঝামেলা বেঁধে যেতে পারে। অবশেষে হয়তো আমাকেই মসজিদ ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার বয়স হয়েছে। আমি তো আর বেশি ছোটাছুটিও করতে পারবো না। ফলে অন্য জায়গায় গিয়ে মসজিদের চাকরির ব্যবস্থাও করতে পারবো না। আর অনেক জায়গায় বয়স্ক মোলবিকে ইমাম হিসেবে রাখার পছন্দ করে না।’ এসব ভেবে নিয়ে তিনি সেসব নিন্দুকের কটু কথাকেও হজম করে নিয়ে ইমামতি করতে থাকেন। আজ রমজানের পহেলা চাঁদ উঠবে। রাত থেকেই তারাবির নামাজ আরম্ভ হবে। সকাল থেকে খুব খুশি মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেব। তারাবির নামাজে ইমামতি করে তিনি খুব মজা পান। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ অনেক আগেই গোসল সেরে নিয়ে যোহরের নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে মসজিদে বসে আছেন। যেগুলো সূরা দিয়ে তারাবি পড়াবেন সেগুলো সূরা যেন মনে মনে পাঠ করছেন। যথা সময়ে যোহরের নামাজ সমাপ্ত হলে মোলবি সাহেব নিজের ঘরে যান। তাঁর পিছনে পিছনে মোড়লসহ কয়েকজন নামাজিও ঘরে প্রবেশ করে। মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেব তাদেরকে বসতে বললে তারা নিজের নিজের আসন গ্রহণ করে। তারা প্রথমত কিছু অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করে। তারপর মোড়ল মোলবি সাহেবকে বলে, ‘মোলবি সাহেব, আপনার বয়স হয়েছে, ওঠাবসা করতে আপনার কষ্ট হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি। এত রাকাত তারাবির নামাজ পড়াতে আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
‘না, না। অসুবিধা হবে না। অন্যান্য বছরের মত এ বছরও পড়িয়ে দিতে পারবো। আপনারা এ নিয়ে চিন্তা করবেন না।’ মোলবি সাহেব কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে তার মতামত জানিয়ে দিলেন। ‘এবারের মত আমরা আপনাকে কষ্ট দিতে চাইছিলাম না, তাই আমরা আপনার মতামত জানতে এসেছিলাম। এখনও ভাবার সময় আছে মোলবি সাহেব, আপনি ভাবেন। আমরা এখন চলি।’ এ বলে মোড়ল মোলবি সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যায় মোড়ল সাহেবের সাথিরাও। মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেব আর বেশি কিছু না ভেবে দুপুরের খাবার খেয়ে কুরআন পাক পড়তে শুরু করেন। যেগুলো সূরা তারাবির নামাজে পড়বেন সেগুলো বেশি বেশি করে পড়তে থাকেন। আসরের এবং মাগরিবের নামাজের পরেও এভাবে চর্চা করতে থাকেন তিনি। তারাবির নামাজ পড়ার জন্য আজ নামাজীতে মসজিদ ভরে যায়। মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেব পাগড়ি জুব্বা পরিধান করে সামনের সারিতে বসে এশার নামাজের সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। সময় হয়ে যায়। দ্বিতীয় সারিতে বসে আছেন মোড়ল সাহেব। তার পাশে বসে আছেন আর একজন মোলবি সাহেব। যুবক। মোড়ল সেই যুবক মোলবি সাহেবকে ইশারা করে সামনে যেতে। একইসঙ্গে খাইরুদ্দিন সাহেবকে বলে, ‘মোলবি সাহেব, ইকামত দেন।’ মোড়লের নির্দেশ শুনে মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেব অবাক হয়ে যান। লজ্জাও পান। ক্ষনিকের মধ্যে তিনি সবকিছু বুঝে ফেলেন। দাঁড়িয়ে যান। যুবক মোলবি খাইরুদ্দিন সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘হুজুর, আপনি অনুমতি না দিলে আমি...!’খাইরুদ্দিন সাহেব ইশারাই অনুমতি দেন। যুবক মোলবি সাহেব ইমামের জায়গায় যান। খাইরুদ্দিন সাহেব অসহায় এবং অবাক দৃষ্টিতে একবার মোড়লের দিকে তাকান আর একবার নামাজীদের দিকে। তারপর ভাঙ্গা সুরে ইকামত দিতে শুরু করেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct