ডা. শামসুল হক, আপনজন: ইংরেজ জামানায় মুসলিম সমাজের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির জগৎটা এতখানিই ছোট হয়ে গিয়েছিল যে সেই সময়ের মুসলিম জনগণ চাইছিলেন অতি সত্বর প্রকাশিত হোক এমনই একটা সংবাদপত্রের যার মাধ্যমেই বিকশিত হবার সুযোগ পাবে মুসলিম সমাজের উন্নয়ন সহ যাবতীয় সমস্যার কথাগুলোই । আর সেজন্যই চলেছিল দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষাও এবং অবশেষে এসেছিল সাফল্যও। সেটা ১৯৩৬ সালের কথা। খোদ কলকাতা শহর থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সেই সংবাদপত্র দৈনিক আজাদ। সেই বছরেই অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহেই প্রখ্যাত সাংবাদিক আক্রাম খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সেই কাগজের প্রথম সংখ্যা। সম্পাদক আক্রাম খানের সেটাই অবশ্য প্রথম সংবাদপত্র নয়।। ১৯১০ সালে তাঁরই সম্পাদনায় ঠিকভাবেই চলছিল খাদেম নামক একটা দৈনিক সংবাদপত্র সহ একটা সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকাও । কিন্তু তারপরই ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়ে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় সেগুলো। সাংবাদিকতা ছাড়াও আক্রাম সাহেব ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতাও। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। আবার তাঁর নেতৃত্বেই খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল চর্তুদিকেই। মওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মহম্মদ আলি জিন্না প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অত্যন্ত কাছের মানুষই ছিলেন তিনি।
তাঁর সম্পাদিত কাগজের প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ তো তিনি হয়েই ছিলেন, হয়ে পড়েছিলেন অসহায়ও । তাই দীর্ঘদিন পর আবার সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়ে ভীষণভাবে উদ্দীপ্তও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই হোক অথবা নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, দৈনিক আজাদের দায়িত্বভার খুব বেশি দিন সামলানো সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। ১৯৪০ সালে তিনি ছেড়ে দেন সমস্ত দায়িত্ব। এবার সম্পাদক বদল হয় দৈনিক আজাদের। নতুনভাবে দায়িত্ব নেন শিশু সাহিত্যিক মোহাম্মদ মোদাব্বের। কাগজটিতে মুসলিম জাহানের সমস্ত খবরাখবর যেমন পরিবেশিত হত অত্যন্ত নিঁখুতভাবে, ঠিক তেমনই মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংবাদও সুন্দরভাবেই ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্তই ।দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের সময় পর্যন্ত দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয় দপ্তরটি কলকাতাতেই ছিল। কিন্তু ১৯৪৮সালের ১৯ শেষ অক্টোবর তা স্থানান্তরিত হয় ঢাকায়। সেইসময় কাগজের প্রকাশনা দপ্তরটিরই কেবল স্থান পরিবর্তন করেনি, কাগজের সাথে সাথে কলকাতা ছেড়ে একে একে বিদায় নেন কাগজের সঙ্গে যুক্ত সকলেই।ঢাকাতেও দৈনিক আজাদ এগিয়ে চলছিল তার নিজস্ব গতিতেই। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই বিশাল এক বিপর্যয় নেমে আসে সংবাদপত্র দপ্তরে।১৯৪৯ সালের শেষের দিকে কাগজের প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। সেইসময় সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশের দায়ে সরকার থেকেই চেষ্টা চালানো হয় তা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আইনগতভাবে সেটা না পারলেও পুরোপুরিভাবেই বন্ধ করে দেওয়া হয় সরকারি বিজ্ঞাপন। ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই প্রচণ্ড আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয় তাকে এবং ভীষণভাবেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে তার প্রকাশও । কিন্তু একেবারেই স্তব্ধ হয়ে যায় নি তার রথের চাকা। ফলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিরতভাবেই চলতে থাকে নির্ভীক সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের জেহাদও।বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়ও এই সংবাদপত্র নিয়েছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্বৈরাচারী শাসনের যাঁতাকলে পিষেও কিন্তু থামানো যায় নি তার গতিকে। তারপর তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল অনেক ঝড় কিন্তু ১৯৯০ সালে তার প্রকাশনা বন্ধ না হওয়া পর্যন্তই নিজ সিদ্ধান্তেই স্থির ছিল সমস্ত আদর্শই ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct