নিয়ামত
শেখ মফেজুল
আকবর আলি ডানদিকে সালাম ফিরিয়ে বাম দিকে ফেরাবেন, এমন সময় একজন মুসল্লী হঠাৎ দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। আসসালামু আলাইকুম। নামাজ শেষে হঠাৎ কেউ এই ভাবে উঠে দাঁড়ালে সবাই অবাকই হয়।সবাই তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। কি না জানি ঘোষণা করবে। ভাবার সাথে সাথেই তিনি বললেন- আজকে মাসুদ করিমের ছেলে হাসান, কোরআন শরীফ ধরবে। তাই সে সকলকে মিষ্টি মুখ করাবে, আপনারা সবাই মিষ্টি নিয়ে যাবেন। সকলের দাওয়াত থাকলো। আকবর আলির সালাম ফিরানো তখন হয়ে গেছে। সবাই কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। নামাজের পরই কিছু দোয়া জিকির করতে হয়। একটু পরে ইমাম সাহেব সকলকে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করার জন্য হাত তুলতে বললেন। ইমাম সাহেব শুরু করলেন- রব্বানা জালামনা আনফুসিনা....... সচারচার এমন দোয়া ইমাম সাহেবের কাছ থেকে আকবর আলি খুব কমই শুনেছেন। সালাম শেষে তাঁর কৌতুহল থাকলেও দোয়া পাঠ শেষ না হলেও সেও মোনাজাতে সামিল হল। যুব তরতাজা হাসান সদ্য ভরা সংসার জীবনে প্রবেশ করেছে। তথাকথিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডি না পেরাতে পারলেও হাক ডাকে তার মধ্যে সংস্কৃতিবান রুচিশীল সম্ভম মর্যাদার গুণাবলী ফুটে উঠে। হাসানের এই পরিবর্তন নিয়ে তার আব্বা- মা আর স্ত্রীর খুব আনন্দ পায়। হাসানের কোরআন পাঠের ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর নিজের কোটিপতি চাচার কোন আগ্রহ নেই। সে অবশ্য না থাকারই কথা। চাচা তাঁর তিন ছেলে মেয়েকে মাদ্রাসা স্কুল বা কলেজে পড়ানোর ব্যাপার নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই ছিল না। লেখাপড়ার বিষয়ে ছেলে মেয়ে গুলো ভবিষৎ নিয়ে তাঁর কোন চিন্তাভাবনা ছিলনা। শুধু তাই নয়, হাসান তার নিজের ভাইপো। তাসত্ত্বে ছেলেটির জ্ঞানগামু নিয়ে কোন উচ্ছাসও ছিল না। এদিকে নিজে মেয়েরা ধর্মকর্ম নিয়ে কোন ধার ধারেনা। মানুষ হিসাবে একই বারেই খলখলে। তার ছেলে দুটোও নিশা ভাঙ নিয়ে থাকে। সাধারন ভদ্রতাও শেখেনি। এর ফলে ছ্কেরা দুটোর বাপকে নানান অভিযোগও শুনতে হয়। ওসব নিয়ে লোক বাপটার কোন মাথা ব্যাথা নাই। কিন্তু আশ্চার্য কথা কি জানেন ? রমযান মাস এলেই বাপ ছেলে মিলেই ইফতারের হুললোড় পড়ে যায়। এ নিয়ে পাড়ায় সমালোচনা হলেও কোন তোয়াক্কা নেই। আকবর আলি মাগরিবের নামাজ জামাতে এক রাকাত না পাওয়াই তার নামাজ শেষ করতে দেরি হয়। নতুন ইমাম এসেছেন, ইমাম সাহেবের সাথে হাসানের খুব মিষ্টি সম্পর্ক। এই সেদিনের হাসান আর আজকের হাসানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মুখে সুন্নতি দাড়ি, পাঞ্জাবিতে নামাজের আদব রক্ষা করে। ছেলে পাড়া গ্রামে তার নাম যশও আছে। কেউ কোনদিন ওর কোন অভিযোগ তোলেনি। বাপ মা তাই নিশ্চিতেই থাকে। তারা বিলাসি ও নানান উটকো ঝামেলায় জুড়িয়ে আছেন।
নামাজ শেষ করে আকবর বেরিয়ে আসছে। এমন সময় পাশ থেকে একজন ইশারায় বললেন- আকবর ভাই, একটু অপেক্ষা করুন, কিছু কথা আছে। বাম দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারই প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার। জাব্বার হাসান তিনজনের সম্পর্ক বেশ ভাল। তাই জাব্বারের কথাই থমকে দাঁড়ালেন। বললেন- ভাই কিছু বলবেন নাকি ? তেমন কিছু না, এমন কিছু, ওই হাসানের বিষয়ে কয়েকটা কথা আলোচনা হবে রাতে।দেখো হাসান, আল্লাহর নিয়ামত স্বরূপ আমাদের কাছে আল কোরআন এসেছে। তাকে ভালো করে আকড়ে ধরতে হবে। আল কোরআন জানা, বুঝা ও সেইমত জীবন কাটানো দরকার। মোড়ল হয়ি কি লাভ ! তুমার চাচা এই মসজিদের মোড়ল হয়িছে। ব্যাটাদেরকে মসজিদ মুখি করতে পেরিছে ? আল্লাহ আমাদের যত নিয়ামত দিয়িছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়ামত হল সন্তান। এই সন্তানকেই যদি আমরা মানুষের মুত মানুষ করতে না পারি, তাহেলে আমরা বাপ কিসের ?নামাজ শেষ হয়ে গেছে। এক, দুই করে অনেকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছে। ইমাম সাহেবও বেরিয়ে বেরিয়ে এলেন। ইমাম সাহেব তাঁর ঘরের ভিতর ঢোকার জন্য দরজায় হাত দিয়েই বাম দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন। নিশ্চুপ কয়েক সেকেন্ড। দু পা এগিয়ে গেলেন। হাসানদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন- ভাই আপনারা আমার মুসল্লী। আপনারা অনেক বিষয়ই আলোচনা করবেন, তা জানি। সকলকেই নামাজি হতে হবে। সেদিন জানাজার নামাজের সময় হলো। জানাজাতে হাজার খানেক মানুষ অংশও নিলেন। কিন্তু আমি কতবার মাইকে অনুরোধ করলাম, যারা জানাজায় শরিক হতে হাজির হয়েছেন। নামাজের পর জানাজা হবে যারা জানাজায় শামিল হতে দূর থেকে ছুটে এসেছেন, একটা মানুষের জীবনের শেষ নামাজের শরিক হবেন, দয়া করে আসুন, আমরা জোহর নামাজটা আদায় করি। দেখা গেল প্রতিদিন যেমন লোক হয়, সেদিন জামাতে অন্যদিনের থেকে একটু বেশি হল। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, এতবার ঘোষণা দেয়ার পরও জোহরের নামাজ শামিল হল না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যদি আমরা না পড়ি, আমরা বড় গুনাগার হয়ে যাব। জামাতে সামিল হচ্ছে ২০০ বা ২৫০ লোক, সেখানে জানাজার নামাজের শরিক হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক। তারা জানাজার নামাজের তাগিদ অনুভব করছেন কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে জোহর নামাজের তাগিদ অনুভব করছেন না। এ বড় বেদনার। হাসান গলা নামিয়ে ইমাম সাহেবকে বললেন- হুজুর কার কথা বলবো, আমি নিজেই তো এমন ছিলাম। কেউ মারা গেলে জানাজাতে শরিক হতাম। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আসতাম না। এখন কিন্তু সেই আমার অনেক পরিবর্তন করেছি। আল্লাহ হেদায়েত না করলে তো কেউ নামাজি হতে পারে না। নিশ্চয়ই আমাদের সকলকে আল্লাহ হেফাজত করবেন। হেদায়েত দান করবেন। তালে আমরা নামাজি হতে পারব। এসব কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ এক মনে আলী আকবর শুনছিল। আকবর আলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এক বার হাসানের মুখের দিকে, একবার ইমাম সাহেবের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। ইমাম সাহেবের সাথে আকবর আলির তেমন সম্পর্ক এখনো গড়ে ওঠেনি। নতুন ইমাম মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়েছি এই যা। ইমাম সাহেব আকবর আলিকে দেখে বললেন- ভাইজান ইসলামি চেতনা সবার মধ্যেই কম বেশি আছে। আমি আপনার এক বিষয় খেয়াল করি। ভালো লাগে। তবে আপনি যে কথাই বারবার বলেন তা হল- কোরআন ও হাদিস আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ। তাকে অনুধাবন করা দরকার। বাংলায় বুঝা দরকার। হাসানের কোরআন ধরার কথায় বলেছেন। আসলে শিক্ষিত হতে গেলে যা দরকার তা হচ্ছে বোঝা এবং জানা। আমরা কুরআন সত্যি মুখস্তই পড়ি। তার ব্যাকরণগত শব্দ, অর্থ বুঝতে চাই না, বুঝিও না। অবুঝের মত এভাবে পড়াশোনা করি। আপনার এই আন্দোলনকে আমি সমর্থন জানাই। আল্লাহ আপনাকে হায়াত নসিব করুক। আপনি আরো এগিয়ে চলুন। এই মসজিদের মুসল্লি, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আসে, তারা বুঝবান হোক। আল্লাহ হেদায়েত নসিব করুক। কোরআন ও হাদিসের আলোকে চলার তৌফিক দান করুক। ইমাম সাহেবের এমন কথা শুনে আকবর আলি একটু উদ্বিগ্ন, কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিলেন। যে প্রতিদিনের মিলাদ মাহফিলে মসজিদে খুতবার সময় ইমাম সাহেব যা বলেন, তাই ই বললেন। তাঁর তাগিদ কোথায়, অনুভব হল না। ছোট্ট বাচ্চাদেরকে মসজিদ মুখি করতে হবে। আরবি ভাষাটাকে শিখাতে পারি, আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি এই আল্লাহর দেয়া নেয়ামত আমরা গ্রহণ করছি। কিন্তু তাকে কাজে লাগাচ্ছি না। মনে মনে বিড়বিড় করছিলেন আকবর আলি। ইমাম সাহেবও হয়তো কিছু ভাবছিলেন। হাসান বললেন- ভাই দেখেন, আপনি অনেক কিছু বুঝেন, জানেন ৷ অত লেখাপড়া করিনি, জানিনিও। এই মৌলভী সাহেবের সঙ্গে উঠবস করে এটু আধটু আরবি শিখছি মাত্র। কিন্তু সত্যি কথা বলতে এর অর্থ কোনটা কি? আমি সেটা বুঝিনি। উচ্চারণ করতে ভুল করছি, আপনার মত করে শিখব কিভাবে ? আকবর আলি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন- কোরআন ও সন্তান নিয়ামত স্বরূপ। তাকে যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষন করতে হবে। এটা মহামূল্যবান সম্পদ। সম্পদ যত সঠিক ভাবে লালিত পালিত হবে, ভবিষৎ সমাজ ও দেশ গঠন তত উন্নত হবে। ঘন অন্ধকারের তাকিয়ে জাব্বার বললো- ইমাম সাহেব কিন্তু আমরা তা পাচ্ছি কই ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct