ছোটবেলায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের জীবনী ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়েছি আমরা সবাই। সেখানে উল্লেখ করা একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ছিল ‘আল কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’। মনে পড়েছে? এই বইয়ের নাম থেকেই গণিতের একটি অবিচ্ছেদ্য এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বীজগণিত এর নামকরণ। হ্যাঁ, ‘আল জাবর’-কে ইউরোপীয়ানরা করেছে অ্যালজেবরা, যার অর্থ বীজগণিত। বইটির লেখক কে জানেন তো? ইসলামের স্বর্ণযুগের শুরুর দিকের মহান বিজ্ঞানী মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারিজমি। লিখেছেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম...
ছোটবেলায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের জীবনী ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়েছি আমরা সবাই। সেখানে উল্লেখ করা একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ছিল ‘আল কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’। মনে পড়েছে? এই বইয়ের নাম থেকেই গণিতের একটি অবিচ্ছেদ্য এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বীজগণিত এর নামকরণ। হ্যাঁ, ‘আল জাবর’-কে ইউরোপীয়ানরা করেছে অ্যালজেবরা, যার অর্থ বীজগণিত। বইটির লেখক কে জানেন তো? ইসলামের স্বর্ণযুগের শুরুর দিকের মহান বিজ্ঞানী মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারিজমি। অধিকাংশের নিকট আল খারিজমি একজন গণিতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই পরিচয়টি বলতে গেলে তার অগাধ জ্ঞানের সাথে অবিচারই। কারণ তিনি গণিতে তো অবদান রেখেছনই, পাশাপাশি জোতির্বিদ্যা, ভূগোল, মানচিত্রাঙ্কণ বিদ্যা এবং ত্রিকোণমিতিতে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ইসলামের স্বর্ণযুগের শুরুর দিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের সমৃদ্ধ করতে তার অবদান অসামান্য। অসাধারণ মেধাবী এই বিজ্ঞানীর নামের স্প্যানিশ অনুবাদ ‘অ্যালগরিতমি’ থেকেই ইংরেজিতে ‘অ্যালগোরিদম’ শব্দের প্রচলন। আবার তার নামের খারিজমি (খোয়ারিজমি) অংশটি থেকেই স্প্যানিশ ‘গুয়ারিজমো’ শব্দটির প্রচলন যার অর্থ ‘ডিজিট’ বা সংখ্যা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আল খারিজমির জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য আমাদের কাছে নেই। জন্মগতভাবে পারস্যের অধিবাসী এই বিজ্ঞানীর জন্মস্থান খোরাসান বা খোরাজম বলে উল্লেখ করেছেন মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে আল নাদিম। খোরাসান বর্তমানে উজবেকিস্তানের জোরাজম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামাতা ও শিক্ষাজীবন সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তার জন্মের সময় খলিফা হারুন আল রশিদ ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিকে বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দেন এবং এর নাম দেন ‘বায়ত আল হিকমা’ বা ‘হাউজ অব উইজডম’। এখানে সদস্যপদ লাভ করতেন কেবল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান মুসলিম পণ্ডিতগণ। মুসা আল খারিজমি তাদের মধ্যে একজন। তিনি খলিফা হারুন আল রশিদের ছেলে আল মামুনের শাসনামলে ‘হাউজ অব উইজডম’-এর সদস্য হন। আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে মুসা আল খারিজমি মৃত্যুবরণ করেন। তার ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য যেহেতু অপ্রতুল, সেহেতু তার গাণিতিক ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক অবদান নিয়েই আলোচনা করা শ্রেয়।
বীজগণিত
বীজগণিতের কথা বলতে গেলে সবার আগে যে নামটি স্মরণ করা হয় তা হচ্ছে মুসা আল খারিজমি। বীজগণিতে তার সবচেয়ে বড় অবদান ‘দ্য কম্পেন্ডিয়াস বুক অন ক্যালকুলেশন বাই কমপ্লেশন অ্যান্ড ব্যালেন্সিং’ বা ‘আল কিতাব আল মুখতার আল হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ বইটি। খলিফা আল মামুনের অনুপ্রেরণায় রচনা করেন খারিজমি। ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এই বইটি প্রকাশিত হয় যার নাম থেকে উৎপত্তি হয় আলজেবরা শব্দটির। এর মূল কপি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। বইটিতে বীজগণিতের বিভিন্ন দিক নিয়ে মৌলিক আলোচনা করেন খারিজমি।আল খারিজমি তার বইটিতে বহুপদী সমাধানের নিয়ম একেবারে মৌলিকভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং দ্বিঘাত পর্যন্ত সমাধানের নিয়ম আলোচনা করেন। তার এই সমাধানগুলো বর্তমান সময়ের তুলনায় একটু কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। এর কারণ হচ্ছে তার সময়ে বর্তমানে গণিতে ব্যবহৃত অনেক প্রতীকই আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে প্রচলিত প্রতীক ও সূত্রের ব্যবহারে তিনি সমাধানে পৌঁছান যা কিছুটা দীর্ঘায়িত। তথাপি, তার এই বই ছিল গণিতের আধুনিকায়নের দিকে অগ্রযাত্রার এক বড় নিয়ামক।
পাটিগণিত
পাটিগণিতে মুসা আল খারিজমির অবদানের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবে যে ল্যাটিন পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া যায় তাতে খারিজমির পাটিগণিত বিষয়ক অধিকাংশ কাজই আছে বলে দাবি করেন পণ্ডিতগণ। খুব সম্ভবত ১১৩০ সালের পর দার্শনিক অ্যাডিলার্ড অব বাথ খারিজমির মূল কাজের ল্যাটিন অনুবাদ করেছিলেন। মূল আরবি কপিটি হারিয়ে গেছে। অনুবাদটি ‘অ্যালগরিতমি ডি ইন্দোরাম’ নামে পরিচিত যার প্রকৃত নাম খুব সম্ভবত ‘কিতাব আল জাম ওয়াত তাফ্ক বি হিসাব আল হিন্দ’। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে নামটি এরূপ হয়, ‘দ্য বুক অব অ্যাডিশন অ্যান্ড সাবট্রাকশন অ্যাকরডিং টু দ্য হিন্দু ক্যালকুলেশন’। অধিকাংশ ইতিহাসবিদই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে আরবি ভাষায় ‘হিন্দু-আরবি সংখ্যা পদ্ধতি’র উপর ভিত্তি করে আল খারিজমিই ‘অ্যারাবিক নিউমেরালস’ বা আরবি সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন করেন।
জোতির্বিজ্ঞান ও ত্রিকোণমিতি
পাটিগণিতের মতো খারিজমির বীজগণিত বিষয়ক কাজেরও মূল কপি পাওয়া যায় না। ১১২৬ সালে ‘জিজ আল সিন্দহিন্দ’ বা ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবিলস অব সিন্দ অ্যান্ড হিন্দ’-এর স্প্যানিশ অনুবাদও করেন সেই দার্শনিক ভদ্রলোক, অ্যাডিলার্ড অব বাথ। এই অনুবাদের চারটি কপির দুটি ফ্রান্সে, একটি মাদ্রিদে এবং একটি অক্সফোর্ডে সংরক্ষিত আছে। জিজ আল সিন্দহিন্দে মোট ৩৭টি অধ্যায় এবং ১১৬টি ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবিল’ বা জোতির্বাজ্ঞান সম্বন্ধীয় ছক রয়েছে। এসব সারণীতে জোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও বর্ষপঞ্জিকা সম্বন্ধীয় তথ্যও রয়েছে। মূলত তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক সারণী তৈরি করার পদ্ধতিকে বলা হতো ‘সিন্দহিন্দ’। এই সিন্দহিন্দের উপর ভিত্তি করেই মুসলিম বিজ্ঞানীরা তাদের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সারণী তৈরি করেছিলেন। তবে মুসলিমগণের মধ্যে আল খারিজমিই প্রথম যিনি এসব ছক বা ‘জিজ’ তৈরি করেছিলেন। খারিজমি তার ছকগুলোতে চন্দ্র-সূর্যের গতি ছাড়াও তখনকার সময়ে আবিষ্কৃত পাঁচটি গ্রহের গতি নিয়েও আলোচনা করেন। মধ্যযুগে মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে প্রাথমিকভাবে মুসলিম জোতির্বিজ্ঞানীরা অনুবাদের উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে আল খারিজমি তাদের মধ্যে নিজস্ব মৌলিক চিন্তাভাবনার খোরাক সৃষ্টি করেন তার জিজ আল হিন্দের মাধ্যমে। তার জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কাজগুলোই পরবর্তীতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কাজের পথিকৃৎ হয়ে থাকে। ত্রিকোণমিতি নিয়ে খারিজমির কাজ খুব কম হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ত্রিকোণমিতিক ফাংশন সাইন এবং কোসাইন-এর অনুপাত নির্ণয় করেন এবং তার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবিলে সেগুলো সংযুক্ত করেন। গোলকীয় ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে একটি বইও লেখেন খারিজমি।
ভূগোল
‘কিতাব আল সুরত আল আর্দ’ বা পৃথিবীর বর্ণনা বইটি ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে লেখেন মুসা আল খারিজমি। ‘জিওগ্রাফী’ নামে পরিচিত এই বইটি টলেমির ‘জিওগ্রাফী’র উপর ভিত্তি করে রচিত। বইটিতে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের ভিত্তিতে আবহাওয়া অঞ্চল ভাগ করা হয়েছে। টলেমির কাজের উপর ভিত্তি করে রচনা করলেও খারিজমি টলেমীর ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগর সম্বন্ধীয় টলেমির ভুলগুলো সংশোধন করেন। সুরত আল আর্দের একটি কপি বর্তমানে ফ্রান্সের স্ট্র্যাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
ইহুদি বর্ষপঞ্জিকা
‘রিজালা ফি ইস্তিখরাজ তাঙ্খ আল ইয়াহুদ’ বা ‘এক্সট্রাকশন অব দ্য জুয়িশ ইরা’ নামক একটি পুস্তিকা রচনা করেন আল খারিজমি। এই পুস্তিকায় তিনি বছরের প্রথম দিন বা ‘তিশ্রি’ নির্ণয়ের উপায় বর্ণনা করেন। এছাড়াও তিনি ‘অ্যানো মুন্ডি’ বা ইহুদি বর্ষ এবং ‘অ্যানো গ্রেকোরাম’ বা গ্রীক বর্ষের মধ্যকার বিরামকাল নির্ণয় করেন। তবে তার একটি বড় কাজ হচ্ছে হিব্রু পঞ্জিকা ব্যবহার করে সূর্য ও চাঁদের দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করা যা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে।
আরো কিছু কাজ
আল খারিজমির যে সকল কাজের পাণ্ডুলিপি আজ অবধি সংরক্ষিত আছে সেগুলো বাদেও তার আরো বেশ কিছু কাজ রয়েছে বলে ধারণা করেন ঐতিহাসিকগণ। তার মধ্যে ‘কিতাব আল তারিখ’ বা ‘বর্ষপঞ্জির বই’ অন্যতম। দার্শনিক ইবনে আল নাদিমের ‘কিতাব আল ফিরিস্ত’-এর মধ্যে মুসা আল খারিজমির একটি বইয়ের তালিকা দেয়া আছে যাতে ‘কিতাব আল তারিখ’ এর কথা উল্লেখ আছে। অতএব এই পুস্তিকাটি যে খারিজমি লিখেছিলেন সে সম্পর্কে অধিকাংশ ইতিহাসবিদগণই একমত প্রকাশ করেন। তাছাড়াও আরো কিছু বইয়ের কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ লিখে গেছেন যেগুলো আল খারিজমির কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে।ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয় যে সময়কে, অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ের প্রথম দিকেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আল খারিজমি। মুসলিম মনীষীরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার দিকে ধাবিত হন, তখন খারিজমিই একপ্রকার পথ দেখিয়েছেন তাদের। খারিজমিকে তাই স্বর্ণযুগের একজন কারিগর বললেও বেশি বলা হবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct