জাইদুল হক, আপনজন: ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের মধ্যে যেসব নজরকাড়া কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের বর্তামন সাংসদ তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বভাবতই বিরোধী দলগুলির নিশানা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্র থেকে দু দুবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে ২০০৯ সালে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়া তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তুখোড় রাজনীতিবিদ সোমেন মিত্র জয়ী হয়েছিলেন। তিনি ৫৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। আর তার নিকটতম সিপিএম প্রার্থী শমিক লাহিড়ি পেয়েছিলেন ৩৯.২ শতাংশ ভোট। সেসময় বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাস মাত্র ৩.৬ শতাংশ ভোট পাওয়ায় জামানত জব্দ হয়েছিল। তার পর থেকে অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে এই ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রটি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাসতালুক হয়ে উঠেছে।
তবে, ডায়মন্ডহারবার লোকসভা আসনে ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রতিদ্বিন্দ্বিতা করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সোমেন মিত্রের তুলানায় কম ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছিলেন মাত্র ৪০.৭ শতাংশ ভোট। সে সময় তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মগরাহাট পশ্চিমের প্রাক্তন বিধায়ক ডা. আবুল হাসনাত পেয়েছিলেন ৩৪.৯ শতাংশ ভোট। সেসময় মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশ সিপিএম প্রার্থী পেয়েছিলেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। আর কংগ্রেস প্রার্থী কামারুজ্জামান কামার পেয়েছিলেন মাত্র ৫ শতাংশ ভোট। তবে, বিজেপি ২০০৯ সালের তুলনায় ভোট বাড়িয়ে করে ১৬.১ শতাংশ। এর পর থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ জোর দেন ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের প্রতি। একই সঙ্গে মুসলিম ভোটারদের বৃহৎ অংশ তৃণমূল তথা অভিষেকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার প্রতিফলন দেখা যায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে।
ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে আওতায় রয়েছে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র। সেগুলি হল, ডায়মন্ডহারবার, ফলতা, সাতগাছিয়া, বিষ্ণুপুর (তপ.), মহেশতলা, বজবজ ও মেটিয়াবুরুজ। এর মধ্যে বিষ্ণুপুর ছাড়া সব কটি সাধারণ আসন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম ভোটার মেটিয়াবুরুজ কেন্দ্রে। মেটিয়াবুরুজে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ও ভোটার লিস্ট বিশ্লেষণ অনুযায়ী মুসলিমদের হার ৬৯.২ শতাংশ। এর পরেই ডায়মন্ডহারবার বিধানসভা কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি মুসলিম। ডায়মন্ডহারবার বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিমের হার ৩৯.৫ শতাংশ। তারপর বজবজ কেন্দ্রে ৩৭.৩ শতাংশ, সাতগাছিয়ায় ৩৩.৬ শতাংশ, মহেশতলায় ৩১.১ শতাংশ, বিষ্ণুপুর (তপ) কেন্দ্রে ৩০.৭ শতাংশ ও ফলতা কেন্দ্রে ৩০.৩৭ শতাংশ মুসলিম। আর সামগ্রিকভাবে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিমদের হার ৩৮.৫ শতাংশ। ফলে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোট অনেকটাই ফ্যাক্টর। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তার ভোট অনেকটাই বাড়িয়ে নেন। ২০১৪ সালের ৪০.৭ শতাংশ ভোটকে বাড়িয়ে করে ফেলেন ৫৬.৮ শতাংশ ভোট। কিন্তু সিপিএমের ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামে। সিপিএমের জায়গাটা নিয়ে নেয় বিজেপি। বিজেপি প্রার্থী নীলাঞ্জন রায় পান প্রায় ৩৩.৮ শতাংশ ভোট। আর সিপিএম প্রার্থী ফুয়াদ হালিম পান মাত্র ৬.৭ শতাংশ।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিধানসভা ক্ষেত্রের নিরিখে দেখা যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট ব্যাঙ্ক হয়ে উঠেছেন মুসলিমরা। তাই সিপিএম মুসলিম প্রার্থী পুয়াদ হালিমকে দাঁড় করালেও তার কোনও ছাপ পড়েনি মুসলিম সমাজের মধ্যে। মুসলিম ভোট ঝুঁকে পড়ে সেই তৃণমূলেরই দিকে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়ে। সেক্ষেত্রে বিধানসভা নির্বাচনে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের সাত বিধানসভা কেন্দ্রে সম্মিলিতভাবে অভিষেক যে ভোট পান তা ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের তুলনায় প্রায় এক। সেক্ষেত্রেও অন্যান্য দলের মুসলিম প্রার্থীরা আদতে কোনও দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে। কিন্তু এবারের লোকসভা বোটের আগে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রটি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভাঙড়ে এককভাবে লড়াই করে জেতা আইএসএফ বিধায়ক ফুরফুরার পীরজাদা নওশাদ সিদ্দিকী অভিষেকের বিরুদ্ধে লোকসভায় প্রার্থী হওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়ায়। এর ফলে গুঞ্জন শোনা যায়, আইএসএফের সঙ্গে জোট হলে সিপিএম ডায়মন্ডহারবার লোকসভা আসনটি আইএসএফ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকীকে ছেড়ে দিতে পারে।
নওশাদ অবশ্য কিছুদিন থেকেই ডায়মন্ডহারবার লোকসভা আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। এমনকী তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি। নওশাদ দৃঢ়ভাবে আশা ব্যক্ত করেন, তিনি অভিষেককে হারাবেন। বিভিন্ন জনসভায় নওশাদ বলতে থাকেন, তিনি আইএসএফ নেতৃত্ব অনুমোদন দিলে ডায়মন্ডহারবারে দাঁড়াতে প্রস্তুত। আর তিনি প্রার্থী হলে অভিষেককে প্রাক্তন সাংসদ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। নওশাদের এই ঘোষণার পর তৃণমূল শিবিরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা যায় ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে নিজের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে। এমনকী তিনি তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন রাজ্যের অন্যান্য কেন্দ্রে তিনি প্রচারে তেমন হয়তো সময় দিতে পারবেন না। কারণ, তিনি তার নিজের কেন্দ্র ডায়মন্ডহারবারের ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকতে চান। নওশাদের ভোটে দাঁড়ানোর বিষয়টি সামনে আসায় অবশ্য অভিষেক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, তৃণমূলের সংখ্যালঘু নেতৃত্ব সরব হন নওশাদের বিরুদ্ধে। তারা আওয়াজ তুলতে থাকেন, নওশাদ ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়ালে মুসলিম ভোটে থাবা বসালে বিজেপিকে সহায়তা করা হবে। তাই নওশাদকে ভোট কাটুয়া বলেও কটাক্ষ করা হয়।
অপরদিকে, সিসিপএমের তরফে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, লোকসভা ভোটে বিধানসভা ভোটের মতো জোট হলে আইএসএফকে ডায়মন্ডহারবার আসনটি ছেড়ে েদওয়া হতে পারে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর জন্য।
এহেন পরিস্থিতিতে আইএসএফ আটটি লোকসভা কেন্দ্রে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছে। তাতে ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রটি স্থান পায়নি। যদিও আইএসএফ সূত্র জানিয়েছে, ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে প্রার্থী হিসেবে নওশাদকে দাঁড় করানোর অনুমোদন দেওয়া হবে না। অবশ্য, একই দিনে সিপিএম রাজ্যের েয ১৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তার মধ্যে স্থান পায়নি ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রটি। সিপিএমে সূত্রের খবর, নওশাদ ওই আসনে লড়তে চাইলে সিপিএম আসনটি ছেড়ে দিতে চায় অভিষেককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে। আইএসএফের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্র জানাচ্ছে, ডায়মন্ডহারবারের মতো কেন্দ্রে হেভিওয়েট তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে নওশাদ দাঁড়িয়ে জিততে না পারলেও ভাল ভোট না পেলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। তার প্রভাব পড়তে পারে ভাঙড়ে। সেক্ষেত্রে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে সবেধন নীলমণি ভাঙড় কেন্দ্রটিতে জেতা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। তবে, ঠিক কী কারণে নওশাদ সিদ্দিকীকে আইএসএফ ডায়মন্ডহারবারে দাঁড় করাতে চাইছে না তা নিয়ে দলীয় সূত্রে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। অবশ্য, এর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে আইএসএফ ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা যাচ্ছে।
‘আপনজন’ অবশ্য নওশাদের ডায়মন্ডহারবার আসন থেকে সরে আসার পিছনে কিছু কারণ অনুসন্ধান করেছে।
প্রথমত, নওশাদ সিদ্দিকীর ডায়মন্ডহারবার আসনে দাঁড়ানোর পিছনে কারণ হতে পারে মুসলিম ভোট। ডায়মন্ডহারবার লোকসভা এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম হল মেটিয়াবুরুজ বিধানসভা কেন্দ্রে। ৬৯.২ শতাংশ মুসলিম ভোট সম্বলিত মেটিয়াবুরুজ থেকে এর সিংহভাগ ভোট পেলে নওশাদ ভাল লড়ােই দিতে পারতেন। তবে শুধু মেটিয়াবুরুজ এলাকা নয় অন্য কেন্দ্রেও মুসলিমদের মধ্যে ভাল প্রভাব রয়েছে ফুরফুরার। সেকথা ভেবেই হয়তো আইএসএফ ভেবে ছিল তৃণমূলের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসানো সহজ হবে। কিন্তু নওশাদ সিদ্দিকীকে সেই পরীক্ষার মুখে ফেলতে রাজি নয় আইএসএফ। তাই ভাঙড়ের মুসলিমদের মতো তিনি এই এলাকার মুসলিমদের সমর্থন পাবেন কিনা তা নিয়ে হয়তো সন্দিহান আইএসএফ। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা এলাকার বিধানসভা কেন্দ্রগুলির ভোট বিশ্লেষণ করে দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে যে কটি আসনে আইএসএফ প্রার্থী দিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হল মেটিয়াবুরুজ। আইএসএফ আশা করেছিল ৬৯.২ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত মেটিয়াবুরুজ বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোটের জোরেই জেতা সম্ভব হবে। কিন্তু মেটিয়াবুরুজের মুসলিমদের মধ্যে নামমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি আইএসএফ। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে আইএসএফ মেটিয়াবুরুজ কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিল ওই এলাকার ভূমিপুত্র মেটিয়াবুরুজের পাঁচপাড়া রোডের বাসিন্দা নুরুজ্জামান মোল্লাকে। কিন্তু তার জামানত জব্দ হয়। নুরুজ্জামান ভোট পান মাত্র ৩.৭৫ শতাংশ। যদিও নুরুজ্জামান ও নওশাদকে একই পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু যেখানে সবচেয়ে বেশি মুসলিম সেখানে আইএসএফ কল্কে না পাওয়ায় বৃহত্তর ক্ষেত্র লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোট ব্যাপক হারে মিলবে কিনা এই অনিশ্চয়তাই হয়তো আইএসএফ নেতৃত্বকে হতাশ করে তুলেছে। তাই তারা নওশাদকে ডায়মন্ডহারবারে প্রার্থী করার ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নিতে হয়তো চাইছেন না।
আরও কয়েকটি বিষয়ও আইএসএফ নেতৃত্বকে হয়ত ভাবিয়ে তুলছে। তা হল, অভিষেককে হারানো খুব শক্ত বলে তাদের মনে হচ্ছে। তাই যথেষ্ট ভোট না পেলে নওশাদের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ণ হতে পারে। আর যদি যথেষ্ট ভোটও মেলে সেক্ষেত্রে তার ফায়দা নিতে পারে বিজেপি। গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাপ্তি ৫৬.৪%, আর বিজেপির ভোট প্রাপ্তি ৩২.৯%। ফারাক মাত্র ২৩.৫%। তাই নওশাদ ও অন্য ছোট দল মিলে তৃণমূলের ভোটে ২৪ শতাংশ থাবা বসালেই বিজেপি কেল্লা ফতে করতে পারে। তখন, তার দায় নওশাদের ঘাটে পড়তে পারে। সেই ঝুঁিক নিতে চাইছেন না আইএসএফ নেতৃত্ব। তবে, নওশাদ না দাঁড়ালে অভিষেকের জয়ের পথে আর কোনও কাঁটা যে থাকবে না তা বলা যেতেই পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct