মুঘল আমলে গ্রন্থাগার
উনিশ শতকের শুরু থেকেই এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মী সুলতান আর বাদশাহদের বর্বর এবং বিদেশি দস্যু হিসেবে বর্ণনা আর বিশ্বাস করার অপপ্রয়াস ব্যাপক লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। হাল আমলে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ আর গৈরিক বীভৎসতার উপাসকবর্গ ‘তুর্ক-আফগান’ এবং ‘তৈমুরিয় মুঘল’দের উজ্জ্বল ইতিহাস মুছে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। এমনতরো অসহনীয় রাজনৈতিক এবঅং সামাজিক প্রতিবেশে উপেক্ষিত জমানার গৌরবের আর সৌহার্দের বিষয়গুলো নয়া প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা জরুরী। প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদের এহেন সদর্থক আলোচনা ইতিহাসের যথার্থ সত্যতাকে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ভূমিকা:
হিন্দুস্তান-এ ইসলাম বিশ্বাসী শাসকবর্গের হুকুমত শুরু হয়েছিল ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে। ৬৫০ বছরেরও বেশি ছিল এই শাসনের মেয়াদ। এর মধ্যে ১৮১ বছর মতো ছিল মুঘল জমানা (১৫২৬-১৭০৭)। আধুনিক ঐতিহাসিকবর্গ বিশেষত মার্কসবাদীরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন যে মুঘল শাসনামল থেকেই ভারতে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছে। অধ্যাপক ইরফান হাবিব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার মারফত বহু মূল্যবান তথ্য সহকারে এটি প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন যে আকবরের শাসনকাল থেকেই হিন্দুস্তান-এ আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে। নয়া চিন্তা, ধারণা এবং একটি প্রখর শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বোধ এতদ্দেশে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। অতীত ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে আসে। যুক্তিবাদী আর বিচার বিবেচনায় আস্থা রাখেন এমন সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘আ রেক-থো টুক প্লেস উইথ ইন্ডিয়াজ পাষ্ট’। বস্তুত মুঘল জমানা বর্ণময় বহুবিধ শিল্প স্থাপত্য, সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক চেতনায় যশোগান করা যেতে পারে এমন মানদণ্ডকে ছুঁয়ে ফেলে। শিক্ষা, চিত্রকলা বা শিল্প এবং জ্ঞান চর্চার জন্য কিতাবখানা স্থাপন বৌদ্ধিক আন্দোলনের আকার নিয়েছিল। বাদশাহী আর অভিজাতবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা গ্রন্থাগার বা গ্রন্থশালী স্থাপনের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ববাহী করে তুলেছিল। উনিশ শতকী দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে গুপ্তযুগকে যাঁরা ‘প্রথম ক্লাসিকাল যুগ’ বলতে আগ্রহী তারা মুঘল আমলকে ‘দ্বিতীয় ক্লাসিকাল যুগ’-বলে অভিহিত করেন। নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তার তৎকালীন ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য বলে মন্তব্য করেছেন মুঘল জমানার শিক্ষার ইতিহাস সম্পর্কিত ঐতিহাসিক অধ্যাপক এন.এন.ল। তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘Promotion of learning in India during Mohamedan Rule’ মুঘলরা ‘টার্কো-ইরানিয়ান’ সংস্কৃতির (যাকে ‘তাহজীব’ এবং ‘তামুদ্দন’ বলা হয়ে থাকে যথার্থ অর্থে) ঐতিহ্য আর ‘লিগেসি’-কে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। সময়, নয়া সংমিশ্রণের প্রক্রিয়া তেরি করে এবং একটি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির বিকাশ আর উজ্জীবন ঘটে। এমনবিধ মানসিক উৎকর্ষতা বিকাশের নানাবিধ মাধ্যম রয়েছে-সেটি উপেক্ষণীয় নয় কিন্তু সাহিত্যচর্চা এবং সেইসব সাহিত্য নির্মাণের সংগ্রহ সন্দেহাতীতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ আর জরুরী বিষয়। বর্তমান আলোচনায় মুঘল জমানার গ্রন্থাগার বা কিতাবখানা সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে দেওয়া গেল। স্মত্য এটি গভীর কোন গবেষণা সন্দর্ভের অংশ নয়। তেমুরীয় বা মুঘল শাসকবর্গের ব্যক্তিজীবন বা কৃতিত্ব বিশ্লেষণে আর সমীক্ষায় মতানৈক্য থাকলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প ও স্থাপত্য বিষয়ক আলোচনায় সকলেই একমত পোষণ করেন যে মুঘল জমানা সদার্থক একটি মানদণ্ড স্থির করতে সমর্থ হয়েছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এন.এন. দে এবং ভি.ডি.মহাজন মন্তব্য করেছেন যে মুঘল বাদশাহগণ সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফলতঃ তৎকালীন বুদ্ধিজীবী (‘আহলে কলম’) শ্রেণি তাঁদের মেধা বিকাশের যথার্থ মওকা পেয়েছিলেন। উন্নতরুচি সংস্কৃতি চর্চা আর প্রগতির সঙ্গে শিক্ষা বিকাশ-এর সম্পর্ক ওতপ্রোত জড়িত। ইউরোপীয় পণ্ডিত ক্লাইভ বেল তাঁর ‘দ্য সিভিলাইজেশন’ নামক তামাম দুনিয়া খ্যাত গ্রন্থে এমন উপলব্ধি আর অনুভব ব্যক্ত করেছেন। মুঘল আমলে জীবনজিন্দেগির সূক্ষ্মানুভূতির বিষয়গুলোর নিপুণ অনুশীলনের কথা ভেবে ঐতিহাসিক বর্গের বৃহদংশই এই জমানার সঙ্গে কার্ডোভা আর বাগদাদ-এর (খলিফা শাসনে) সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রত্যেক মুঘল বাদশাহের দরবারে কবি, শিল্পী, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা, চিন্তাবিদ, ভাস্কর, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, ইসলামি ধর্মতত্ত্বাবিদ-এর সমাবেশ ছিল অপরিমেয়। বিস্ময় জাগাতে পারে এমন অগনন হস্তলিখন শিল্পীর উপস্থিতি লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। হরকিসিমের প্রভৃত ‘কিতাব’ রচিত হয়েছে। সেগুলো এই দক্ষ হস্ত লিখন শিল্পীরাই তো অতি যত্নে, ধৈর্য্যের সঙ্গে সংগ্রহযোগ্য করে তুলেছেন। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ এই শিল্পীদের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর ফলেই মুঘল আমলে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা পবিত্রতম কাজ বলেই বিবেচিত হোত। ‘ক্যালিগ্রাফি’ নামক একটি সরকারি বিভাগ তার উজ্জ্বল নিদর্শন।
গ্রন্থাগার:
এই গ্রন্থশালা স্থাপনের বিষয়টি শুধুমাত্র ‘গ্রেট মুঘলস’ (১৫২৬-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) দের আগ্রহের বিষয় নয়। পরবর্তী মুঘল শাসকবর্গও (১৭০৭-১৮৫৭) নানান ‘হুজ্জত-হাঙ্গামা’ আর আর্থিক দুর্বলতা সত্ত্বেও ‘কিতাবখানা’-র সযত্ন পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তার নজির অতি সহজেই উল্লেখ করা যেতে পারে। শেষতম মুঘলসম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর হাজারো তখলিফের মধ্যেও গ্রন্থাগার আর গ্রন্থপ্রেমের পরিচয় রেখেছেন। এই বাবদে কাহন না বললেই সন্দেহ উদ্রেকের কোন কারণ নেই। তাবৎ দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এমন লাইব্রেরিগুলোর অবস্থান ছিল মূলত দেহলি, আগ্রা, ফতেপুর, লাহোর, সেকেন্দ্রাবাদ, আজমির, নিজামাবাদ, আদিলাবাদ, জুনাগড় আর লাখনও ইত্যাকার নগরীগুলোতে। প্রত্যেক মুঘল শাসক গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন। বিষয়টি থেকে তাঁদের জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহের পরিচয়টি লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। পুরো সাম্রাজ্যবাপী যে অজস্র কিতাবমহল স্থাপিত হয়েছিল তার পৃষ্ঠপোষকতা বাদশাহি উদ্যোগেই পরিচালিত হোত। অনিন্দ্যসুন্দর তরতাজা হস্তাক্ষর সম্বলিত অসংখ্য পাণ্ডুলিপি গ্রন্থাগারগুলোর জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করে তুলেছিল। একজন আধুনিক সমালোচক মন্তব্য করেছেন যে এমন সুবিশাল জ্ঞানভাণ্ডার আধুনিক যুগের কোন সুবিধার ব্যবহার করার সুযোগ না পেয়েও শুধুমাত্র ক্যালিগ্রাফির মারফত সংরক্ষিত হয়েছে তা ভেবে শ্রদ্ধায় শির নত হয়ে যায়। তিনি এর মধ্যে লক্ষ্য করেছেন ‘হিউম্যান পেশন্স’, এবং ‘গ্রেট হার্ডশিপস’। তার ফলেই সংরক্ষিত হয়েছে পুরোনো এই মহার্ঘ সম্পদগুলো। মুঘল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষসিংহ জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর (১৫২৬-১৫৩০ খ্রিঃ) একজন বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও কবি। সুসংস্কৃত এক মহান ব্যক্তিত্ব। ফার্সি, তুর্কি আর আরবি ভাষায় তাঁর অতলান্তিক জ্ঞান বিস্ময়াবহ। তাঁর জীবনস্মৃতির জন্য ‘বাবুরনামাহ (ফার্সী)’ (তুজুক-ই-বাবরি) তুর্কী (বাবরের মাতৃভাষা) তিনি সমঝদার ব্যক্তি বর্গের বিচারে ‘প্রিন্স অব অটো-বায়োগ্রাফিস’। তিনিই হিন্দুস্তান’-এ মুঘল রাজকীয় গ্রন্থশালার প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। অবসর পেলেই তিনি ‘রয়াল লাইব্রেরি’-তে গিয়ে সময় অতিবাহিত করতেন। শুধু তাই নয় সেখানেই তিন শেরশায়রী-র চর্চা করতেন। ‘মসনভি’ চর্চা করতেন। গদ্য রচনাতে তাঁর কৌতূহলোদ্দীপক আগ্রহ ছিল। গ্রন্থাগারে সমবেত বিদ্বৎসমাজের সঙ্গে বহুবিধ আলোচনাতেও সক্রিয় ভূমিকা নিতেন। আদতে তিনি শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের একজন শাসক ছিলেন তাই নয় তিনি একজন বিদ্বান ও পূর্ণমানবও বটে। ইসলামের বিজয়কাহিনীর ইতিহাসে মুহম্মদ বাবর অপ্রতিরোধ্য একজন সৈনিক। হিন্দুস্তান-এ একটি সুসংহত সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য ‘ডেসটনি’ বা ‘কুদরৎ’ তাঁকে মাত্র চারটি বছর বরাদ্দ করেছিল। তিনি সফল হয়েছিলেন। শাসন কাঠামো তৈরী করে দিয়েছিলেন আবার জ্ঞানচর্চার জন্য গ্রন্থাগারও নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। বস্তুত মহানায়ক বাবর-এর গ্রন্থশালা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে রক্ষিত ছিল স্বদেশ ফরগনা থেকে আনীত গ্রন্থ। অন্যদিকে ছিল অধিকৃত দেশসমূহ থেকে সংগৃহীত গ্রন্থ। শেইখ সাদি-র ‘গুলিস্তা’, ‘বোস্তা’, মহাকবি ফিরদৌসির ‘শাহনামা’, নিজামির ‘খামসা’, আমির খসরুর ‘মসনভি’ এবং ইয়াজদির ‘জাফরনামা’ ইত্যকার গ্রন্থসমূহের পাণ্ডুলিপি তাঁদ্দর কিতাব-মহল-এর মর্যাদা আর আভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্পষ্ট করে বলা দরকার পুরুষসিংহ বাবর ছিলেন জ্ঞান ও জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ‘ডিসেন্ট’ বিষয়গুলোর সমঝদার ভক্ত। অর্থাৎ একজন ‘Connoisseur’ হিন্দুস্তান-এ তিনি সুমিষ্ট ফল, উমদা, তরমুজ আর মিষ্টি পানি পেতেন না বলে আত্মজীবনীতে বা আত্মস্মৃতিতে বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। ‘ওয়াতান’-এর জন্য আফশোসও করতেন। ২৬ ডিসেম্বর, ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে শহর আগ্রায় তাঁর মৃত্যু হয়।
বিশেষ সহানুভূতির সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক হুমায়ুন (১৫৩০-১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ)-কে ‘Fugitive Prince’ বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাঁরা একথা বলতে ভোলেন নি যে হুমায়ূন একজন মহাপণ্ডিত-মনীষী তুল্য ব্যক্তি (Studies Scholar) কিতাবপ্রেমী হুমায়ুন ইতিহাস, ভুগোল, জ্যোর্তিবিজ্ঞঙ্গন, আবহাওয়া ইত্যাকার বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য আন্তরিক আগ্রহ এবং কৌতূহলের পরিচয় রেখেছিলেন। হুমায়ুন বিশাল গ্রন্থশালা নির্মাণ করেন এবং বিস্তর গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। লালাবেগ-ওর্ফে বজবাহাদুরের কর্মদক্ষতায় ‘কিতাবখানা’র সমস্ত বিষয় ছিল সুরক্ষিত আর সুপরিচালিত। যুদ্ধাভিযান কালেও হুমায়ুন তাঁর প্রিয় গ্রন্থ সমূহের একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থাগার সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ‘তোওয়ারিখ-ই-তাইমুরিয়া’ গ্রন্থের সংগ্রাহক ছিলেন সম্রাট হুমায়ুন স্বয়ং। গ্রন্থখানি পরবর্তীতে সুপণ্ডিত বেহজাদ বিশ্লেষণ করেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্করণও করেছিলেন হুমায়ুনের নির্দেশে। ‘কানুন-ই-হুমায়ুনি’, ‘রিয়াজুল আদিইয়াহ’, ‘গোয়াহির-উল উলামা-ই-হুমায়ুনী’ নামক গ্রন্থগুলোর পান্ডুলিপি তাঁর লাইব্রেরিতে সযত্নে রক্ষিত ছিল। শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে পারস্যে উদ্বাস্তুর মতো ভ্রমণকালেও গ্রন্থাগারিককে সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন। গ্রন্থাগার বা গ্রন্থশালা ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক বেভারিজ আর কাউন্ট নোয়ের এবাবদে কিছু তথ্যের হদিশ তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। দেহলির (দিল্লি) ‘পুরানা কিলা’-য়, শেরশাহ’ শেরমণ্ডল’ নামে একটি প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেন, কিন্তু হুমায়ুন পুনরায় সিংহাসনরোহনের পর ইমারতটিকে গ্রন্থশালায় রূপান্তরিত করেন। জীবনের শেষ দিন তিনি গ্রন্থাগারের সিড়ি থেকে বিচ্যুত হন এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। বাদশাহ আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি:) শিল্প ও সাহিত্যের মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অধ্যাপক এন.এন.ল লিখছেন, ‘দ্য এমপেরর টুক মাচ ডিলাইট ইন দ্য কালেকশান অব বুকসহ ইন হিস্ট্রি’ আবুল ফজল (ড. ভিনসেন্ট স্মিথ-এর মতে মুঘল রাজসভার ফ্রান্সিস বেকন) ‘আইন-ই-আকবরি’-তে লিখেছেন যে বাদশাহ আকবরের লাইব্রেরি নানাভাগে বিভক্ত ছিল। গ্রন্থাদির বিষয় সম্পর্কে গ্রন্থাগারিক সম্রাটকে ওয়াকেফহাল করতেন। তাঁর পছন্দের বইগুলো তাঁকে পড়ে শোনানো হতো। বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থের জন্য আলাদা আলাদা তাক বরাদ্দ ছিল। ফার্সি, আরবি, হিন্দি, কাশমিরিয়ান, গ্রীক ইত্যাকার ভাষার গ্রন্থগুলি যত্নসহকারে রক্ষিত হয়েছে। দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পুনরায় যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে লিখিয়ে তিনি গ্রন্থাশালার কলেবর বৃদ্ধি করেন। হারেমের মধ্যেও মহিলাদের জন্য পুস্তক পাঠের বা লেখার জন্য সরঞ্জাম মওজুদ করে রাখা হতো। মুঘল রাজপ্রাসাদের সুকন্যাবর্গ সাহিত্য চর্চার সঙ্গে ব্যাপক জড়িয়ে ছিলেন। গ্রন্থাগারের জন্যও অনুদান তাঁরা দরাজ হস্তে বরাদ্দ করতেন। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গে এ বাবদে অন্যত্র বিশেষ আলোচনা করা গেছে। গুজরাট, জৌনপুর, বাংলা, বিহার, কাশমির এবং দাক্ষিণাত্য অভিযানকালে অসংখ্য গ্রন্থ আকবর সংগ্রহ করেন। এগুলো লক্ষ্য করে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. ভি. স্মিথ মন্তব্য করেছেন, খুব সম্ভবত এমন গ্রন্থ সংগ্রহ সমকালে ছিল না, এমনকি পরবর্তীতে দুনিয়ার কোথাও দক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠেনি। মন্তব্যটি তর্ক-প্রবোচক। আদতে ড. স্মিথ বিষয়টির প্রতি গভীর গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছেন। বাদশাহ আকবর মূল পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের প্রশ্নে বিশেষ সতর্ক আর সজাগ থাকতেন। সুদৃশ্য ক্যাটালগে গ্রন্থের নাম, গ্রন্থকার, ক্রমিক নং, সময়কাল উল্লেখ করে সযত্নে গ্রন্থাগারে রক্ষিত হতো। বইপত্তর তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমত ছিল কাব্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোর্তিবিদ্যা আর সংগীত সংক্রান্ত গ্রন্থাদি, দ্বিতীয়ভাগে ছিল ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, সুফিবাদ, গ্রন্থবিজ্ঞান এবং জ্যামিতি বিষয়ক গ্রন্থাবলী, তৃতীয় অর্থাৎ শেষ পর্যায়ে ছিল পবিত্র কুরআনের তফসির (Commentaries on the Holy Quran), হাদিস (The Sayings of the Prophet) আইন আর ধর্মতত্ত্বমূলক গ্রন্থসমূহ। ধর্মতত্ত্বমূলক গ্রন্থসংরক্ষণে সংকীর্ণ কোন দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিয়াশীল ছিল না। প্রত্যেকটি ধর্মের গুরুত্ববাহী গ্রন্থগুলো পরম মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষিত ছিল। ড. অধ্যাপক ইরফান হাবিব এই বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, মুঘল যুগের সঙ্গে আধুনিকতার বিষয়টির সম্পৃক্ততা নিয়ে। একটি সেক্যুলার অ্যাটিচ্যুড’-এর উপাদান তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। আগ্রা দূর্গের অষ্টভূজীয় মিনারের পাশে একখানি অতীব মূল্যবান ইমারতের মধ্যে রাজকীয় গ্রন্থাগারের অবস্থান ছিল। এই লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক ইনায়েতউল্লাহ সিরাজি ছিলেন একজন সুপণ্ডিত আর বিচক্ষণ ব্যক্তি। তৎকালীন বিদ্বৎসমাজে তাঁর মান্যতা ছিল অশেষ। আব্দুল কাদির বদায়ুনী গ্রন্থাগারের উন্নয়নের পরিকল্পকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ‘আখলাক-ই নাসিরি’, ‘কিমায়া ই-সাদাত’, ‘গুলিস্তা’, ‘বোস্তা’ ইত্যাকার গ্রন্থ সম্রাট আকবরকে পাঠ করে শোনানো হতো। এছাড়াও আমির খসরু, জামি আর খাকানি-র রচিত সাহিত্যে রাজিও ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ছিল। আকবরের গ্রন্থাগারে অজস্র অনুবাদগ্রন্থ গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং উভয়ের ভাবধারা আর চিন্তাচেতনা বিনিময়ের জন্য বাদশাহ আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্র রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, রাজতরঙ্গিনী, পঞ্চতন্ত্র ফার্সি ভাষায় অনুবাদিত হয়েছিল। এতদ্ বিষয়ক গ্রন্থাদি তৃতীয় ভাগে রক্ষিত হতো। ‘ওয়াকিয়াত-ই- বাবরি’, ‘তোওয়াবিখ-ই রাশিদি’, ‘মুয়াজাম-উল্-বুলদান’, ‘বাদশাহনামাহ’ এবং ‘হাযাত-উল-হাইওয়ান’-এমনবিধ গ্রন্থও ফার্সি ভাষায় অনুদিত হয়ে গ্রন্থাগারে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষিত হয়েছিল। আকবরের নির্দেশে পবিত্র বাইবেলের এক বিরাট অংশ ‘দাস্তান ই মসিহা’ নামে ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এবং গ্রন্থাগারে পবিত্র কুরআন-এর পাশে রক্ষিত হয়েছিল। ‘ইসলামি-কুতুব-খানে’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য ইতিহাসবিদরা সংগ্রহ করেছেন, তার থেকে জ্ঞাত হওয়া গেছে যে ১৫০০০ হাজার (পনের হাজার) পাণ্ডুলিপি আকবরের হুকুমে পুনরায় লিখিত হয়েছিল। সেগুলো ছিল সুদৃশ্য আর মনোরম। কি অসাধারণ ধৈর্য্যসহকারে লিপিকারবর্গ অসীম প্রশংসার যোগ্য এই কাজগুলো করেছিলেন। ‘দরবারনামাহ’, ‘চেঙ্গিজনামাহ’, ‘জাফরনামাহ’, ‘দাস্তান-ই-আমির হামজা’, ‘তোয়ারিখ-ই-খানদান-ই তাইমুরিয়াহ’ ইত্যকার গ্রন্থগুলো নবসাজে অলংকৃত হয় এবং গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত হয়েছিল। ‘রাজমনামাহ’-র পাণ্ডুলিপি আকবর অবিশ্বাস্য রকমের বিপুল মূল্যে ক্রয় করেছিলেন। এই মহামূল্যবান ‘কিতাব’ খানি বর্তমানে জয়পুরে রক্ষিত আছে। এমনবিধ বিস্ময়কর গ্রন্থ সংগ্রহের বিষয়টি নিরীক্ষণের
সুবাদেই ড. ভিনসেন্ট স্মিথ খুব সম্ভব ওপরের মন্তব্যটি করেছিলেন। মুঘল জমানার অন্যতম বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মুল্লাহ বদায়নির একটি বর্ণনা থেকে এই তথ্যটি পাওয়া গেছে যে মহাপণ্ডিত ফৌজিরব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ৪৬০০ খানি (চার হাজার ছ’শো) গ্রন্থ ছিল। এই সমস্ত গ্রন্থগুলো ছিল-সাহিত্য, দর্শন, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, ঔষধ বিজ্ঞান, অংক, রসায়নবিদ্যা, সংগীত, চিত্রকলা, শিল্প আর আইন সংক্রান্ত। হেকিমি চিকিৎসা পদ্ধতি সংক্রান্ত গ্রন্থ আর উদ্ভিদ সম্পর্কে পর্যবেক্ষনের কিতাবগুলো খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিদেশি পর্যটক মানরিক আর ডি. লায়েটের বিবরণ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে যে আকবরের মৃত্যুর সময়ে বাদশাহি গ্রন্থাগারে ২৪০০০ (চব্বিশ হাজার) গ্রন্থ ছিল। মজবুত বাঁধাই, উত্তম প্রচ্ছদ গ্রন্থগুলোর ‘পরমায়ু’ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই মহামূল্যবান গ্রন্থগুলোর দাম নির্ধারণ আজ আর সম্ভব নয়। বোধহয় বাস্তবোচিতও নয়। প্রকৃতি আর সৌন্দর্যপ্রেমিক জাহানগির (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ) একজন উন্নত রুচির মানুষ (Man of Refined Culture) স্বভাব কবি। অশেষ শিক্ষিত আর গ্রন্থকীটও বটে। ইসলামি, হিন্দু আর খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থাদি এবং ফার্সি কবিতা প্রখর মনোযোগসহকারে অধ্যয়ন করতেন। ‘তুজুক-ই-জাহানগিরি’ তাঁর মহত্তম সাহিত্যে নির্মাণ। গ্রন্থপ্রেম ছিল তাঁর জন্মগত। তিনিও এক সুবিশাল গ্রন্থশালা’র প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাস, ভূগোল আর জীবনীগ্রন্থের প্রতি তাঁর ‘অবসেশন’ প্রবাদ বাক্যের মতো। অত্যন্ত উচ্চমূল্যে বহু গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি ক্রয় করে তাঁর গ্রন্থাগারের বিপুল করে তোলেন। মার্টিন একটি তথ্য দিচ্ছেন এই ভাবে, জাহানগির একখানি মূল্যবান গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির জন্য ৩০০০ (তিন হাজার) স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করতে সামান্যতম দ্বিধা করেননি। মার্টিন তৎকালীন হিসেবে ১০, ০০০ (দশ হাজার) পাউণ্ডের হিসেব দিয়েছেন। ‘রনজাত-উল-আহবাব’, ‘তফসির-ই-হুসেনি’, ‘তফসির-কাশশাফ’, ‘ইকবালনামাহ-ই-জাহানগিরি’ এবং ‘জাবদাত-উল-তোয়ারিখ’ নামক গ্রন্থগুলো তাঁর সংগ্রহে ছিল। অভিজ্ঞাতশ্রেণি (দ্য মুঘল নোবিলিটি) এই কিতাবগুলো পড়ার সুযোগ পেতেন। মকতব গাঁ লাইব্রেবির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। বাদশাহ জাহানগির গুজরাট অভিযানকালে তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন। এই তথ্য অনুবাদ মারফত দিয়েছেন, রজার্স এবং বেভারিজ। ‘ইসলামি কুতুব খানে’ জাহানগিরের লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৬০,০০০ (ষাট হাজার)। সম্রাট জাহাঙ্গিরর এবং গ্রন্থশালায় ‘ইউসুফ-জুলেইখা’ গ্রন্থখানিও মওজুদ ছিল। মির আলি ‘Prince of Calligraphers’ নামে খ্যাতছিলেন। আলি ওপরোক্ত গ্রন্থখানির নয়া পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। সেই সময়ে পাণ্ডুলিপিটির মূল্য ছিল ১০০০ স্বর্ণমোহর। এই মহামূল্যবান পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে পাটনার ‘খুদাবখশ’ লাইব্রেরিতে মওজুদ রয়েছে। সুলতানজাদা কামরান রচিত ‘দিওয়ান’ খুদাবশ লাইব্রেরিতে রয়েছে। ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ নামক গ্রন্থখানিও পাটনার খুদাবখশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত। UGC (Arihant Page 286 শাহজাহানের রাজত্বকাল (১৬২৮ খ্রি:-১৬৫৮ খ্রি:) বর্ণময় আর জাঁকজমকের জন্য (Pomp & Splendour) খ্যাত। শীলচাঁদ ‘তাফরিহ-উল-ইমরাত’ নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, শাহজাহান সাহিত্য আর শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন। গ্রন্থ সংগ্রহ তাঁর প্রায় বাতিকের পর্যায়ে পড়েছিল। সুকুমার অনুভূতিগুলো চর্চার জন্য তিনি আগ্রহসহকারে অর্থ মঞ্জুর বা বরাদ্দ করতেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক যদুনাথ সরকার বলছেন, শাহজাহানি ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ (Travelogue) সুফি-সম্প্রদরবেশের জীবন বৃত্তান্ত আর মহানবী হযরত মোহাম্মদ (শান্তি) এর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানতে সবিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাঁর গ্রন্থাগারে এমনবিধ কিতাব-এর ব্যাপক সংগ্রহ ছিল। মুহাম্মদ আমিন কাজুয়নি, তবতবাই, আবদুশ হামিদ লাহোরি আর ওয়ারিশ লিখিত ‘পাদশাহনামাহ’-র পাণ্ডুলিপি মুঘল জমানার ইতিহাসবিষয়ক মহা সম্পদ। এঁরা প্রত্যেকেই পাদশাহনামাহ’ নামক গ্রন্থ নির্মাণ করেছিলেন। তৎকালীন মুঘল ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে ‘পাদশাহনামাহ’ এক বিশ্বস্ত দলিল। তামাম দুনিয়ার বিদ্বৎসমাজ ‘পাদশাহনামাহ’ নামক সিরিজের গ্রন্থগুলোকে ইতিহাসের যথার্থ উপাদান হিসেবে মান্যতা দিয়েছেন। ‘ফারহাঙ ই রশিদি’, ‘মুন্ডাখাব উল লুবাব’, ‘শাহিদ-ই সাদিক’, আর জিকর-ই-শাহজাহানি’ নামক তাৎপর্যপূর্ণ আর গুরুত্ববাহী কিতাবগুলো শাহজাহান-এর গ্রন্থাগারের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল। ‘শাহজাহান অশেষ জ্ঞানচর্চার স্পৃহা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন একখানি বিশ্বকোষ। গ্রন্থাগারের বিষয় সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা, পরিকল্পনা আর কিতাব সংগ্রহ, সংরক্ষণের জন্য তিনজন সুদক্ষ গ্রন্থাগারিক নিয়োগ করেছিলেন। আবদুর রহমান, মীর মুহাম্মদ সাহেল্ এবং ইনায়েত খাঁ দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাজকীয় মোহর আর শাহজাহান-এর স্বাক্ষর সম্বলিত কতকগুলো পাণ্ডুলিপি কোলকাতায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-তে সংরক্ষিত রয়েছে। ‘মজলিশ-ই-খামসা’ (সম্রাট শাহজাহান-এর স্বাক্ষরসহ) বেং ‘শাহেনশাহনামাহ’ নামক গ্রন্থদ্বয় পাটনার ‘খুদা বশ’ লাইব্রেরিতে সযত্নে রক্ষিত। আওরঙ্গজীব (ঔরঙ্গজেব, আওরঙ্গজেব) (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) সম্পর্কে হাজারো কিসসা ছড়িয়ে রেখেছে রক্ষণশীল জাতিয়তাবাদী ঐতিহাসিকবর্গ। কিন্তু তাঁর বিদ্যাবত্তার প্রশ্নে সংকোচহীন প্রশংসা করেছেন। তাঁদের সার্বিক মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘আওরঙ্গজেব ওয়াজ অ্যান এমিনেন্ট এডুকেশানিস্ট’। তিনি যে পণ্ডিতপ্রবর সে কথা স্বীকারে কোন দ্বিধা নেই। আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক একটি গ্রন্থ ‘মিরাত-উল-আলম’ থেকে সংগৃহীত কিছু তথ্যে দেখা যাচ্ছে তিনি ‘তফসির’, ‘ফিকাহ’, ‘হাদিস’ এবং সর্বোপরি পবিত্র কোরাণ-এর পাণ্ডুলিপি সর্বোত্তম যত্নে রক্ষা করতেন। আইন শাস্ত্রে তাঁর প্রখর এবং তীক্ষ্ণ ব্যুৎপত্তি ‘মিথ’ বা কিংবদন্তীর পর্যায়ে পড়ে। ‘ফতোয়া-ই-আলমগিরি’ (The Greatest digest of Muslim Law made in India), ‘রাক্কাৎ-ই-আলমগিরি’, ‘তুহফাৎ-উল-হিন্দ’, ‘নিজাম-উল-নগ্ন’, ‘তোয়ারিখ-উল্-দিলখুশ’, ‘ফুতুয়াৎ-ই-আলমগিরি’ এবং ‘খুলাসাৎ-উৎ-তোয়ারিখ’ নামক জগদবিখ্যাত গ্রন্থগুলো আওরঙ্গজেবের ‘কিতাবখানা’র ‘ট্রেজার’। উপরে উল্লিখিত শেষ চারখানি গ্রন্থের লেখক ছিলেন যথাক্রমে লালবিহারি, ভীমসিং, ঈশ্বরদাস এবং সুজন রায়। এই চারজনই ছিলেন ‘মুঘল নোবিলিটি’র সদস্য। তারা আওরঙ্গজীবের অনিঃশেষ প্রশংসা করেছেন। শেখ আবদুল ওয়ালি, কাবিল খাঁ এবং সৈয়দ আলি খাঁ আওরঙ্গজীবের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন। আল-কুরআন-এর। আরঙ্গজীবের স্বহস্তে লিখিত পাণ্ডুলিপি অতি যত্নে আর পরম মর্যাদা সহকারে বিশেষ প্রকোষ্ঠে রাখা হোত। উপরন্তু কিছু পাণ্ডুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহের যোগ্য ব্যক্তিদের কাছে অর্থের বিনিময়ে বিক্রিও করেছিলেন। সেগুলোর সন্ধান অজ্ঞাতই রয়ে গেলো।মুঘল রাজপ্রাসাদের মহিয়ষী মহিলাদের মধ্য থেকে উত্থিত কয়েকজন বিশিষ্ট নারী; যেমন গুলবদন বেগম, সলিমা সুলতানা, নুর-জাহান, মমতাজমহল, জাহান-আরা, রওশানআরা, সফিউনিসা, জেবিন্দা বেগম সর্বোপরি জেবউনিশা বেগম ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র, অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারের অধিকারিনী ছিলেন। সাহিত্যের নানা শাখাপ্রশাখায় তাঁদের প্রতিভার প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে রয়েছে আজও। এঁরা প্রত্যেকেই উন্নত সাহিত্যবোধের পরিচয় রেখেছেন। তাঁদের লিখিত সাহিত্যরাজি এখনও পঠিত হয়ে থাকে।
শেষ কথা:
মুঘল বাদশাহ আমির ওমরাহ আর বাদশাহজাদি নির্মিত, প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত গ্রন্থাগার সম্পর্কে ‘ইন্দো-ইরানিকা’র একদা সম্পাদকখাজা মুহাম্মদ ইউসুফ-এর বীক্ষণ আর উপলব্ধি হচ্ছে এই রকমের-“দেয়ার ক্রেজ ফর বুকস অ্যান্ড লাইব্রেরিজ বেয়ার টেসটিমনি টু দেয়ার রিফাইন্ড অ্যান্ড ম্যাগনিফিসেন্স অব টেস্ট। ”শুধুমাত্র গ্রন্থাগার আর জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়, সিয়াশত (রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে) সম্পর্কিত তামাম বিষয়ে মুঘল শাসকবর্গ তাঁদের উন্নত রুচি, প্রগতি আর উদার অসাম্প্রদায়িক ‘হুকুমত’-এর অনুসরণযোগ্য নজির রেখেছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct