এম মেহেদী সানি, খলতপুর, আপনজন: কয়েক দশক ধরে বিশেষত সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের মেধার উৎকর্ষের বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলেছে আল আমীন মিশন। সেই আল আমীন মিশনের মূল ক্যাম্পাস হাওড়ার খলতপুরে দুদিন ব্যাপী বার্ষিক “আল আমীন উৎসব’-এর সূচনা হল শনিবার। প্রতিবছর আল আমীন উৎসবের আয়োজন করে মিশন কর্তৃপক্ষ, কিন্তু এবছর কিছুটা ব্যতিক্রমী ভাবে আল-আমীন উৎসব আয়োজন করেন প্রাক্তনীরাই। বিশিষ্ট চিকিৎসক আল আমীন প্রাক্তনী শেখ হাম্মাদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে সংগঠিত প্রাক্তনীরা এ বছর আল আমীন উৎসবের আয়োজন করেন। এবছরের উৎসবে তেমন কোন বিশিষ্ট অতিথি না থাকলেও প্রাক্তনী এবং বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে মহা সাড়ম্বরে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। প্রাক্তনীদের তরফে এ দিন আল আমীনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম ও সুপারভাইজার মারুফ আজমকে সংবর্ধিত করা হয়। এছাড়াও ২০২৩ সালে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল সার্ভিস, মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল কৃতিদেরও সংবর্ধিত করা হয়।ওই সময় আল-আমীন মিশনের বর্তমান শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস ফেটে পড়ে। আল-আমীন উৎসবে শামিল হয়েছিলেন বহু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। সবমিলিয়ে উৎসবের মেজাজ ছিল খলতপুর আল-আমীন মিশনের বিশাল সুদৃশ্য ক্যাম্পাসে। শনিবার ছিল সেই উৎসবের সূচনার দিন। শেষ হবে রবিবার।তবে আল আমীনের এই সমাবর্তনে মিশন সম্পাদক নুরুল ইসলামকে নিয়ে প্রাক্তনীদের স্মৃতি রোমন্থনে এক হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া পরিবেশ তৈরি হয়।
আল আমীন উৎসবে প্রাক্তন ছাত্র দিলদার হোসেন অতীত স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এদিনের অনুষ্ঠানে বলতে থাকেন, ‘রাজ্যে শিক্ষা মানচিত্রে মহীরুহে পরিণত হওয়া আল আমীন মিশনের বর্তমান রূপ স্বর্ণোজ্জ্বল হলেও সৃষ্টির ইতিহাসটা বেশ লড়াই সংগ্রামের ১৯৯০ দশকের শুরুর কথা, স্যার আমাকে নিয়ে চললেন কলকাতায়, একটি সোনার দোকানে গিয়ে পকেট থেকে একটি কয়েন বের করে দিলেন বিক্রির জন্য। প্রথমে বুঝে উঠতে না পারলেও পরে স্পষ্ট হল সেটি ছিল সোনার কয়েন। বিক্রি বাটা সম্পন্ন হলে ফিরে আসলাম ক্যাম্পাসেই। এম নুরুল ইসলাম স্যারের কথা বলছি, যার হাতে খলতপুরে গড়ে উঠেছে আল আমিন মিশন, তখন মিশনের বয়স ৫-৬ বছর। শিক্ষকদের বেতন না দিতে পেরে মায়ের জমানো সোনার কয়েন গুলো একের পর এক বিক্রি করেছেন নুরুল ইসলাম স্যার আমরা তার সাক্ষী।’ প্রাক্তন ছাত্র দিলদার হোসেনের মুখ থেকে এমনই লড়াই সংগ্রামের স্মৃতিকথা শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না হার না মানা আল-আমীন মিশনের এই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম। স্যারের চোখে জল দেখে মুহূর্তেই প্রাক্তনী থেকে বর্তমান প্রায় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের চোখগুলো ছল ছল করে ওঠে। মিশন প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে চরম সংকটের মধ্যে পড়তে হয় এম নুরুল ইসলামকে যার সাক্ষী তৎকালীন ছাত্রছাত্রীরা। শনিবার প্রাক্তনী পুনর্মিলন উৎসবে এসে তাদের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সে সময়ের একাধিক ঘটনার কথা উঠে আসে। ১৯৯১ সালে মুর্শিদাবাদ জাকাত সংগ্রহের জন্য মুর্শিদাবাদ গিয়ে ডাকাত দলের মুখে পড়েও প্রাণে বেঁচে আসার ঘটনাও তুলে ধরেন প্রাক্তনীরা। ১৯৯০ দশকেই একটা সময় আর্থিক সমস্যার কারণে মিশনের ছাত্রদের জন্য ক্রয় করা চালের দাম দিতে পারছিলেন না এম নুরুল ইসলাম। প্রায় দিন পাওনাদার এসে ছোট বড় কথা শুনিয়ে যেতেন নুরুল ইসলামকে। একদিন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জমানো টাকা থেকে সবাই দু-এক টাকা করে দিয়ে পাওনাদারের টাকা শোধ করতে সহায়তা করেছিলেন আজকের প্রাক্তনীরা। মঞ্চে বসে প্রাক্তনীদের এই সমস্ত স্মৃতি কথা শুনতে শুনতে অবিরাম কেঁদেই যাচ্ছিলেন আল আমীন মিশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নুরুল সাহেব। এম নুরুল ইসলাম এ নিয়ে বলেন, আজ আমি অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। যাদের মধ্যে আবেগপ্রবণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, তারাই অতীতকে মনে রাখবে। আর অতীত, ইতিহাসকে যদি মনে না রাখতে পার, তাহলে ইতিহাস তৈরি করতে পারবে না। আল্লাহপাকের কাছে আমি এই দোয়া করব, যেন তোমরা আগামী দিন ইতিহাস রচনা করতে পারো। মঞ্চে ও সামনে যারা রয়েছ, একদিন তাদেরকে নিয়েও ইতিহাস রচিত হবে। এদিন সন্ধ্যায় এম নুরুল ইসলামের উপস্থিতিতে মিশন প্রাক্তনীরা ‘শান্তি নীড়’-এর প্রেক্ষাগৃহে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শামিল হন। যার অন্যতম বিষয় ছিল সাফল্যের কৌশল, সমাজকে উন্নত করার পদক্ষেপে আল-আমীন মিশনের প্রাক্তন ছাত্রদের ভূমিকা গ্রহণ।প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে নুরল ইসলাম ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মারুফ আজম, মাকসুদ গোরি, আবু সালহে, কাজী আব্দুল বসির, হাসান সাহেব, মহিনুদ্দিন সাহেব প্রমুখ। সেই সঙ্গে রাজ্য দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত আল আমীন প্রাক্তনীদের সমাহারে আল আমীন মিশনে বসেছিল চাঁদের হাট। বুঝিয়ে দিচ্ছিল যেন শিক্ষা ও শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রেমীদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ আল আমীন মিশন। আর সেখানকার ‘কর্নেল জেনারেল’ এম নুরুল ইসলাম তখন নিজ হাতে গড়া উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপী সফলদের দেখে আনন্দের হাসির পাশাপাশি চিক চিক করে উঠছিল চোখের কোন। এদিন আল-আমীন প্রাক্তনী বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের পাশাপাশি হবু ডাক্তারদের ভিড়ে মুখরিত ছিল খলতপুর আল-আমীন মিশন প্রাঙ্গণ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct