ভারতের দিল্লির উত্তর-পূর্ব অংশে ২০২০ সালে দাঙ্গা হয়েছিল। চার বছর আগে ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ওই দাঙ্গায় মৃত্যু হয়েছিল ৫৩ জনের। চারদিন ধরে চলা দাঙ্গায় জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেকের বাড়িঘর ও দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লি পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিহতদের ৪০ জন মুসলিম এবং ১৩ জন হিন্দু। এই দাঙ্গার শিকার এবং তাদের পরিবারের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই কিন্তু আজও চলছে। লিখেছেন উমঙ্গ পোদ্দার (বিবিসি বাংলা)।
উমর খালিদ এবং এফআইআর নং ৫৯ দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল অ্যান্ড ক্রাইম ব্রাঞ্চ বলছে দিল্লি দাঙ্গার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। এর সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৯ সালে সিএএ এবং এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময়। এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এফআইআর নম্বর ৫৯/২০২০-তে যার তদন্ত করছে ক্রাইম ব্রাঞ্চের স্পেশাল সেল।২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব আইনে একটি সংশোধন পাশ করে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান ও শিখ) মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে ওই সংশোধিত আইনে।এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। আদালত বলছে এখনও পর্যন্ত ৫৯ নম্বর এফআইআর-এ ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।তাদের মধ্যে ছয়জন বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। এই মামলার বিচার এখনও শুরু হয়নি।জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) প্রাক্তন ছাত্রনেতা উমর খালিদকে দিল্লি দাঙ্গার মাস্টারমাইন্ড বলে মনে করছে দিল্লি পুলিশ। তিনি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জেলে রয়েছেন।তাদের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (ইউএপিএ) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে সন্ত্রাসবাদ, দাঙ্গা এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে।ইউএপিএ আইনে জামিন পাওয়া সহজ নয়। উমর খালিদের জামিনের আবেদন দু’বার খারিজ করে দিয়েছে দুটি পৃথক আদালত।তার জামিনের আবেদন ২০২৩ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ছিল, কিন্তু এই মামলায় এখনও সওয়াল-জবাব শুরু হয়নি।সুপ্রিম কোর্ট থেকে তার জামিনের আবেদন প্রত্যাহার করেছেন উমর খালিদ এবং জানিয়েছেন তিনি এখন নিম্ন আদালতের দ্বারস্থ হবেন।উমর খালিদের বাবা সৈয়দ কাসিম রসুল ইলিয়াস বলেন, ১৫-২০ দিন আগে ছেলের সঙ্গে তার কথা হয়।উমর খালিদের মামলার বিচারে দেরি হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আপনারা ভেবে দেখুন, বিনা বিচারে সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেছে। চার বছরেও মামলা শুরু হয়নি। এটা যদি উৎপীড়ন না হয়, তাহলে কী? নিম্ন আদালতে দেড় বছর ধরে জামিন নিয়ে সওয়াল জবাব হয়। এরপর আমরা হাই কোর্টের শরণাপন্ন হই।”তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, “জামিনের আবেদনকে কেন্দ্র করে ছয় মাস ধরে সওয়াল জবাব চলে এবং তারপর আদেশটি চার মাসের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ২০২৩ সালের মে মাসে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে তালিকাভুক্ত হয়। মোট ১৪বার তালিকাভুক্ত হয়েছে ওই আবেদন কিন্তু প্রতিবারই স্থগিত হয়েছে।”“আমি মনে করি পুরো মামলাটাই মনগড়া। মামলা কাঠগড়ায় উঠলে পুলিশ কী ভাবে এর সমর্থনে তথ্য প্রমাণ দেবে সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই।”তবে উমর খালিদের বাবা জানিয়েছেন, দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর তার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
এই চার বছরে, আদালতের শুনানির সময় বহুবার আদালত দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করেছে এবং তাদের তদন্তকে দুর্বল বলেও বর্ণনা করেছে।দয়ালপুর থানায় ২০২৩ সালের আগস্ট সাসে দায়ের করা এফআইআর নং ৭১/২০ তে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল দাঙ্গা ছড়ানোর অভিযোগে।সেই মামলার শুনানি সময় বিচারক পুলসত্য প্রমচালা বলেছিলেন, “এই ঘটনাগুলি সঠিকভাবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হয়নি। শুরুতে করা ভুলগুলো ঢাকতে পক্ষপাতদুষ্ট ও ভুলভাবে মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।”তিনজনের বিরুদ্ধে পাথর ছোঁড়া, গাড়িতে আগুন লাগানো, সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে।একই সময়ে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, দিল্লির কারকারডুমা আদালতে, বিচারক বিনোদ যাদব এই তিনজনকে খালাসের সময় মন্তব্য করেছিলেন, “ইতিহাস যদি স্বাধীনতার পর দিল্লির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে তাকায়, তবে তদন্তকারী সংস্থাগুলির ব্যর্থতার বিষয়টি চোখে পড়বে গণতন্ত্রের রক্ষাকারীদের।”“এটাও চোখে পড়বে কীভাবে তদন্তকারী সংস্থাগুলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেনি।”এর আগে ২০২২ সালে ভারতের চারজন সাবেক বিচারপতি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে একটি তথ্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।সেই প্রতিবেদনে দিল্লি পুলিশের তদন্ত নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে এসেছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, দিল্লি সরকার এবং সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও কড়া মন্তব্য করা হয়েছিল।প্রতিবেদনটি যৌথভাবে লিখেছেন পাটনা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ।তিনি বলেন, “অনেক সাক্ষীর জবানবন্দি দেরিতে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এখন অভিযুক্তদের বয়ানের সঙ্গে এই বয়ানকে (সাক্ষীদের) মেলানোর চেষ্টা করছে দিল্লি পুলিশ। কল্পনা করুন একটি মাকড়সার জাল রয়েছে। মাকড়সার জাল কিন্তু সঠিকভাবে রাখাটা কঠিন বিষয়। এক প্রান্ত ছিঁড়ে গেলে পুরো জালটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”ওই একই তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্টে কপিল মিশ্রের মতো বিজেপি নেতাদের দেওয়া ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি মানুষকে উস্কে ছিলেন, যা হিংসায় ইন্ধন দিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর দায়ের করা হয়নি।সমাজকর্মী হর্ষ মন্দার দিল্লির পাতিয়ালা আদালতে পিটিশন দাখিল করে বলেছেন, কপিল মিশ্রের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা উচিত।সেই আবেদন এখনও আদালতে বিচারাধীন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে দিল্লি পুলিশ দিল্লি হাইকোর্টকে জানিয়েছিল যে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র এবং অন্যান্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এমন কোনও প্রমাণ নেই যা থেকে বলা যায় তার বক্তৃতা দাঙ্গায় উস্কানি দিয়েছে।
পুলিশ কী বলছে?
দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ও মামলার বর্তমান অবস্থা নিয়ে তাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে বিবিসি।দিল্লি পুলিশের অতিরিক্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা রঞ্জয় অত্রিশ্য বিবিসিকে বলেন, “এখন পর্যন্ত যে তদন্ত হয়েছে তা আইন মেনেই হয়েছে। তদন্ত শেষ করে আমরা বেশ কয়েকটি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দায়ের করেছে।”“যেহেতু মামলাটির বিচার এখনও চলছে, সেহেতু এটি মহামান্য আদালতের আওতাধীন। যেসব মামলায় তদন্ত চলছে, সেগুলিতে আমরা চূড়ান্ত রিপোর্ট দায়ের করব। দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে যেই হোক না কেন।”এই দাঙ্গায় বহু মানুষের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে কিন্তু নিহতদের পরিবারের ন্যায়বিচারের লড়াই শেষ হচ্ছে না।কীভাবে দাঙ্গা উস্কে দেওয়া হয়েছিল এবং কারা তাদের প্ররোচনা দিয়েছিল?দাঙ্গা, তার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ওঠা সওয়াল এবং সেই অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন একাধিক প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোর উত্তর এখনও মেলেনি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct