ভারতের দিল্লির উত্তর-পূর্ব অংশে ২০২০ সালে দাঙ্গা হয়েছিল। চার বছর আগে ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ওই দাঙ্গায় মৃত্যু হয়েছিল ৫৩ জনের। চারদিন ধরে চলা দাঙ্গায় জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেকের বাড়িঘর ও দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লি পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিহতদের ৪০ জন মুসলিম এবং ১৩ জন হিন্দু। এই দাঙ্গার শিকার এবং তাদের পরিবারের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই কিন্তু আজও চলছে। লিখেছেন উমঙ্গ পোদ্দার (বিবিসি বাংলা)।
ভারতের দিল্লির উত্তর-পূর্ব অংশে ২০২০ সালে দাঙ্গা হয়েছিল। চার বছর আগে ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ওই দাঙ্গায় মৃত্যু হয়েছিল ৫৩ জনের। চারদিন ধরে চলা দাঙ্গায় জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেকের বাড়িঘর ও দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লি পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিহতদের ৪০ জন মুসলিম এবং ১৩ জন হিন্দু। এই দাঙ্গার শিকার এবং তাদের পরিবারের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই কিন্তু আজও চলছে। বিবিসি হিন্দি এমনই কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাদের লড়াইয়ের বর্তমান পরিস্থিতি জানাতে।‘পুলিশ বলল বয়ান বদলে দাও’আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম উত্তর-পূর্ব দিল্লির কর্দমপুরী এলাকায়। দাঙ্গার সময় কর্দমপুরী এলাকা থেকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়।এই ভিডিওতে পুলিশের উর্দি পরা কয়েকজনকে পাঁচটি ছেলেকে লাঠি পেটা করতে দেখা গিয়েছিল।ওই পাঁচজনকে ‘জনগণমন অধিনায়াক’ এবং ‘বন্দে মাতরম’ গাইতে বলছিল তারা। ইন্টারনেটে ওই ভিডিও আজও রয়েছে।দিল্লি দাঙ্গার এটি অন্যতম প্রধান মামলা যেখানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ফয়জানও ছিলেন। ২০২০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু হয়।কর্দমপুরীর সরু জায়গা পেরিয়ে আমরা ফয়জানের বাড়িতে পৌঁছলাম।বাড়িতে ফয়জানের মা কিস্মতুন ছিলেন। বাড়ির পরিস্থিতি দেখিয়ে তিনি জানান, ফয়জানের রোজগারে সংসার চলত।তিনি আমাদের সেই জায়গায় নিয়ে যান যেখানে তার ছেলেকে মারধর করা হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেছেন।কীভাবে ফয়জানের মৃত্যু হয়েছিল এবং সেই মামলা কতদূর পৌঁছেছে, এই প্রশ্নের উত্তরে কিস্মতুন বলেন “চার বছর হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। একদিন পুলিশ এসে বলল, বয়ান বদলে দাও।”কিস্মতুন জানিয়েছেন, ঘটনার পর পুলিশ ফয়জানকে প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং পরে এক রাত তাকে জ্যোতিনগর থানাতে রাখা হয়।পরদিন তাকে ছেলেকে নিয়ে যেতে বলে পুলিশ। ফয়জনের মৃত্যু হয় ২৬শে ফেব্রুয়ারি।কিন্তু আদালতে পুলিশের দেওয়া নথি অনুযায়ী, ‘ফয়জানের সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করা হয়নি, স্বেচ্ছায় তিনি থানায় ছিলেন।’চার বছর পেরিয়ে গেলেও এই মামলায় পুলিশি তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ছেলেকে ন্যায়বিচার না পেতে দেখে ২০২০ সালে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন কিস্মতুন।এখন তিনি একটাই জিনিস চান, দোষীদের শাস্তি হোক। আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার দিল্লি হাইকোর্টে ওই মামলা লড়ছেন।তিনি বলেন, এই মামলায় গ্রেফতার তো দূরের কথা, পুলিশ আধিকারিকদের শনাক্তও করা হয়নি।
দিল্লি পুলিশের মনোভাব কী?
বৃন্দা গ্রোভার বলেন, “সে তো ভারতে পুলিশের মনোভাব এমন যে তারা সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করে এবং আদালতে পেশ করে বলে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই মামলায় সবকিছু খুব ঢিলেঢালা। প্রত্যেকবার আদালতের সামনে নতুন গল্প তুলে ধরা হয়।”তিনি আরও বলেন, “সমস্যা হল এখানে একটি সাধারণ দরিদ্র অংশের মুসলিম ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে এবং পুলিশকে তার তদন্ত করতে হবে। সেদিন কারা ডিউটিতে ছিলেন, সেই সমস্ত কাগজপত্র পুলিশের কাছে আছে।”“আপনি তাদের (পুলিশের) কাছে যাচাই করে দেখতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি, এভাবে তদন্ত চলতে থাকলে আগামী ছয় বছরও এই তদন্ত চলতে থাকবে। এর জন্য বিশেষ তদন্তকারী টিম গঠন করা দরকার।”সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী থানায় সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা বাধ্যতামূলক। তবে আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার বলছেন, পুলিশ জানিয়েছে, ওই সময় থানায় সিসিটিভি কাজ করছিল না।ফয়জানের বাড়ি থেকে একটু দূরে কউসর আলীর বাড়ি। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যাদের মার খেতে দেখা গিয়েছিল তাদের মধ্যে একজনের নাম কউসর আলী।তিনি জানিয়েছেন, সেদিনের কথা ভাবলে আজও শরীরে কাঁটা দেয়।কউসর আলী বলেন, “সেদিনের ঘটনার পর আমি এখনও পুলিশকে ভয় পাই। মনে হয় যেন ওরা আমাকে আবার তুলে নিয়ে যাবে। আমি দোষীদের শাস্তি চাই।”আসলে ওই ভিডিওতে যারা মারধর করছিলেন ফয়জন, কউসর আলী-সহ বাকিদের, তারা পুলিশের লোক।উল্টে দিল্লি পুলিশ হাইকোর্টে শুনানির সময় জানিয়েছিল ভিডিওতে যাদের দেখা গিয়েছে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে।এই মামলায় আদালতে আক্রান্ত পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। এখন পুলিশকে তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হবে।এই বিষয়ে তদন্ত কতটা এগিয়েছে তা জানতে আমরা দিল্লি পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি।আইপিএস অফিসার রাজেশ দেও যিনি দিল্লি দাঙ্গার তদন্তে গঠিত এসআইটির প্রধান ছিলেন, মামলাটি আদালতে রয়েছে বলে কথা বলতে অস্বীকার করেন।দাঙ্গা নিয়ে দিল্লি পুলিশের পরিসংখ্যান কী বলছে আমরা সেটা বোঝারও চেষ্টা করেছি।
পুলিশের পরিসংখ্যান
দিল্লি পুলিশ সূত্র থেকে বিবিসি যে তথ্য পেয়েছে তা বলছে, দাঙ্গার সাথে সম্পর্কিত মোট ৭৫৮টি এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ।এই পর্যন্ত মোট ২৬১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০৯৪ জন জামিনে রয়েছেন।আদালত এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৭ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং ১৮৩ জনকে খালাস করেছে।একই সঙ্গে ৭৫ জনের বিরুদ্ধে প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের মামলা বাতিল করেছে আদালত।নিউজ ওয়েবসাইট ‘দ্য প্রিন্ট’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিল্লি দাঙ্গায় নিহতদের মৃত্যু সংক্রান্ত ৫৩টি মামলার মধ্যে ১৪টি মামলা এখনও তদন্তাধীন।এরকম একটি ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। কিন্তু মোট কতগুলি মামলার তদন্ত এখনও চলছে সে বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।সিসিটিভি ভেঙেছিল যে ‘পুলিশকর্মীরা’অন্য একটি ঘটনায়, উত্তর-পূর্ব দিল্লির খুরেজিতে সিএএ প্রতিবাদস্থলের কাছে পুলিশের পোশাক পরা একদল লোককে সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙতে দেখা গেছে। এই ভিডিওটিও বেশ ভাইরাল হয়েছিল।
এই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
এই প্রশ্নে দিল্লি দাঙ্গায় আক্রান্ত পক্ষের আইনজীবী মেহমুদ প্রাচা বলছেন, “দিল্লি পুলিশের নাম রয়েছে এমন মামলাতেও তাদের (অভিযুক্ত পুলিশকর্মী) বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সে অর্থে জনস্বার্থ মামলার আওতায় যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ছিল, সেটাও হয়নি।”ওই দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ একাধিক পরিবারের হয়ে মামলা লড়ছেন মি প্রাচা।বিবিসি দিল্লি পুলিশের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চাইলেও এখনও তাদের তরফে কোনও উত্তর মেলেনি।রতন লাল-অঙ্কিত শর্মা মামলায় যা ঘটেছিল তবে সব মামলাতেই যে দিল্লি পুলিশি তদন্ত ধীর গতিতে চলছে তেমনটা নয়।দিল্লি দাঙ্গায় কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত হেড কনস্টেবল রতন লালের মামলায় দিল্লি পুলিশ এখনও পর্যন্ত কমপক্ষে ২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে ১০ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর রতন লাল মামলায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে মণিপুর ও বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।এই মামলায় পুলিশ পাঁচটি চার্জশিট দাখিল করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও বিচার শুরু হয়নি। একই সঙ্গে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কর্মী অঙ্কিত শর্মা খুনের ঘটনায় বর্তমানে ১১ জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি চাঁদবাগের একটি নর্দমা থেকে অঙ্কিত শর্মার দেহ উদ্ধার হয়।চার্জশিট অনুযায়ী, তার শরীরে ৫১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মামলার এক অভিযুক্তকে ২০২২ সালের অক্টোবরে তেলেঙ্গানা থেকে গ্রেফতার করেছিল দিল্লি পুলিশ।গত বছরের মার্চে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছিল এবং এখন আদালতে সাক্ষীদের বয়ান শোনা হচ্ছে।
পরবর্তী অংশ আগামীকাল..
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct