ভোট আসলে যত সব মন্দির মসজিদ নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়। কয়েক দশক থেকে ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ভঙ্গুর করে তুলেছে ধর্মীয় উসকানি। তবে রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ নতুন ঘটনা নয়, সমস্ত রাজনৈতিক দল ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে সুচতুর ভাবে বহুদিন ধরে। ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী, দলিত প্রার্থীরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বঞ্চিত এবং নানা দলের অধীনে একজন কর্মী হিসেবে কাজ করে। যদিও তারা নানা পদে অধিষ্ঠিত কিন্তু তাদের পদমর্যাদা মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বিভিন্ন প্রান্তে রাজনীতিতে ও সমাজে মেরুকরণ শুরু হয়। তা নিয়ে লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।
ভোট আসলে যত সব মন্দির মসজিদ নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়। কয়েক দশক থেকে ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ভঙ্গুর করে তুলেছে ধর্মীয় উসকানি। তবে রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ নতুন ঘটনা নয়, সমস্ত রাজনৈতিক দল ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে সুচতুর ভাবে বহুদিন ধরে। ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী, দলিত প্রার্থীরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বঞ্চিত এবং নানা দলের অধীনে একজন কর্মী হিসেবে কাজ করে। যদিও তারা নানা পদে অধিষ্ঠিত কিন্তু তাদের পদমর্যাদা মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি গোষ্ঠীর হাত ধরে রাজনীতিতে ও সমাজে মেরুকরণ শুরু হয়। তার ফলে উন্নয়ন, বেকারত্ব, অর্থনীতি, শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনের আড়ালে। ভোট এলে জম্মু-কাশ্মীর, পাকিস্তান, মন্দির, মসজিদ, দেবতা, হিন্দু, মুসলমান প্রধান অ্যাজেন্ডা হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনা সমানেই চলছে থাকে। অন্যদিকে উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে শুরু করে নানা উগ্র সংগঠনের বিভাজনের বীজ বপন করে চলেছে। কেন্দ্র রাজনীতিতে থাকার এই সমস্ত কর্মকাণ্ড পরোক্ষভাবে সমর্থন পাচ্ছে ও তার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন বিবাদ লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। বাবরি মসজিদ মামলার নিষ্পত্তির মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দু সমাজের একাংশ মনে করেছিল দীর্ঘ সমস্যার অবসান হলোভোট রাজনীতিতে এবং ধর্মব্যবসায়ীদের বাবরি মসজিদ উসকানির অ্যাজেন্ডা শেষ হল। কিন্তু একাংশের প্রত্যাশা মতো আবার নতুন ভাবে বিবাদ শুরু হলো আর এক মসজিদ নিয়ে। জ্ঞান ব্যাপী মসজিদ বহুকালের পুরানো মসজিদ যা ঐতিহ্যের উদাহরণ ও ভারতীয় মিশ্র সংস্কৃতির ইতিহাস বহন করে তা নিয়ে বিবাদ শুরু করল। হয়ত বাবরি মসজিদের মতোই তথ্য প্রমাণ ছাড়া মানুষের ভাবাবেগের উপর নির্ভর করে মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে রায় হবে।
নানা সংগঠন ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘুদের সামাজিক ব্যবস্থাপনার উপর কুঠারাঘাত করছে অন্যদিকে মুসলমান সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস মুছে ফেলার প্রয়াস চালাচ্ছে। তাই তারা, একদিকে গুরুত্বপূর্ণ নাম গুলো পরিবর্তন করে হিন্দু দেব -দেবী ও ধর্মীয় নামকরণ করছে। অন্যদিকে মুসলমান শাসকদের প্রতিষ্ঠিত ইমারত, প্রসাদ, মসজিদ প্রভৃতি দখল করে নিজেদের মতো করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছে। সকলেই অবগত, বিশ্বনাথ মন্দির বিশ্বখ্যাত তার এক প্রান্তে জ্ঞানব্যাপী মসজিদ বহুকাল ধরে রয়েছে যা নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। পাশাপাশি বসবাস ও ধর্মচর্চা চলে আসছে আমাদের দেশে।শুধু তাই নয় বিবাহ, উৎসব, পূজা-পার্বণ, ঈদ, রাজনীতি, মেলা, খেলাধুলা বিভিন্ন কাজকর্ম থেকে বসবাস সবকিছু একই ছাতার তলে। তাই মন্দির ও মসজিদ পাশাপাশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদিও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তবু সংখ্যাগুরুরা নানা সুযোগ সুবিধা পায় তেমনি ভাবে সরকারি রেলওয়ে স্টেশন, পুলিশ স্টেশন প্রভৃতি জায়গায় মন্দির নির্মাণ হয়েছে ধর্মীয় চর্চা করার জন্য অথচ এখানে হওয়ার কথা ছিল না। এটাই স্বাভাবিক, মানুষ যেখানে থাকবে, খাবে, উঠাবসা করবে সেখানে ধর্মীয় চর্চার জন্য মন্দির মসজিদ থাকবে। তাই দেখা যায়, ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠরা নানা সরকারি অফিসে, বাস স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে সকল জায়গায় পূজা পার্বণের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য মসজিদ না থাকাই তারা খোলা ফাঁকা জায়গায় নামাজ আদায় করেন। কিন্তু বর্তমানে তা নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু কথা হল তা নিয়ে কোন অশান্তি ছিল না বহুকাল, কেউ প্রতিবাদ করেনি অথবা যে সমস্ত সরকারি ভবনে সরকারি জায়গায় অফিসে আদালত ও নানা জায়গায় মন্দির নির্মাণ হয়েছে ও পূজা পার্বণ চলছে তা নিয়ে তো প্রতিবাদ হয় না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে যেখানে সেখানে সরকারি জায়গা দখল করে এভাবে মন্দির গজে উঠছে প্রতিনিয়ত তা নিয়ে কোনোদিন কেউ প্রতিবাদ করেনি। ধর্ম কর্ম নিজেদের মতো করে সকলেই চর্চা করেন। এবার তীব্র হল সেই প্রতিবাদ। সবটাই রাজনীতি ও কিছু সংগঠনের উসকানির ফলাফল। কেন্দ্রে এমন একটি সরকার চলছে যা কেবল ধর্মীয় মেরুকরণ করে ক্ষমতা দখল করতে চাই। সারা বছর ধরে মাত্র চৌদ্দ শতাংশ মানুষের নিয়ে কথা, উসকানিমূলক বক্তব্য, এনপিআর, এনআরসি, নাগরিক আইন, তিন তালাক, বহু বিবাহের মতো নানা আইন কানুন নিয়ে মেতে রয়েছে। ধর্মীয় নানা বিধানের উপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা হচ্ছে যা সম্পূর্ণভাবে সংবিধান বিরোধী ও মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে, নানা রাজ্যে দুর্নীতিতে ডুবন্ত, শিক্ষার বেহাল দশা, রোজকার নেই, বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ ছুঁয়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া তা নিয়ে কোন ভাবনা নেই। অথচ ৭০০- ৮০০ বছরের নানা স্থাপত্য শিল্প, ইমারত, সংস্কৃতির প্রতীক ও ভাস্কর্যের মধ্যে মূর্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে একদল সংগঠন ও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। নতুন করে বিতর্কের দানা মালদার আদিনা মসজিদ নিয়ে যা ১৩৭৫ সালে নির্মিত ইসলামিক মসজিদ। শুধু তাই নয়, আদিনা মসজিদ একটি এএসআই তালিকাভুক্ত স্মৃতিস্তম্ভ এবং ক্রমিক নাম্বার এন ডাব্লিউ বি- ৮১। যেখানে বাংলা, আরবি, ফারসি ও বাইজেনটাইন স্থাপত্যের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর মসজিদ যা উত্তর দক্ষিণে ৫২৮ ফুট লম্বা ও ৩২২ ফুট চওড়া। এই মসজিদে ২৬০ টি পিলার বা থাম আছে ও ৩৮৭ টি গম্বুজ আছে।কয়েকশো বছরের পুরানো একটি মসজিদ হঠাৎ করে নাকি আদিনাথের মন্দির বলে দাবি করা হচ্ছে। তাও একজন সাধুসন্ত, কোনো ইতিহাসবিদ হলে বিষয়টা ভাবার ছিল। আর তার পেছনে হই হই করছে কিছু ভক্ত ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকজন। ভারতবর্ষের এমন কোন মন্দির আছে চার পরিকাঠামো মসজিদের মতো ও এমন কোন মন্দির আছে যার উপর ৩৮৭টি গম্বুজ নির্মাণ করা যাবে মন্দির কে ভেঙেচুরে। সহজে অনুমেয় এত বড় পরিকল্পিত মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরিত করা যায় না বা মন্দিরকে মসজিদের রূপান্তরিত করা যায় না। পরিকল্পিত ভাবে কিছু সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের পরামর্শে ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে হিন্দু-মুসলমান ত্রাস খেলার চেষ্টা হচ্ছে যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করা যায়। তবে আদিনা মসজিদের গায়ে নানা জায়গায় বর্তমানে দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে তা সকল দর্শনার্থীদের অবগত এবং তা কীভাবে মসজিদের গায়ে লাগানো হয়েছে তা নিয়ে রহস্য রয়েছে সকলেরই। তবে আদিনা যে মসজিদ তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না এবং স্বাভাবিকভাবেই না থাকারই কথা। পরিষ্কারভাবে ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সিকান্দার শাহ কর্তৃক নির্মিত একটি রাজকীয় মসজিদ তিনি ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সদস্য ছিল। যদি মন্দির ছিল তবে দীর্ঘ প্রায় ৭০০ বছরের শাসনে তার খতিয়ান নেই। মসজিদের গায়ে মূর্তি তৈরি হয়েছে একদা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে মুসলমান শাসনের অবসানের পর যেমন ভাবে বাবরি মসজিদের ভেতরে মূর্তি ঢোকানো হয়েছিল। যদিও আদিনা বর্তমানে আর্কোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে যেখানে মন্দির- মসজিদ নিয়ে প্রশ্ন আসার কথা নয়। এই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও হয় না। এটি বর্তমানে ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন ও করুকার্য, স্থাপত্যশিল্প, কাঠামো বর্তমানের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। তারপর এই সমস্ত ইমারত এগুলোকে নিয়ে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানো অপরাধ। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে ও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে ভাগ করার প্রয়াস চলছে। যার ফলাফল বর্তমানে দুই রাজনৈতিক দলেরই হবে। একদিকে সংখ্যালঘুরে ভয়ে রাজ্যের শাসক দলকে আঁকড়ে ধরবে এবং তাদের চাওয়া পাওয়া, উন্নয়ন, নানা সমস্যাগুলো ঢাকা পড়ে যাবে এবং তারা বাঁচার তাগিদে বিজেপিকে পরাজিত করতে একত্রিত হয়ে তৃণমূলকে ভোট দেবে। অন্যদিকে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলো একত্রিত হলে বিজেপি সুবিধা পাবে।। আদিনা কে কেন্দ্র করে রাজ্যের মানুষের মধ্যে যে মিলনের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতিকে নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে। সকলের সতর্ক থাকা উচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে যা নষ্ট হলে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও সমাজব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে যায়। তাই এমন অশুভ শক্তিগুলোকে প্রতিহত করে বাংলা ও ভারতের সম্প্রীতি বজায় রাখা। কারণ এমন হাজার হাজার আদিনা মসজিদকে কে মন্দিরে রূপান্তরিত করলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুরা হবে না। যেখানে রেল থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা, কলকারখানা, জাতীয় সম্পত্তি, রাস্তাঘাট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ঋণ ও বেকারত্বের যন্ত্রণা যেখানে চরম সেখানে মন্দির-মসজিদ নিয়ে ঝগড়া করলে আরো নিঃস্ব হয়ে যাবো নিজেরা। তাই আমাদের সকলের উচিত বর্তমানের কর্মপন্থা নিয়ে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাভাবিক ও সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশ উপহার দেওয়া। জাতের লড়াই দূর করে ভাতের জন্য সকলে একত্রিত হওয়া।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
লেখক: অধ্যাপক দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ, দক্ষিণ দিনাজপুর
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct