খারাপ মানুষের খোঁজে
মোহাম্মদ কাইকুবাদ আলি
কেমন আছেন, ভাই? সচরাচর এমন প্রশ্ন কেউ করে না আজকাল। রোজ কম করে শ-খানেক খদ্দের আসে এই দোকানে। যা দরকার তা চায়। টাকা দেয়। চলে যায়। অনেকেই আছে রোজ আসে। তবে কেউ ভুলেও এমন জিজ্ঞেস করে না।সকালে দোকান খুলে গতরাতে শহর থেকে আনা সামগ্রী বের করে আপন আপন জায়গায় রাখছিলেন দোকানি।হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে সে অবাক হলেন। বলতে গেলে একপ্রকার ভালোই লাগলো। “ভালো আছি”, এই বলে ঘুরে দেখলেন ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। পাতলা শরীর। পরনে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা। দেখেই বোঝা যায় শিক্ষিত এবং ভদ্র।তবে রাগটা হলো যখন সেই ব্যক্তি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, আপনি কি খারাপ মানুষ?- কি!- মানে আপনি কেমন মানুষ? ভালো? না খারাপ?এ আবার কি ধরনের প্রশ্ন! করো কি নিজেকে খারাপ মানুষ বলে পরিচয় দিতে ভালো লাগে? কেউ চাইবেও না। পৃথিবীতে সবাই নিজের কাছে ভালো মানুষ, তা সে যতবড় জাহান্নামীই হোক না কেন।ব্যক্তিটির বয়সের কথা বিবেচনা করে দোকানি উত্তর দিলেন, ভালো। এবং বাকি জিনিসগুলো সাজাতে লাগলেন।কিছুক্ষন পর দেখলেন, সেই ব্যক্তি এখনও দাঁড়িয়ে। দোকানের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন। কিছু যেনো খুঁজছেন। দোকানি আবার নিজের কাজে মন দিলেন। পাগল হলে, লাঠি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতেন।
তিনদিন আগে হাক্কানী সাহেব হঠাৎ স্বপ্নে দেখেন, তিনি মারা গেছেন। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরিহিত তার দেহটি আকাশের দিকে ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। চারিদিক ধোঁয়াটে। পায়ের তলায় তার নিজের বাড়ি, আসে পাশের বাড়ি, গাছপালা, চাষের জমি, বাড়ির সামনের রাস্তা, সেটি গিয়ে মিশেছে পাকা রাস্তায়, পাকা রাস্তা মিশেছে গ্রামের মোড়ে; মোড়ের বাজার, দোকান-পাট, দোকানের আলো। সব যেনো নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আর হাক্কানী সাহেব ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছেন আকাশের দিকে। মেঘেদের ছাড়িয়ে।হাক্কানী সাহেব এক টুকরো মেঘের উপর দাঁড়িয়ে। চারিদিকে কালো কুচকুচে অন্ধকার। মহাকাশ। হঠাৎ তার সামনের দিকে আলোর ঝলসানী। কে যেনো দাঁড়িয়ে। শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আলোর অবয়ব। দূর থেকে ভেসে আসছে আযানের সুর। হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাস সালাহ...হাক্কানী সাহেব মনে মনে সেই ডাকের উত্তর দিলেন, লা হাওলা ওয়ালা কুয়ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল অলিউল আজিম...তারপর দেখলেন, চারিপাশে তার মতো অজস্র মানুষ টুকরো টুকরো মেঘে চড়ে সেই আলোর দিকে এগিয়ে চলেছে। সবার গায়েই সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা। গ্রামে হাক্কানী সাহেব একমাত্র ব্যক্তি যে নিয়মিত সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে বাইরে বেরোতেন। এখানে সবার পরনেই একই পোশাক। এদের অনেকে দুই হাত তুলে মোনাজাত করতে করতে যাচ্ছে; কেউ আবার মুখে ফিস ফিস করে কি পড়ছে, হয়তো কোরআনের কোনো আয়াত, কিংবা দরুদ কালাম। কেউ কেউ আবার অবাক হয়ে চারিদিক দেখছে। তার পাশ দিয়ে দুই বছর আগে বিগত হওয়া স্কুলের ক্লার্ক রহমান সাহেব চলে যাচ্ছেন। কিন্তু চিনতে পারলেন না। হাক্কানী সাহেব ঠিক চিনেছেন। ডাকলেন। কিন্তু কোনো আওয়াজ নেই। দূর থেকে ভেসে আসছে জিকিরের ধ্বনি, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ... এত মধুর জিকিরের ধ্বনি হাক্কানী সাহেব এর আগে কখনোই শোনেন নি। রমজান মাসে, সাতাশে রাতে অনেকেই তারাবীহের নামাজের পর লাইলাতুল কাদার এর নামাজ পড়ে, সাথে তোলে এমন জিকিরও। মনে হচ্ছে এই জিকির মহাকাশের বুক থেকে বেরিয়ে আসছে।হাক্কানী সাহেব মনে মনে বললেন, এই কি তবে কিয়ামতের দিন? পৃথিবীতে নিশ্চয় সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, এবং নাতি নাতনী সবাই কি তাহলে মারা গেছে! কি অদ্ভুত, তিনি বাম বুকে ব্যাথা অনুভব করলেন, হায় আল্লাহ। কোথায় তারা? তিনি শুনেছিলেন, মৃত্যুর পর মানুষের কোনো ধরনের অনুভূতি থাকে না। তবে, তার বুকে ব্যাথা কিভাবে?হঠাৎ, সবাই কেমন যেনো চারপাশ থেকে হারিয়ে গেলো। হাক্কানী সাহেব আলোর মাঝে দাড়িয়ে একা। ভাসছেন আলোর এক নৌকায়। এক গম্ভীর গলায় কেউ যেনো বলছে, এই মোহাম্মদ গোলাম হাক্কানী, আজ তোর বিচার। তোর হিসেব হয়ে গেছে। তোর পাপের পাল্লা ভারী। তুই খারাপ মানুষ। তুই জাহান্নামে...
পুরো শরীরে ঘাম নিয়ে হাক্কানী সাহেবের স্বপ্ন ভেঙেছিল। তার স্ত্রী পাশে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন। তিনি বিছানা ছেড়ে এক গ্লাস জল খেলেন। ঘড়িতে দেখতে যাবেন কি, ফজরের আযান ভেসে এলো গ্রামের মসজিদ থেকে। তিনি কলতলায় গিয়ে মুখ হাত ধুলেন। অজু করলেন। বারান্দায় ছোট আলমারির উপর থেকে জায়নামাজ নিলেন। পাশের ঘরে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়লেন। মোনাজাতে তার মনে পড়লো, তিনি পাপ করেছেন। তিনি খারাপ মানুষ। কিন্তু কি পাপ খুঁজে পাচ্ছেন না। জায়নামাজে বসেই নিজের জীবনকে মূল্যায়ন করে দেখলেন। অনেক ভাবলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন না, তিনি কি এমন করেছেন যে নিজেকে খারাপ মনে হয়। যার জন্যে তাকে জাহান্নাম যেতে হতে পারে।সকালে নিজের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, রিনার মা। আমি কি খারাপ মানুষ? - তা কেনো হতে যাবে? তুমি যে ভালো মানুষ সে সবাই জানে। আজ এত বছর ধরে...স্ত্রীর কথা হাক্কানী সাহেবের আর শুনতে ইচ্ছা করলো না। সে সহধর্মিণী, তাই ভালো বলবেই।হাক্কানী সাহেব সারা দুপুর বিছানায় শুয়ে থাকলেন, আর সেই স্বপ্নের কথা ভাবলেন। যোহরের আযান দিল। কলতলায় গেলেন। অজু করলেন। মসজিদের দিকে রওনা দিলেন। নামাজ শেষে ইমাম সাহেবকে বললেন, নিজের স্বপ্নের কথা। ইমাম সাহেব সাহেব বললেন, নিশ্চয় আপনার দ্বারা কোনো গুনাহ হয়েছে। তওবা করেন আল্লাহর দরবারে। তিনি রহমানের রহিম। হাক্কানী সাহেব আস্তাগফিরুল্লাহ এর তাসবিহ পড়লেন। কিন্তু মনে শান্তি পেলেন না। কি পাপ কাজ করেছেন, কেনোই বা তিনি খারাপ, সেটা জানা দরকার।আসরের নামাজ পড়ার সময় হঠাৎ তার মাথায় এলো, তিনি কাউকে খারাপ মনে করেন নি কোনোদিন। সব মানুষই তার কাছে ভালো। মানুষের কর্ম খারাপ হতে পারে, মানুষ কোনোদিন খারাপ হয় না। যেহেতু নিজেকে খারাপ মনে হয়েছে, হাক্কানী সাহেব তাই খারাপ মানুষের সন্ধানে বেরোবেন। নিজের দোষে অন্য মানুষকে দেখলে মানুষের এক ধরনের আত্মতৃপ্তি থাকে। মনে হয়, আমি তো একা নই। তাই তিনি স্থির করলেন, খারাপ মানুষ খুঁজে বের করবেন। আর জানতে চাইবেন সে খারাপ কেনো। নিশ্চয় নিজের খারাপের কারণ খুঁজে পাবেন।এই উদ্দেশ্যেই আজ তিনদিন হলো, হাক্কানী সাহেব গৃহত্যাগী। রাস্তা রাস্তা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ধরনের মানুষের কাছে যাচ্ছেন। একটাই প্রশ্ন করছেন, আপনি কি খারাপ মানুষ? তবে কেউ নিজেকে খারাপ স্বীকার করছেন না। যতই তিনি নিরাশ হচ্ছেন, ততই জিজ্ঞাসার ইচ্ছা বেড়ে যাচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct