আপনজন ডেস্ক: রাঁচির বিরসা মুন্ডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে অ্যারাইভাল হল দিয়ে বের হওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রান্সিস জ্যাভিয়ের মিঞ্জের কাজ। তৎপরতার সঙ্গে লোকজনের আসা–যাওয়া খেয়াল করেন। নিজের এই দায়িত্ব নিয়ে ফ্রান্সিসের মনোজগতের ভাবনাটা দার্শনিকসুলভ, ‘সবাইকে বিমানবন্দর দিয়ে বের হয়ে আসতে দেখি। কিন্তু আমাকে খেয়াল করে খুব কমই। কেন করবে? আমি তো আরও অনেকের মতোই সামান্য এক নিরাপত্তাকর্মী।’ কয়েক ঘণ্টা আগেই ভাড়া করা বিমানে ভারত জাতীয় ক্রিকেট দল এই বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। রাঁচিতে আজ থেকে শুরু ইংল্যান্ড–ভারত চতুর্থ টেস্ট সামনে রেখে ভারতের দল বিমানবন্দরে অবতরণ করে ফ্রান্সিসের সামনে দিয়েই বের হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড়দের কেউ তাঁকে আলাদা করে খেয়াল করেননি। কিন্তু ফ্রান্সিস চোখেমুখে ভক্তি নিয়ে দেখেছেন সবাইকে। আর অপেক্ষা করছেন একটি সময়ের—একদিন এই দলে থাকবে তাঁর ছেলেও!
ফ্রান্সিসের ছেলের নাম রবিন মিঞ্জ। ঝাড়খন্ডের এই বাঁহাতি উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যানকে গত বছর ডিসেম্বরে আইপিএল নিলামে ৩ কোটি ৬০ লাখ রুপিতে কিনেছে গুজরাট টাইটানস। আইপিএলে চুক্তিবদ্ধ হওয়া প্রথম ভারতীয় আদিবাসী ক্রিকেটার তিনি। কিন্তু ফ্রান্সিস জানেন, এটাই ছেলের সাফল্যের চূড়া নয়। সম্ভবত কেবল শুরু। ভারতের অন্য সব তরুণ ক্রিকেটারের যে স্বপ্ন—ভারত জাতীয় দলে খেলা—ফ্রান্সিসের ছেলেও একই স্বপ্ন দেখে ক্রিকেটার হয়ে উঠেছেন। কিন্তু সেই ‘সোনার হরিণ’-এর দেখা পাওয়া কত কঠিন—ফ্রান্সিস সেটাও জানেন, ‘সে কেবল শুরু করল। পৃথিবীর মঞ্চে সে স্রেফ নিজের নামটা নিবন্ধিত করেছে। পথ এখনো অনেক লম্বা।’ ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে ফ্রান্সিস এ কথাগুলো বলার সময় গেট দিয়ে কিছু কম বয়সী ছেলে বের হচ্ছিল। ফ্রান্সিস তাদের থামিয়ে পরিচয়পত্র দেখতে চান। কাজ শেষে বললেন, ‘এটাই আমার দায়িত্ব। বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়া কেউ যেন পরিচয়পত্র ছাড়া পুনরায় ঢুকতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করাই আমার কাজ। কারও কাছে হয়তো অস্ত্রও থাকতে পারে, কে জানে! এমন একটি ভুলের জন্য আমার চাকরি থাকবে না।’
ফ্রান্সিস এরপর একটু দম নিলেন। যেন কিছু একটা ভাবছিলেন। তারপর বললেন, ‘ছেলে আইপিএল ক্রিকেটার হওয়ায় আমি মোটেও ঢিলেঢালা থাকতে পারি না। হ্যাঁ, এটা সত্য, পরিবার আর্থিকভাবে একটু ভিত পেয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবনে কখন কী নেমে আসে কে জানে! সহকর্মীরাও বলেছেন এখন আমার চাকরি করার কী দরকার। তাদের বলেছি, নিজেকে যত দিন সুস্থ এবং কর্মক্ষম মনে করব, তত দিনই কাজ করব।’
ঝাড়খন্ডের গুমলা জেলায় বাড়ি ফ্রান্সিসের। প্রায় দুই দশক চাকরি করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। তবে নিজের পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করেননি, ছেলে রবিনও নয়, ‘আমরা এখনো একই ঘরে থাকি। একই বাইক চালাই। কখনো অন্য কোথাও বাড়ি করার বা বড় বাইক কেনার কথা ভাবিনি। সৌভাগ্যজনকভাবে রবিনও একই ভাবনার মানুষ। সে জানে পরিশ্রম করে যেতে হবে।’ রবিনের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার মূলে আছে ফ্রান্সিসের খেলোয়াড় হতে না পারার অপূর্ণতা। নিজের গ্রামে হকি ও ফুটবল খেলতেন ফ্রান্সিস। অ্যাথলেটিকসেও ভালো ছিলেন। কেন এগোতে পারেননি, সেটি জানাতে গিয়ে ফ্রান্সিস বললেন, ‘আমর গল্পটা সবাই জানে। দিল্লির ফুটবল ক্যাম্পেও আমাকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু আমি সেখানে যেতে পারিনি ছবি ছিল না বলে। ওই সময় আমাদের গ্রামে কোনো স্টুডিও ছিল না। ক্যাম্পে না যেতে পারার পর আমি আর এগোয়নি। সময়ও ছিল না।’ অল্পবয়সী রবিনের মধ্যে ‘সহজাত হিটার’–এর চিহ্ন দেখে একটা টেনিস বলের ক্রিকেট ব্যাট কিনে এনে দিয়েছিলেন ফ্রান্সিস। এরপর ভর্তি করিয়ে দেন কোচিং একাডেমিতে। যেখান থেকে ধাপে ধাপে রবিন আজ আইপিএল-মঞ্চে। ঝাড়খণ্ডের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ফ্রান্সিসকে ভালোমতোই চেনেন। গত বছর আইপিএল নিলামের আগে ফ্রান্সিসকে চেন্নাই সুপার কিংসের ধোনি বলেছিলেন, কোনো দল রবিনকে না নিলে চেন্নাই নেবে। তবে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। গুজরাটই তাঁকে দলে ভিড়িয়েছে।
ফ্রান্সিস এখন স্বপ্ন দেখেন, তাঁর ছেলেও একদিন রাঁচি বিমানবন্দর দিয়ে ভারতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে বের হয়ে আসবেন তাঁর সামনে দিয়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct