ডা. শামসুল হক, আদর্শ একটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মালদ্বীপ যে একটু আলাদা ধরণেরই , সেটা বিশ্বের সব প্রান্তের ভ্রমণ পিপাসুরা মেনে নেবেন এক বাক্যেই। এই কয়েক বছর আগেও একেবারে স্ব স্বমহিমাতেই বিরাজমান ছিল সেই অঞ্চল। কিন্তু করোনার সময় থেকে শুরু করে বিগত কয়েক বছর সে হারাতে শুরু করেছে তার নিজস্ব গরিমাও। তাই আচম্বিতেই বদলে গেছে তার আসল রূপটাও। বলাই বাহুল্য, করোনার সময় থেকেই কমতে শুরু করেছে সেখানকার পর্যটক সংখ্যা এবং অদ্যাবধি চলছে সেই একই ধারা।
একটা সময় ছিল যখন বিপুল সংখ্যক পর্যটক ভীড় জমাতেন এই দ্বীপদেশর রাজধানী মালে সহ অন্যান্য আরও অনেক পর্যটন ক্ষেত্রেই। আর সেই আয়ের একটা বড় অংশই কিন্তু ছিল সেখানকার রুজি রোজগারের অন্যতম একটা উপায়ও। সেখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ যেমন খুবই কম, তেমনই খোলা নেই সেখানকার মানুষজনদের আর্থিক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য কোন উপায়ও। মাছ ধরা এবং শিপিং এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামোটাকে একটু মজবুত করার চেষ্টা সেখানকার মানুষজন করেন বটে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা কিছুই নয়। একটা সময় অবশ্য বিখ্যাত ছিল মালদ্বীপের দড়ি, যা তৈরি হত সেখানকার নারকেলের ছোবড়া থেকেই। বিশ্বখ্যাত ছিল সেই দ্বীপদেশের কড়িও। আর ছিল শুকনো মাছের ব্যবসা। কিন্তু বর্তমানে সেটাও একটু কমের দিকে। ছোটখাটো ব্যবসাও সেখানে ভালই চলত। নৌকা নির্মাণ, হস্তশিল্প ইত্যাদির মাধ্যমেও কিছু রোজগার হত। সেইসব অবশ্য এখনও টিকে আছে। তবে মোট জনসংখ্যার উপার্জনের তুলনায় সেটাকে মোটেও ধর্তব্যের মধ্যে আনা যায় না।অতএব এই মুহূর্তে মালদ্বীপের সমস্যা অনেক। অর্থনৈতিক সমস্যা তো আকাশছোঁয়া। তাই এই মুহূর্তে বিদেশি ঝণের বোঝায় ভীষণভাবেই কাহিল হয়ে পড়েছে সেই দ্বীপদেশ।দিন যত এগিয়ে চলেছে বেড়ে চলেছে সেই বোঝাও। বলা যেতে পারে, তার ধাক্কায় দারুনভাবে বিপর্যস্ত সেখানকার প্রশাসনও। আর সেটা বুঝে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারও সতর্ক করেছে সেই দেশকে। আর এই তথ্য একেবারে প্রকাশ্যে এনেছে আই. এম . এফ। মালদ্বীপের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির একেবারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই অবশ্য সেই সংস্থা পেশ করেছে সেই তথ্য।
জানা গেছে চিনের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি ঋণ পাচ্ছে মালদ্বীপ। সেখানকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মাইজু ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীন তার বন্ধু দেশের প্রতি অনেক বেশি উদার হয়েও উঠেছে। ২০২৩ সালের ১৭ ই নভেম্বর সেই দেশের ক্ষমতায় এসেছেন মাইজু। তারপর সর্বপ্রথমই তিনি সেরে নেন চিন সফর এবং বর্তমানে সেই বন্ধু দেশের সঙ্গে তাঁর সখ্যতাও অনেক বেড়েছে। তাই পাচ্ছেন দেদার ঋণও। প্রেসিডেন্ট নিজে একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ । ইঞ্জিনিয়ার তিনি। বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। লণ্ডনের পি . এইচ.ডি ডিগ্ৰী তাঁর অর্জন করা বিশেষ একটা সন্মানও। অতএব বিবেক , বিবেচনা এবং বুদ্ধির দৌড়ে তিনি যে অনেকটাই এগিয়ে সেটা অস্বীকার করারও কোন উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রশাসন চালানোর ক্ষমতা , এই দুটো কিন্তু একই বিষয় নয়। তাই দেশের উন্নয়নের কথা ভেবে তার অর্থনৈতিক কাঠামোটা ঠিক কেমনভাবে গঠন করা সম্ভব সেটা ঠিক করতে হবে তাঁকেই। কারণ তিনিই দেশের সর্বেসর্বা। প্রশাসনে তাঁর কথাই শেষ কথা। অবশ্য সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। এখনও অনেক কিছু জানা বোঝারও আছে তাঁর। সুতরাং এই মুহূর্তে সেই মানুষটার কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করাও সমীচিন নয়। কিন্তু সতর্ক তাঁকে হতেই হবে। চোখ কান খোলা রাখতে হবে। সকলের আশা ভরসার উপযোগীও হয়ে উঠতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোটাকে মজবুত করা সম্ভব কিভাবে সর্বপ্রথম ভাবতে হবে সেটাই। সেজন্য প্রথমে রূপ বদলাতে হবে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর। একটা কথা কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে , মালদ্বীপের দর্শণীয় স্থানসমূহ বিশ্বের যেকোন কেন্দ্র অপেক্ষা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যই ভোলবার নয়। আছে অতি মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত , পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর এবং পরিশুদ্ধ জলবেষ্টিত বেলাভূমিও। সেখানে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব সকালের সূর্যোদয়। আর অপরাহ্ণ বেলায় সূর্যাস্ত ? ভোলা সম্ভব নয় সেই দৃশ্যও। আর মেঘলা দিনে সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যের বিপরীত দিকে ফুটে ওঠা রামধনুর সাতটা রঙের সেই অপরূপ খেলা , নিসর্গের অকৃত্রিম সেই সৌন্দর্যকে একবার যাঁরা উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা ভুলতে পারবেন না কোন দিনই। বিশ্বজুড়ে আছে মালদ্বীপের শুকনো মাছের চাহিদাও। করোনা কালে হয়তো সেখানে কমিয়ে দিয়েছে ভ্রমণ পিপাসু মানুষজনদের সংখ্যা। সেইসঙ্গে কমেছে সেই মাছের চাহিদাও। কিন্তু একসময় থাইল্যান্ড , জাপান , সিঙ্গাপুর , ইউ . কে , শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশসমূহে সেটা পাঠানো হতো তা থেকে কিন্তু আসত অনেক বিদেশী মুদ্রাও। অতএব একটু চেষ্টা করলে আবারও সম্ভব সেই পুরোনো দিনে ফিরে আসাও। আর মালদ্বীপের টুনা মাছ ? সে তো বিশ্বের প্রায় সব দেশের লোকের অতি প্রিয় খাবারও। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ সেই মাছের মধ্যে মেলে , জিঙ্ক , পটাশিয়াম , ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন সি সহ আরও অনেক কিছুই। চর্বি কম, প্রোটিন বেশি। সেই মাছ খেলে কমতে বাধ্য খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ। কমায় অতিরিক্ত রক্তচাপও। দেহের হাড়ও মজবুত করে। কমায় ক্যানসারের প্রবনতাও। সুতরাং সেই মাছের চাহিদা যাতে আবার আগের মত বাড়ে নজর দিতে হবে সেই দিকেও। তাতে অর্জিত হবে বিদেশি মুদ্রা এবং কমবে ঋণের বোঝাও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct