তথাকথিত ‘মধ্যবিত্ত’রা ভারতীয় সমাজের কোন বুনিয়াদি কঠিন শক্তি নয় বরং পলকা স্তর। প্রান্তিক রাজনীতি হল সেই রাজনীতি যা সমাজের প্রান্তিক মানুষগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব।
শিবাজি কীভাবে একজন বৃদ্ধ মহিলার সাহচর্যে এসে কৌশলী চিন্তা-ভাবনার পাঠ শিখেছিলেন সে সম্পর্কে একটি বিখ্যাত গল্প রয়েছে। সামরিক অভিযানে পরাজয়ের পর যখন তিনি জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করছেন, সে সময় এক বৃদ্ধার দোরগোড়ায় খাবারের জন্য থামেন শিবাজি। ওই বৃদ্ধা শিবাজিকে চিনতে না পেরে তাঁকে এক থালা গরম গরম খিচুড়ি পরিবেশন করলেন। যথারীতি শিবাজি ওই খিচুড়ির মধ্যিখান থেকে খেতে শুরু করলে আঙুলে ছ্যাঁকা খান। ঠিক তখনই বৃদ্ধা বলেন: “তরুণ সৈনিক, তুমি তো দেখছি তোমার রাজার মতোই। যিনি শত্রু অঞ্চলের কেন্দ্রে আক্রমণ করার চেষ্টা করে যান আর বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হন। তুমি একটা ধার থেকে খাওয়া শুরু করে তারপর মাঝখান অবধি পৌঁছাও না কেন?” এরপর থেকে খিচূড়ি খাওয়া তো বটেই, শিবাজি তাঁর ভবিষ্যতের সমস্ত সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে এই পন্থাই বেছে নিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা কি সেই পরামর্শ অনুসরণ করে প্রথমে কিনারা জয়ের প্রচেষ্টা? মণিপুর যাত্রায় যোগ দিয়ে আমি এই উপলব্ধি করেছি। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে কোনও নির্বাচনী প্রাবল্য ছাড়াই যাত্রা শুরু করার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাহুল গান্ধি জোর দিয়ে বলেছিলেন এই যাত্রা অবশ্যই উত্তর পূর্ব থেকে শুরু হবে এবং তাও মণিপুর থেকে। শারীরিক এবং রাজনৈতিক দু’দিক থেকেই এই সিদ্ধান্ত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তপ্ত মণিপুরে এই যাত্রা আভ্যন্তরিন বা বাহ্যিক যে কোনও জঙ্গি সংগঠনের জন্য একটি সহজ লক্ষ্য হতে পারত। তা ছাড়া, প্রায় এক দশক আগে পর্যন্ত উত্তর-পূর্বের পার্বত্য রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের যা আধিপত্য ছিল এখন তাও ফ্যাকাশে। যাত্রার জন্য ভিড় জড়ো করার জন্য দলীয় সংগঠনের উপর নির্ভর করা যায়নি। রাহুল গান্ধির কাছে এটা ছিল একটা নৈতিকতা এবং আদর্শের বিষয়। আপনি কখনওই সেই রাজ্যকে উপেক্ষা করে ন্যায় যাত্রা করতে পারেন না যেখানে মানুষের প্রতি রাজনৈতিক অবিচার, গৃহযুদ্ধের মতো অস্থির অবস্থা দেখেও নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে কেন্দ্রীয় সরকার।
জনগণের প্রতিক্রিয়া এই ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের সারবত্তা প্রমাণ করেছে। যেহেতু যাত্রাটিকে ‘ন্যাশনাল মিডিয়া’গুলো বয়কট করেছে — নয়ডা-ভিত্তিক ন্যাশনাল মিডিয়া চ্যানেলগুলির জন্য আমার ছোট্ট উপদেশ — নিজের চোখে রাহুল গান্ধিকে স্বাগত জানাতে সাধারণ মানুষের ঢল বুঝতে ইউটিউব দেখতে হবে। গত কয়েক মাসের সবচেয়ে হিংসাপ্রবণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি হল সেনাপতি জেলার কুকি এলাকা। এই অঞ্চলে যাত্রা প্রবেশের সময়ে যে দৃশ্য আমি দেখেছি তা কখনওই ভোলার নয়। আগের দিন সন্ধ্যায় যাত্রা মেটেই অঞ্চলে প্রবেশের সময়ের অভ্যর্থনা নিঃসন্দেহে দেখার মতো ছিল তবে এটা এমন ঘটনা ছিল যা সারা জীবনে একবারই ঘটে। সমস্ত গ্রামবাসী কার্যত রাস্তা ও তার আশেপাশে জড়ো হয়েছিল। তাঁদের চোখের জলে আশা, মরিয়া হয়ে ভারতকে আঁকড়ে থাকার বাসনা। মহিলারা যাত্রার বাসের কাছে এসে তাঁদের যা মনের কথা, সব উজাড় করে দিলেন। বাচ্চারা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক কর্মীরা এই হিংস্রতার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবকে ব্যক্ত করেছেন। নেতারা তাঁদের দাবি তুলে ধরেন। সেখানে শোক, তিক্ততা, ক্রোধ যেমন ছিল, রাহুল গান্ধি তাঁদের ক্ষত সারিয়ে দিতে পারেন এমন আশাও ছিল। আমার কাছে এ সবই ছিল জাতীয় সংহতির একটি মুহূর্ত। নাগাল্যান্ড নিশ্চিত করেছে যে আগের ঘটনাগুলো অকস্মাৎ ঘটে যায়নি। আমরা যাত্রার একটু আগে আগে ছিলাম। ওখা নামক একটি ছোট শহরে, রাহুল গান্ধির আসার অপেক্ষায় থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। এক চায়ের দোকানের মালিক সেখানকার জনপ্রিয় আলু পুরি (ভাটুরা এবং পুরি মিশ্রিত পদ) খাওয়ার জন্য আমাদের জোর করেছিলেন এবং বিনিময়ে টাকা নিতে অস্বীকার করেছিলেন। মহিলারা বাচ্চাদের সঙ্গে করে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করেছিলেন, এক ঝলক কেবল দেখার জন্য। শহরের সবাই ঠাঁই নিয়েছিল রাস্তায় কিংবা বাড়ির ছাদে। ঠিক যেমনটা দেশের অন্য কোথাও ঘটে। সব দেখে মুহুর্তের জন্য আপনি ভুলে যেতে পারেন যে এ হল সেই নাগাল্যান্ড, ভারতের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রথম বিদ্রোহের স্থান, যেখানে একজন দর্শনার্থীকে এখনও জিজ্ঞাসা করা হয় “আপনি কি ভারত থেকে এসেছেন?”, আভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলির হাতেই যেখানকার লাগাম রয়েছে। আপনি এও ভুলে যাবেন যে ৪০ সদস্যের রাজ্য বিধানসভায় কংগ্রেসের একটিও বিধায়ক নেই। অরুণাচল এবং মেঘালয়ে এই বৈপরীত্য কম ছিল, সেখানে কংগ্রেস এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ন্যায় যাত্রা যে পরিমাণ জনপ্রিয় অভ্যর্থনা পেয়েছে তা স্পষ্টতই কংগ্রেসের সাংগঠনিক বা নির্বাচনী শক্তিকে ছাড়িয়ে গেছে। সব দেখে ভারত জোড়ো যাত্রার সময় কন্যাকুমারীর জনসমুদ্র এবং কাশ্মীর উপত্যকার চলমান দৃশ্যের কথা আমার মনে পড়ে গেল। ভারত জোড়ো অবশ্যই ভৌগলিক পরিধি থেকে শুরু হবে। এবং কংগ্রেসের বেঁচে থাকার সদিচ্ছার জন্য ধন্যবাদ এবং একটি আবেগপূর্ণ সংযোগ স্থাপনার জন্য যা রাহুল গান্ধি প্রান্তিক মানুষের সাথে উপভোগ করেন।
প্রান্তিক নাকি মূলধারা
প্রান্তিক রূপকটি অন্য অর্থ নিয়েছিল যখন আমাদের যাত্রা অসমে প্রবেশ করে এবং তারপর শিলিগুড়ি করিডর (চিকেন্স নেক) অতিক্রম করে। সমাজের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে বিশেষ সংযোগ স্থাপনকারী এটি প্রথম যাত্রা। তা শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এমনটা নয়। রাহুল গান্ধি মুসলমানদের সঙ্গে স্বাভাবিক সংযোগ উপভোগ করেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই, যদিও তিনি প্রতীকী তুষ্টির কোনও দেখনদারির চেষ্টা করেন না। মুসলিম ঘনত্বের এলাকাগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিইয়ে বিজেপির প্রোপাগান্ডার বিরোধী এই যাত্রার পথ ঠিক করা হয়নি (কিষাণগঞ্জ এবং মালদা এই পথে নেওয়া হয়েছে কারণ সেখানে কংগ্রেসের বর্তমান সাংসদ রয়েছে। প্রত্যেক দরগায় দরগায় গিয়ে কোনও রুটিন ভিজিট করা হয়নি , কোনও দাড়িওয়ালা পাদ্রীদের দলে ভিড়ে যাওয়া নেই, রাহুলের বক্তৃতায় কোনও শের-ও-শায়েরি নেই, থাকার মধ্যে আছে শুধু হাত জোড় করে সাধারণ সম্মান প্রদর্শন। ঠিক সেই কারণেই, একজন সাধারণ মুসলমান বুঝতে পারেন যে তিনি সমান নাগরিকত্বের অধিকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রথাগত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নেতাদের চেয়ে আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাঁকে বেশিই বিশ্বাস করা যেতে পারে। তাই তারা দল বেধে আসতে পারে, রাহুলের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ তারা বিশ্বাস করতে পারে, এবং তারা রাহুলের মনোভাব বুঝে নিতে পারে এবং সুযোগ পেলে তারা আনন্দের সাথে রাহুলের প্রার্থীদের সমর্থন করবে। এই ন্যায় যাত্রার কেন্দ্রবিন্দু হল মূলত আর্থ-সামাজিক সিঁড়ির শেষ শ্রেণির মানুষ, যারা সামাজিক স্তম্ভের নীচে বাস করে। আদিবাসী, দলিত এবং খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতি রাহুল গান্ধির যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ, তা এই যাত্রায় তাঁকে সাহায্যই করেছে। আদিবাসীদের সঙ্গে তাঁর এই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বিজেপির পুরনো রাজনীতি “বনবাসী”-র প্রতি তাঁর আক্রমণে বিশেষ ঝাঁজ এনে দেয় বইকি। ভারতের বর্ণ কাঠামো নিয়ে তার ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে যাওয়ার বিষয়টা সাধারণ দলিত এবং অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের কাছে নাও পৌঁছতে পারে, কিন্তু ওবিসি, দলিত এবং আদিবাসী নিয়ে কাজ করা সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে তা জাদুর মত কাজ করে। আসামের চা বাগানের শ্রমিক ও মাঝি, পশ্চিমবঙ্গের মনরেগা শ্রমিক, বিহারের কৃষক এবং ঝাড়খণ্ডের কয়লা শ্রমিক ও ক্ষুদ্র কয়লা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক, “লাভরথী” – র মত পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি ও মর্যাদা এবং অধিকারের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছে। এই সব থেকে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী লাভ কিছু হবে কিনা তা বলা কঠিন। কিন্তু এসবই আধিপত্যবাদী রাজনীতির পাল্টা প্রতিবন্ধক তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং এই সময়ে এটাই দেশের ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। এসব হার্ডকোর রাজনীতিকদের প্রভাবিত নাও করতে পারে — ঠিক আছে, তারা এমন সব প্রশ্ন তুলতেই পারে, তাহলে প্রকৃত মূলধারার রাজনীতির কী হবে? যে রাজনীতি হচ্ছে তা কি প্রান্তিকের জন্য রাজনীতি নয়? এই রাজনীতি কি বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল এবং সংগঠন যন্ত্র চালনাকারী অর্থ এবং মিডিয়ার ভয়ানক সম্মিলিত ক্ষমতার জোরকে ও বিজেপির রাষ্ট্রীয় এবং রাস্তার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সহায়ক হতে পারবে? এখানেই প্রান্তিক কথার রূপকটা পুরো উল্টে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের মত নয়, ভারতে দলিত, আদিবাসী, ওবিসি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বড় মাত্রায় সংখ্যালঘু। ইউরোপীয় রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গৃহীত শ্রমিক-শ্রেণীর রাজনীতির চরিত্র এ দেশে ধরা পড়ে না। বরং অর্থনৈতিক স্তম্ভের নীচে থাকা অংশটি এদেশে জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি। তথাকথিত ‘মধ্যবিত্ত’রা ভারতীয় সমাজের কোন কঠিন বুনিয়াদি শক্তি নয় বরং এক পলকা স্তর। যদি এটি একটি খিচুড়ির থালা হয়, ধার তাহলে বেশির ভাগ খিচুড়িটাই থালার প্রান্ত বরাবর রয়েছে। বরাবর সারিবদ্ধ করা সবটাই সেখানে সেই খিচুড়ি। ভারতে প্রান্তিকজনের জন্য রাজনীতিই হল মূলধারার রাজনীতি। দেশের মূল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের মধ্য দিয়েই।
অনুবাদ: শুভম সেনগুপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct