অসিকুল খান: “মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি কি বাংলা ভাষা।” জন্মের পর মায়ের কোলে থেকে আমরা যে ভাষা শিখেছি, যে ভাষায় সে বড় হয়েছি আপন মাতৃভূমিতে, সেই ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষা মায়ের নাড়ির সাথে যুক্ত থাকার ভাষা। এ ভাষা হল স্বপ্ন দেখার ভাষা। এই পৃথিবাতে হাজারো ভাষা রয়েছে। তার মধ্যে যে ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব, যে ভাষা আমাদের বাঙালী বলে পরিচয় দিয়েছে, তা হল বাংলা ভাষা। বাংলা হল দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা। মোট ব্যাবহার অনুসারে বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ও আসাম এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে (২০২১)। বাংলা ভাষার বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরনো। চর্চাপদ-এ এই ভাষার আদি নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতীয় ভূ-খণ্ডের প্রাচীণ ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা অন্যতম। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তন হয়েছে। হয়েছে সামাজিক বিবর্তন। সেই বিবর্তনের প্রভাব দেখা গেছে ভাষাতেও। ভৌগলিক বৈচিত্রতা ও বিচিত্র ইতিহাসের হাত ধরে বাংলা ভাষাতেও আবির্ভাব হয়েছে আঞ্চলিকতার। ভাষা সাহিত্য ও গবেষণায় কলকাতাকেন্দ্রিক কিছু ভাষাবিদেরা এই আঞ্চলিকতাকে বাংলার উপভাষার তকমা দিয়ে নিজেদের সুপেরিওরিটি কম্প্লেক্স দেখিয়েছেন। তাদের আধিপত্যে ব্রাত্য হয়ে গেছে আঞ্চলিক ভাষাগুলি। ফলে মালদা , মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর এর বাধিয়া, পেঁচি , খোট্টা, সুরজাপুরি ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষা, নদিয়া, বীরভূম জেলার বাঙাল ভাষা এবং অন্যান্য জেলার গ্রাম-পাড়াগাঁ-এর আঞ্চলিক ভাষা আজকে চরম অস্তিত্ব সংকট-এর সম্মুখীন। আজকাল একটু মফসস্ল এ গেলে আমরা আমাদের পাড়া-গ্রামের ভাষায় কথা বলতে দ্বিধা বোধ করি বা লজ্জা পাই। তার কারণ শহর ও মফসস্ল-এর মানুষ বা উচ্চবিত্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও এই ভাষাগুলোকেও ঠিক ভদ্র বলে বিবেচনা করেন না। তাই আমরা যখন গ্রাম বা প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে এসে শহরের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেল কলেজ, মেস ও হোস্টেল ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার করি, তীব্র নিন্দার ছলে গ্লানি শুনতে হয় “তুই গাইয়া নাকি? তোরা বাধিয়া নাকি?”আবার বিপরীত মেরুর সমাজ ব্যাবস্থাও ঠিক আমাদের মেনে নিতে পারে না। যখন শহর থেকে গ্রাম এ ফিরি, পাড়ার দাদু-দিদাদের থেকে শোনা যাই, “কিরে শহুরে হয়ে গেলছিস তঁও?” আবার আমরা গ্রাম থেকে আসা ছেলে মেয়েরা, বাঁকুড়া পুরুলিয়া-র প্রান্তিক আদিবাসী ছেলে মেয়ে-রা এই বিশাল প্রতিষ্ঠান-এর গণ্ডিতে নিজেদের বাক্ স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র ভাষাগত শ্রেণী বৈষম্য-এর কারণে । এই যে ভাষার শহরায়ন বা কলকাতা কেন্দ্রিক ভাষার বৈধতা ও প্রাধান্য দেওয়ার কারণে আজকে প্রান্তিক সমাজের ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পিছিয়ে। যদিও তারা অনেক বিদ্যা ও বুদ্ধির দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে, তবুও তাদের ভাষা বলার ধরন দেখে তাদের যাচাই করা হয়।
আমরা শিয়ালদাহ থেকে ট্রেন ধরে লালগোলা লাইন-এ যাওয়া আসা করি। কলকাতার অনেকেই আমাদের ভাষা শুনে বলে দেয় “লালগোলা লাইন-এ বাড়ি ?” কারণ ওনাদের বাড়িতে বা এলাকায় মালদা-মুর্শিদাবাদ থেকেই রাজমিস্ত্রী বা শ্রমিকেরা কাজ করে। তাদের থেকে তারা শুনে সহজে বুঝে ফেলেন এটা লালগোলা লাইন তথা মুর্শিদাবাদ-এর ভাষা ।এই বাংলার শাসক, বুদ্ধিজীবী বা বাবুরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে যেভাবে কলকাতা কেন্দ্রিক বা মহানগরকেন্দ্রিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার চরম অস্তিত্ব সংকট । তাই আজকে প্রান্তিক, দলিত, ও মুসলিম সাহিত্য আলাদা করে তাদের ভাষার সাহায্যে তাদের কথা, কাহিনী, জীবন যাপনের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছে। বাংলার বাঙালি মুসলিমদেরও অনেক শোষণ ও বঞ্চনা মেনে নিতে হয়। ধর্মীয়ভাবে তারা মুসলিম, আবার ভাষাও জাতিগতভাবে তারা বাঙালি। এই বাঙালি মুসলিমদের অনেকসময়ই “বাংলাদেশী” বা “বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম” বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। আমরা বর্তমানে শুনে আসি “হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান” এই ভাবধারাটাকে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকার জনগনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই ভাষার এককেন্দ্রিকরণ শহর ও রাজ্য তথা সারা দেশে ছড়িয়েছে যা ভারতবর্ষের মত গনতন্ত্রকে মৃত্যুর দিকে আরও একধাপ এগিয়ে দেওয়ার সমান। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের ফলে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে অসংখ্য আঞ্চলিক ভাষার মানুষকে তাদের মাতৃভাষাকে হারাতে হবে। দেশের ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষাগত বৈষম্যের স্বীকার হতে হচ্ছে। বাঙালী দেখলেই বাঙলাদেশী বলে টিটকারী করা হচ্ছে। মালায়ালামভাষীদের বলা হচ্ছে মাল্লু। যারা বাংলার বাইরে থাকে তারাই জানে হিন্দি-বলয় আমাদের কোন নজরে দেখে। বাংলা তথা ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময় অসংখ্য শাসক, সম্রাট ও রাজারা তাদের শাসনকালে উর্দু, ফারসি, দেবনাগরী, হিন্দি ও পালি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কোর্ট-এর ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এবং সমাজেও চাপিয় দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটা তখনও সেভাবে ফলপ্রসু হয়নি। একটা সরকার বা শাসক মাতৃভাষাকে কখনও কেড়ে নিতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে আবারও মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাকে শেকড় ছিঁড়ে দিয়ে ভাষার রাজনৈতিক এককেন্দ্রিকরণ করার চেষ্টা চলছে। যে ভাষাকে জুড়ে আজ সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস পালিত হচ্ছে, সেই ভাষার অস্তিত্ব, বৈচিত্র টিকিয়ে রাখা বাঙালি হিসাবে আমাদেরই কর্তব্য। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের আরও নিজের ভাষা, বাংলা ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার ভিতটাকে আরও শক্ত করে ধরতে হবে। শেকড় টাকে গভীর ভাবে পুষ্ট করতে হবে। আমাদেরকে নিজেদের ভাষার প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি, অন্যর ভাষাকেও সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। আমাদের মধ্যে ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগতভাবে গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। তবেই আমরা বলতে পারব “নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের ও মাঝে দেখো মিলনও মহান।”
এম.ফিল গবেষক
দর্শন বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct