আর্থিক লাভ, সামাজিক উন্নতি, চাকরিতে পদোন্নতি, ব্যবসায় লাভ ইত্যাদি কারণে মানুষ, মানুষের ওপর অত্যাচার এবং তার সঙ্গে শত্রুতা করে। কিন্তু শুধুমাত্র আনন্দ পাবার জন্য অনেকে মিলে একজনের ওপর অত্যাচার করার প্রবণতা বাঙালি সমাজে যেন অতিশয় প্রবল। এই কাজটা খুনের মতই গুরুতর অপরাধ। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর্থিক লাভ, সামাজিক উন্নতি, চাকরিতে পদোন্নতি, ব্যবসায় লাভ ইত্যাদি কারণে মানুষ, মানুষের ওপর অত্যাচার এবং তার সঙ্গে শত্রুতা করে। কিন্তু শুধুমাত্র আনন্দ পাবার জন্য অনেকে মিলে একজনের ওপর অত্যাচার করার প্রবণতা বাঙালি সমাজে যেন অতিশয় প্রবল। জ্ঞানী মানুষেরা যাই বলুন না কেন, আমার কাছে এই কাজটা খুনের মতই গুরুতর অপরাধ। এইভাবে যারা একজনের ওপর অত্যাচার করে, তারা কেউ সমাজবিরোধী নয় বরং ভালো রকমের সামাজিক। এরা রক্তদান শিবির, গরিবদের জন্য বস্ত্রদান শিবির, ফুটবল টুর্নামেন্ট ইত্যাদি সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত থাকে। কিন্তু কোনও একজনের ওপর তাদের নির্যাতন, নির্যাতিতকে কতটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে নীচের ঘটনাটা তার প্রমাণ। একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিরত ৪০ বছর বয়স্ক ‘বিনয় রায়’ কলকাতা শহরতলীতে নিজের একতলা বাড়িতে থাকতেন।সাথে ছিল তাঁর ৩০ বছর বয়সী সুন্দরী স্ত্রী ‘সায়নী’ আর ১২ বছরের একমাত্র স্কুলে পড়া ছেলে।বাড়ির কাছে ছিল “দীপশিখা” ক্লাব। এরা মাঝে মাঝে রক্তদান, গরিবদের বস্ত্রদান শিবির, ফুটবল টুর্নামেন্ট ইত্যাদির ব্যবস্থা করত। আবার,এই ক্লাবের ছেলেরাই বিনয়ের ওপর খুব অত্যাচার করত। বিনয় রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তারা কখনও গলার স্বর মোটা করে,কখনও মেয়েদের মত সরু করে “বোতল”,” এই বোতল কোথায় যাবি” ইত্যাদি বলেচেঁচিয়ে উঠত। কখনও কুকুর বা বেড়ালের মত ডাক ছাড়ত। এতে তারা খুব মজা পেত। বিনয় প্রতিবাদ করেও কোনও ফল হয়নি। যেমন, একদিন বিনয় ওদের বললেন ,তোমরা আমার সঙ্গে এইরকম কেন করছ,এতে তোমাদের কি লাভ ? আমি তোমাদের কোনও ক্ষতি করেছি” ? ওদের একজন বলল, “রাস্তা দিয়ে তো অনেক লোকই যায়,কিন্তু কথাগুলো আপনাকে বলেছি,কে বলেছে”? আরেকজন বলল, “কোনও প্রমাণ আছে ?একদম ফালতু কথা বলবেন না, অন্যেরওপর দোষ চাপানো আপনার একটা অভ্যাস”। সম্বোধনটা ‘আপনি’ থেকে ‘তুই’- তে নামিয়ে, আরেকজন বলে উঠল, “কথা বাড়াবি না, যেখানে যাচ্ছিলি সম্মান থাকতে চলে যা,কথা বাড়ালে এবার ঝাড় খাবি”। ক্ষুণ্ণ মনে বিনয় চলে গেলেন। অত্যাচার চলতেই থাকল। পিছনে লাগার থেকে রেহাই পেতে বিনয় ঘুর পথে বাজার, দোকান, অফিস ইত্যাদি যেতেন। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি।যেখানেই বিনয় যেতেন, ক্লাবের ছেলেদের চোখে পড়লে তারা সেখানেই এইরকম করত। বিনয়ের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কোনও উচ্চশিক্ষিত ও সমজদার মানুষকে বিনয় তাঁর যন্ত্রণার কথা বললে তাঁদের কেউ বলতেন, “আপনি, তাদের সামনে কোনোদিন হয়ত এমন কোনও অস্বাভাবিক বা হাস্যকর কিছু করেছেন, যার জন্য তারা আপনার সঙ্গে এইরকম করে,নয়ত এত লোক থাকতে আপনার সঙ্গে এইরকম কেন করবে ”? কেউ বলেছেন, “এই ক্লাবের ছেলেরা এত সোশ্যাল ওয়ার্ক করে, তুমি ওদের সঙ্গে নিশ্চয় কোনও খারাপ ব্যবহার করেছ, নয়ত কেন এইরকম করবে”? অনেকে বলত, “তোমার নিশ্চয় মানসিক রোগ আছে,যার জন্য সবাই তোমার পিছনে লাগে,সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও”। মানসিক রোগী না হয়েও সেই বদনাম পাওয়া, বিনয়ের সহজ, সরল নিষ্পাপ মনকে জ্বালিয়ে দিত। এই যন্ত্রণার আগুন একসময় ভয়াবহ আকার নিল।
বিনয় একটা ধারালো অস্ত্র জোগাড় করলেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় একমাত্র আদরের ছেলের দুই গালে দুটো চুমু দিয়ে, “এই শেষ চুমু বাবা, আমি চললাম, আর কোনোদিন ফিরব না”, বলেই কেঁদে ফেললেন। রান্নাঘরে গিয়ে স্ত্রীর দুটো হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি চললাম, আর ফিরব না, ছেলেটা রইল তোমার কাছে,ওকে দেখো,অনেক ভালবেসো, মানুষ কোরো”। লুকানো ধারালো অস্ত্রটা দেখিয়ে বললেন, “এটা দিয়ে দীপশিখা ক্লাবের কয়েকটা ছেলেকে কুপিয়ে,আমিও মরব”। সায়নী তাঁকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমাদের ছেড়ে যেওনা, আমাকে দু-একটা দিন সময় দাও,আমি এর বিহিত করবই”। সেই সন্ধ্যায় সায়নী সারাক্ষণ স্বামীকে আগলে বসে রইলেন, নানাভাবে সান্তনা দিলেন আর এটার বিরুদ্ধে কিছু করবেন বলে জোরালো আশ্বাস দিলেন। সায়নী তাঁর স্বামীকে একটা অনুরোধ করলেন পরদিন অফিস থেকে বাড়ি না আসার। কাজে যাবার সময় সাথে করে ষ্টেশন অবধি গিয়ে ট্রেনে তুলে দিলেন। সায়নী গেলেন ওই এলাকায় তাঁর বিশেষ পরিচিত বড় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা “সুখেন সাহা”-র বাড়ি। সুখেনকে তিনি অত্যাচারের ঘটনা বললেন।সুখেনের কোথাও যাবার তাড়া ছিল। সায়নী তাঁকেসন্ধ্যায় চা খেতে আসার আমন্ত্রণ করে বললেন যে,তখন বিশদে বলবেন।সন্ধ্যায় সুখেন নিজের অনুগামী ৩-৪ জন যুবককে নিয়েসায়নীর বাড়িতে এলেন। সায়নী ছিলেন অতীব সুন্দরী। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সুখেন এবং ওই যুবকেরা সায়নীর সান্নিধ্যে মজে গেলেন। বিনয়ের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা তাঁরা মন দিয়ে শুনলেন এবং ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাংলা,বিহার ইত্যাদি রাজ্যে কিছু কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার খুব জোর থাকে। সুখেনের সেটা ছিল।পরদিন সন্ধ্যায় তিনি ওই ৩-৪ জন যুবককে নিয়ে দীপশিখা ক্লাবে গেলেন। ক্লাবের ছেলেদের তিনি প্রচণ্ড শাসানী দিলেন। একজন ছেলে বলল, “বিনয়দা একদিন আমাদের গালাগাল দিয়েছিল”। সুখেন এক ধমক দিয়ে বললেন, “আমি বিদেশ থেকে আসিনি,ওসব আমাকে শেখাবি না”। একজন খুব নম্রভাবে বলল, “বিনয়দা একদিন যেতে যেতে আমাদের ক্লাবের দিকে একটা বাজে কাগজ ছুঁড়ে ফেলেছিল। আমরা প্রতিবাদ করলে বলেছিল, এবার বোতল ছুঁড়ে ফেলব”।সুখেন এই রাজ্যেরই মানুষ, তিনি জানেন যে, এগুলো মিথ্যা, এখানে একজনের ওপর অত্যাচার করে,পরে তার ওপরই একটা মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। সুখেন এবারে খুব চড়া স্বরে বললেন, “ওসব দুষ্টুবুদ্ধি ছাড়,তোদের বলে দিলাম,আর একটি বারও যেন বিনয়দার ওপর কোনও দুর্ব্যবহার না হয়”। বিনয়ের ওপর অত্যাচার বুদবুদের মত কোথায় মিলিয়ে গেল। একজনকে অনেকে মিলে ক্ষেপালে সবাই বলেন,তার নাকি মাথাখারাপ। এক্ষেত্রেও যাঁরা বলতেন, “বিনয়ের মানসিক রোগ, ওঁর চিকিৎসার দরকার”, তাদের কাছে প্রশ্ন, বিনা চিকিৎসায়, বিনা ওষুধে তাঁর রোগ ভালো হয়ে গেল ? আসলে,মনের অবচেতনে এক শ্রেণীর মানুষের কোনো একজনকে ক্ষেপিয়ে আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়ে,সেটা চলতে থাকে।এই প্রবণতা বাংলার সমাজে অত্যন্ত বেশি। সবার তো বিনয়ের মত সুযোগ থাকে না, ফলে নির্যাতন চলতেই থাকে ,কখনও এর ফল হয় মারাত্মক। কবে হবে এই জঘন্য প্রবৃত্তির অবসান ?
[নাম পরিবর্তিত]
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct