প্রখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিব হলেন এমনই একজন মানুষ যিনি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবেই বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। সংগ্ৰামের মূর্ত একটা প্রতীক হিসেবেও মানুষ তাঁকে মনে রাখবেন চিরদিন। চির ভাস্বর হয়েও থাকবেন সংগ্ৰামী মানুষজনদের মানস হৃদয়ে। লিখেছেন ডা. শামসুল হক।
প্রখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিব হলেন এমনই একজন মানুষ যিনি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবেই বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। সংগ্ৰামের মূর্ত একটা প্রতীক হিসেবেও মানুষ তাঁকে মনে রাখবেন চিরদিন। চির ভাস্বর হয়েও থাকবেন সংগ্ৰামী মানুষজনদের মানস হৃদয়ে। নিজ ভূমিতেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন রাজনৈতিক পালা বদলের অনেক ঘটনাও। দেখেছেন মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে ব্রিটিশদের সেই আদিম লীলাও। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ কেমনভাবে ইংরেজদের হাতের পুতুলে রূপান্তরিত হয়েছিলেন সেই দৃশ্যও সদা সর্বদাই ছবি হয়ে ভেসে বেড়াত তাঁর দুই চোখেরই সামনে। সম্রাট বাহাদুর শাহেরই সভাকবি ছিলেন কবি মির্জা গালিব। সম্রাট নিজেও কবিতা লিখতেন। দরবারের অন্যান্য কবিদেরও উৎসাহ দিতেন। দিতেন যোগ্য মর্যাদাও। তাই সেইসময় মির্জা গালিব যেমন রাজদরবারে নিজেকে সঠিকভাবে প্রতিষ্টিত করতে পেরেছিলেন, ঠিক তেমনই তাঁর সান্নিধ্যলাভে সম্রাট নিজেও উপকৃত হয়েছিলেন। বিনিময়ে রাজ দরবার থেকে নিয়মিতভাবে পেতেন মাসোহারাও। কিন্তু রাজদরবারে সর্বদাই সতর্কও থাকতে হত তাঁকে। খুব বেশি কথাও বলতেন না তিনি। ইংরেজদের অধীনে থেকে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অর্থ যে নিজের পায়েই কুড়ুল মারা সেটাও তখন বোঝা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাই কাব্যিক ভাষায় সবকিছু প্রকাশ করার ইচ্ছে থাকলেও রাজদরবারে চুপচাপ বসেই সময় কাটাতেন তিনি। সেইভাবে চলতে চলতেই একসময় শেষ হয়ে যায় বাহাদুর শাহের জমানাও। সঙ্কটময় পরিস্থিতির মুখে পড়েন মির্জা গালিবও। বন্ধ হয়ে যায় তাঁর ভাতাও। ফলে সেইসময় প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যার মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি। কোথায় থাকবেন, কি করবেন সেই মুহূর্তে সেটাই হয়ে উঠেছিল তাঁর ভাবনার মূল বিষয়বস্তুও। কারণ তাঁর পারিবারিক অবস্থাও তেমন একটা মজবুত ছিল না বলেই একরাশ চিন্তার জটও এসে বাসা বেঁধেছিল তাঁর মনেরই দূয়ারে।১৭৯৭ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর জন্ম তাঁর আগ্ৰায়। তাঁর পূর্বপুরুষরা অবশ্য ভারতের বাসিন্দা ছিলেন না। সুদূর সমরকন্দ থেকে তাঁর পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন এদেশে। বসবাস শুরু করেছিলেন আগ্ৰায়। তারপর সেখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ওঠেন তাঁরা। অল্প বয়সেই বাবাকে হারান মির্জা। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর। তাই অন্যের তত্ববধানেই মানুষ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রাথমিক পর্বের পড়াশোনা শুরু আগ্ৰাতেই। সেখানকার স্বনামধন্য পণ্ডিত আবদুস সামাদের অধীনে শুরু হয় তাঁর অক্ষরজ্ঞান।আরবি এবং ফারসি ভাষার উপর বিশাল দখলও ছিল তাঁর। সেই ভাষায় কবিতাও লিখতেন। আর গুরুর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন তিনিও। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। খুব অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। মাত্র তের বছর বয়সেই বিবাহ করেন গুমরাহ বেগমকে। তারপর আগ্ৰা ছেড়ে চলে আসেন দিল্লিতে। সেটা ১৮১১ সালের কথা। আর তারপর থেকে টানা পঞ্চাশ বছর সেই শহরেই কেটেছে তাঁর জীবন। দিল্লির সদা ব্যস্ত অঞ্চল চাঁদনী চকই তখন হয়ে ওঠে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। আর সেখানেই মন খুলে কবিতা লিখতেও শুরু করেন। একটু নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করতেন তিনি। তাই প্রকাশের আলোয় আসতে তেমন একটা আগ্ৰহও ছিল না তাঁর।
দিল্লির নতুন ঠিকানায় খুব সুন্দরভাবে কেটে যাচ্ছিল মির্জা গালিবের সেই সময়ের রোমাঞ্চকর দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ আসে বিশাল একটা পরিবর্তন। মাদক দ্রব্যের উপর বিশেষ আকর্ষণ জন্মাতে শুরু করে তাঁর। শুরু করেন নানান ধরনের নেশায় নিজেকে মত্ত রাখাও। তারমধ্যে মদ্য পানটাই ছিল তাঁর বেশি পছন্দের। আর নেশার ঘোরে থাকতে থাকতেই এক সময় আবার জুয়ার প্রতিও ঝুঁকে পারেন তিনি। খুঁজতে শুরু করেন নতুন নতুন জুয়ার ঠেকও এবং দু হাতে ওড়াতে থাকেন সঞ্চিত সমস্ত অর্থও।সেইভাবে চলতে চলতে একটা সময় তিনি আবার এমনই বিলাসী হয়ে উঠেছিলেন যে তখন আর ঠেকে গিয়ে মদ খাওয়া অথবা জুয়া খেলা, কোনটাই পছন্দ করতেন না তিনি। তখন বাড়িতেই বসত সেই আসর। সেখানেই ডেকে নিতেন ইয়ার দোস্তদের। ছুটত ফুর্তির ফোয়ারাও। আর সেটাকে তিনি কোন অপরাধ বলে মনেও করতেন না। সেখানে আসা যাওয়া করতেন সব ধর্মের মানুষজনই। বলাই বাহুল্য, সেই ব্যাপারে তিনি আবার ছিলেন ভীষণ উদারও। ছিল না ছোঁয়া - ছুঁয়ির বালাই কিংবা ধর্মের গোঁড়ামিও।মদ, জুয়া এবং বন্ধুবান্ধব, এই নিয়েই কেটে যাচ্ছিল কবি মির্জা গালিবের সেইসময়ের দিনরাত্রি। সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল ইংরেজ রাজ দরবারেও। সতর্ক করা হয়েছিল প্রশাসনের তরফ থেকেও। কিন্তু তাতে টনক নড়েনি তাঁর। ফলে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মনস্থির করে ব্রিটিশ সরকার। সেটা ১৯৪১ সালের কথা। সরকার তাঁকে শেষ বারের মত সতর্ক করে, সেইসঙ্গে মোটা অংকের জরিমানাও। তাতেও কিন্তু জ্ঞান ফেরেনি মির্জার। নানান ধরনের নেশা তখন তাঁকে এতটাই মোহগ্ৰস্থ করে তুলেছিল যে তাঁর নিজস্ব চরিত্রের কোন রকম পরিবর্তনই লক্ষ্য করা যায়নি। তবে বদল করেছিলেন নেশার ঠেক সহ অন্যান্য সহযোগীও। দিল্লির কোতোয়াল ফৈয়াজ খানের বাড়িতে তখন নতুনভাবে শুরু হয়েছিল নেশার নির্দিষ্ট আখড়া। তক্কে তক্কে ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও। একসময় সেই আস্তানাতেই সদলবলে ধরা পড়লেন মির্জা গালিব। এবার আর কোন সতর্কবার্তা নয়। সোজা হাজতে। তারপর কারাদণ্ড, সেইসঙ্গে মোটা অংকের জরিমানাও।কারাগারের অন্ধকার গহ্বরে তাঁর মনের মধ্যে জাগ্ৰত হয় পরিবর্তনের ছোঁয়া। দূরত্ব বাড়তে থাকে পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও। কয়েকদিনের মধ্যেই আবার হয়ে ওঠেন অন্য এক মানুষও। আর ঠিক তখনই তাঁর মনের মধ্যে জাগ্ৰত হতে শুরু করে কবি সত্ত্বাও। জেলখানার মধ্যেই লিখতে শুরু করেন কবিতা সহ অন্যান্য আরও অনেক লেখাও। লিখতে আরম্ভ করেন চিঠিপত্রও। সেটাও তাঁর ছিল অনেক দিনেরই অভ্যাস।
তেমনই একটা চিঠিতে অনেক দিনের পুরাতন এবং অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে লেখেন মনের অনেক গোপন কথাও। এই পৃথিবীতে আর না থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেই সেদিন সেই চিঠি তিনি লিখেছিলেন তাঁর সেই প্রিয়জনকে। লিখেছিলেন তেমনই আরও অনেক চিঠি। সেইসময়ের লেখা তাঁর অনেক কবিতার মধ্যেও ফুটে উঠেছিল সেই একই আকুতি।অল্প দিনের মধ্যেই জেলখানার যন্ত্রণা থেকে মুক্তিও পেয়েছিলেন তিনি। সেইসময় জীবন সম্পর্কে একটু উদাসীনই হয়ে উঠেছিলেন মেজাজি সেই মানুষটা। মুখোমুখি হয়েছিলেন আর্থিক সঙ্কটেরও। কিন্তু তখন তাঁর ভাগ্য তাঁকে ভীষণ সহায়তাও দিয়েছিল। দিল্লির বাদশাহ বাহাদুর শাহ তখন এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর পাশে। তৈমুর বংশের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব তাঁকে দেন মোটা পারিশ্রমিকেরই বিনিময়ে।আবার নতুনভাবে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেন কবি মির্জা গালিব। তখন একেবারে দুরন্ত গতিতেই ছুটে চলে তাঁর কলম। কিন্তু সেটাও সীমিত সময়েরই জন্য। মাঝখানেই থেমে যায় তাঁর সাহিত্যের সেই স্যন্দনও। ফলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেই জীবন কাহিনীও। বাদশাহ কিন্তু সেই লেখণীরও যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। সেইসময় তিনি বুঝেও গিয়েছিলেন যে, এর বেশি আর কিছুই করা সম্ভব নয় মির্জার পক্ষে। তাই তাঁর বিরুদ্ধে আর কোন অভিযোগই আনেননি তিনি। বরং যতটুকু লেখা হয়েছিল সেটাই এনেছিলেন প্রকাশের আলোয় এবং মিটিয়ে দিয়েছিলেন প্রাপ্য অর্থও। শুধু তাই নয়, তাঁর জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন নির্দিষ্ট একটা মাসোহারারও।অতএব সেইসময় খাওয়া পরার জন্য আর কোন সমস্যারই মুখোমুখি হতে হয়নি মির্জাকে। ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিল তাঁর দিনও। একসময় সেটাও বন্ধ হয়ে গেলে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তাঁর দায়িত্ব নেন। ব্যবস্থা করেন ভাতারও। কিন্তু সেই সুখটুকুও সয়নি তাঁর। ১৬৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার অযোধ্যাকে নিজেদের দখলে আনলে বন্ধ হয়ে যায় সেই ভাতাও। ফলে অথৈ জলে পড়ে হাবুডুবু খেতেও শুরু করেন তিনি। কিন্তু একেবারে হতাশগ্ৰস্থ হয়ে পড়েননি। কখনও লিখেছেন, কখনও থেমেছেন। জীবনটাও তাঁর কেটেছিল একেবারে জোয়ার ভাটার মতোই।
কলকাতাতেও এসেছিলেন মির্জা গালিব। ছিলেনও বেশ কয়েক দিন। হেদুয়া পার্কের কাছে বিডন স্ট্রিট ছিল তাঁর সেইসময়ের ঠিকানা। সেখানকার স্বচ্ছ আর খোলামেলা পরিবেশে তিনি নিজে নিজে তৃপ্ত অনুভবও করতেন। লেখালেখির কাজ চালাতেন একেবারে সময়ের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে। বলা যেতে পারে কলকাতার সেই জীবনটাই যেন তাঁর সাহিত্য জীবনেও এনে দিয়েছিল বিশাল এক পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত। নিজের আত্মকাহিনী মধ্যে তিনি স্বীকারও করেছেন সেই কথা। তিনি লিখেছেন কলকাতার বৃত্ত তাঁর অতি পরিচিত সাহিত্য জগতের থেকে অনেক অনেক আলাদা ধরণেরই। সেখানে আছে পরিপূর্ণ তৃপ্তির আস্বাদনও। আছে উপযুক্ত সন্মাননাও। নেই অপ্রয়োজনীয় রেষারেষিও। কলকাতায় থাকতে থাকতেই তাই তিনি গভীরভাবে আপ্লুত হয়েই একটা চিঠিও লিখেছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু আলি বক্সখানকে। লিখেছিলেন, কলকাতা জয় করেছে তাঁর মনপ্রাণ এবং সমগ্ৰ হৃদয়টাকেও।কলকাতায় থাকার সময় অনেক সাহিত্য সন্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানেও তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, কলকাতার সেই আয়োজন দিল্লির থেকে একটু আলাদাই। সেটা মোটেও সৌজন্যমূলক নয়। সেটার মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আছে উদারতা এবং নমনীয়তাও। তাই কলকাতায় থাকাকালীন মির্জা গালিবের কাব্য ও সাহিত্য সত্ত্বা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়েও পড়েছিল। এখান থেকেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর সেই কালজয়ী গ্ৰন্থ চিরাগ - ই - দাইর এবং বদ - ই - মুখলিফ। আবার কলকাতা থেকে চলে যাওয়ার পর লিখেছিলেন অন্য আর একটা মূল্যবান গ্ৰন্থ সফর - এ - কলকাতা।কলকাতাও তাই মনে রেখেছে তাঁকে। সাহিত্যের সেই অমর স্রষ্টাকে স্মৃতিপটে ধরে রাখার উদ্দেশ্যেই তাঁর প্রিয় শহর কলকাতার নিউমার্কেটের পাশেই একটা রাস্তার নাম রাখা হয়েছে মির্জা গালিব স্ট্রীট। আগে সেই রাস্তা পরিচিত ছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, এই নামেই। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন কিন্তু মোটেও সুখকর হয়ে ওঠেনি মির্জা গালিবের কাছে। ১৮৫৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন বাহাদুর শাহ। পুরো পরিবার সহ তাঁকে নির্বাসিত করা হয়েছিল সুদূর রেঙ্গুনে। ফলে সঙ্কট বাড়ে তাঁরও। বন্ধ হয়ে যায় সরকারি ভাতাও। সেটা নিয়েও অবশ্য টালবাহানা চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। কখনও চালু ছিল। আবার কখনও বন্ধও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাহাদুর শাহর ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর ভীষণ সঙ্কটময় পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। আর সেইভাবে দিন কাটাতে কাটাতেই ১৮৬৯ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নেন তিনি। দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানেই সমাহিত করা হয় তাঁকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct